প্রস্তাবিত বাজেট নিয়ে যা ভাবছে স্থানীয় শিল্প
২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে স্থানীয় শিল্পগুলোর জন্য আরও এক থেকে দুই বছর কর সুবিধা অব্যাহত রাখা হয়েছে। এতে এসব শিল্পের জন্য কিছুটা স্বাস্তি বয়ে আনার কথা থাকলেও ব্যবসায়ী নেতারা বাজেটটিকে আপাতদৃষ্টিতে ব্যবসা-বান্ধব হিসেবে দেখছেন না।
স্থানীয় শিল্পের সক্ষমতা অর্জনে বিদ্যমান সুবিধা আগামী এক থেকে দুই বছর বাড়ানো হলেও অন্যান্য কিছু খাতের কাঁচামাল আমদানিতে ভ্যাট কিছুটা বাড়ানো হয়েছে; ওইসব খাতের ভ্যাট বাড়িয়েই সুবিধা অব্যাহত রাখা হয়েছে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য।
তাই ব্যবসায়ী নেতারা সার্বিকভাবে সরকারের এই বাজেটকে ব্যবসা-বান্ধব বলছেন না। তারা বলছেন, যেসব খাতে ট্যাক্স কিংবা কাঁচামাল আমদানির শুল্ক বাড়ানো হয়েছে, তাতে পণ্যমূল্য বাড়বে এবং শিল্পের সক্ষমতা কমবে।
হোম অ্যাপ্লায়েন্স, অ্যালুমিনিয়ামের তৈজপত্র, সিমেন্ট, মোবাইল ফোনসহ বেশকিছু খাত রিডিউসড রেটে (হ্রাসকৃত হারে) মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) প্রদান করছে (নিয়মিত ১৫ শতাংশের বদলে ৫ শতাংশ)।
প্রস্তাবিত বাজেট অনুযায়ী, এই খাতগুলোকে এখন কিছুটা বেশি (৭.৫ শতাংশ) হারে ভ্যাট দিতে হবে, তবে এক থেকে দুই বছরের জন্য হ্রাসকৃত করহারের সুবিধা তারা ভোগ করতে পারবে।
এবারের বাজেটে জমি ও ফ্ল্যাট বিক্রির গেইন ট্যাক্স দ্বিগুণ হয়েছে। এছাড়া সিমেন্ট, পাথর, টাইলস, লিফট, সিরামিক, গ্লাস, সুইচ-সকেট, ক্যাবল, কিচেনওয়্যারসহ শিল্প সংশ্লিষ্ট প্রায় ১২টি আইটেমের আমদানি শুল্ক বেড়ে যাওয়ায় আবাসন খাত ও সংশ্লিষ্ট শিল্পগুলো মারাত্নকভাবে প্রভাবিত হবে বলে মনে করছেন খাত সংশ্লিষ্টরা।
তবে বাংলাদেশ প্লাস্টিক গুডস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি শামীম আহমেদ টিবিএসকে বলেন, "স্থানীয় শিল্পকে সুরক্ষা দেওয়ার বিষয়টি সরকারেরই অঙ্গীকার ছিল। সুরক্ষার ফলে ভোক্তাদের সুলভমূল্যে এসব পণ্য পাওয়ার সুযোগ ছিল।"
"কিন্তু এখন এসব পণ্যের মূল্য বেড়ে গেলে ভোক্তারা ক্রয় কমিয়ে দেবে, এতে আমাদের শিল্প ক্ষতগ্রস্ত হবে," যোগ করেন তিনি।
অবশ্য অর্থনীতিবিদ ও রাজস্ব খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, স্থানীয় শিল্পকে সক্ষমতা অর্জনের বার্তা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে এ বাজেটের মাধ্যমে। এর মাধ্যমে ব্যবসায়ীরা এখন থেকেই এলডিসি পরবর্তী চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় প্রস্তুতি নিতে শুরু করবেন বলে মনে করছেন তারা।
ন্যাশনাল বোর্ড অব রেভিনিউ'র (এনবিআর) ভ্যাট সংশ্লিষ্ট একজন সিনিয়র কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "অনেকে লম্বা সময় ধরে সুবিধা পেয়ে আসছে। এখন তাদের সক্ষমতা অর্জন করতে হবে। এরই অংশ হিসেবে কিছু খাতের রিডিউসড ভ্যাট সুবিধা কমিয়ে দেওয়া হয়েছে।"
তাদের প্রোটেকশন আগামীতে আরো কমতে পারে এবং তাদের সক্ষমতা অর্জন করতে হবে– এমন বার্তা দেওয়া হয়েছে বলে জানান তিনি।
অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুর মনে করেন, এলডিসি গ্র্যাজুয়েশনের প্রস্তুতি হিসেবে আমদানি পণ্যের সঙ্গে স্থানীয় পণ্যের সুরক্ষা (প্রটেকশন) কমানোর অংশ হিসেবে এই নেওয়া উদ্যোগ যৌক্তিক।
সাবান ও শ্যাম্পু তৈরির কাঁচামাল আমদানির বিদ্যমান রিডিউস ট্যাক্স রেট সুবিধা চলতি বছর শেষ হওয়ার কথা ছিল, যা এক বছর বাড়ানোর প্রস্তাব এসেছে বাজেটে।
এই পণ্যের মত ট্যাক্স সুবিধার মেয়াদ এক থেকে তিন বছর বেড়েছে রেফিজারেটর, ফ্রিজার, স্যানিটারি ন্যাপকিন ও ডায়াপার, হাতে তৈরি বিস্কুট ও কেক, বেশকিছু ওষুধ তৈরির কাঁচামাল, স্পিনিং মিলের রিসাইকল ফাইবার তৈরির জন্য ঝুট বা ওয়েস্ট ও পশুখাদ্যের কাঁচামাল কোকোনাট কোপরা ওয়েস্টে।
তালিকায় আরো রয়েছে- ব্লেন্ডার, জুসার প্রেশার কুকার, ওয়াশিং মেশিন, মাইক্রোওয়েভ ওভেন, ইলেকট্রিক ওভেনসহ বেশকিছু হোম অ্যাপ্লায়েন্স পণ্য।
বাংলাদেশে এ ধরনের আইটেমের সবচেয়ে বড় প্রতিষ্ঠান ইউনিলিভার বাংলাদেশ লিমিটেডের সিইও জাভেদ আকতার বলেব "এ সুবিধা বাতিল হলে হয়তো এসব এসব পণ্যের দাম বেড়ে যেত। অব্যাহত রাখার ফলে বাজারে প্রভাব পড়বে না, কারণ এ সুবিধা তো এতদিন ছিলই।"
মারাত্মকভাবে প্রভাবিত হবে কিছু শিল্প
বাজেটে জমি ও ফ্ল্যাট বিক্রির গেইন ট্যাক্স দ্বিগুণ করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। এর ফলে আবাসন খাত ও এরসঙ্গে জড়িত শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
গেইন ট্যাক্স বৃদ্ধির ফলে অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব পড়ার আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (রিহ্যাব) সভাপতি আলমগীর শামসুল আলামিন (কাজল)।
বাজেটের পর এক প্রতিক্রিয়ায় তিনি বলেন, "নির্মাণ সামগ্রীর দাম বৃদ্ধিসহ অন্যান্য কারণে এমনিতেই জমি ও ফ্ল্যাটের দাম বেড়েছে। এই মুহূর্তে নতুন করে কর বৃদ্ধি দেশের অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব ফেলবে বলে আমাদের শঙ্কা।"
তবে প্লাস্টিকের তৈজসপত্র, হাইজেনিক ও টয়লেটট্রিজ, কিচেনে ব্যবহার হওয়া পণ্য অ্যালুমিনিয়ামের তৈরি তৈজসপত্র, স্যানিটারিওয়্যার, সানগ্লাস, সিমেন্ট, মোবাইল ফোনের ভ্যাট হার কিছুটা বেড়ে যাওয়ায় (৫ শতাংশ থেকে ৭.৫ শতাংশ) এসব পণ্যের দাম বেড়ে যাবে।
সিমেন্টের কাঁমামাল আমদানির শুল্ক বেড়ে যাওয়ায় প্রতি ব্যাগ সিমেন্টে দাম ফের ১৫ টাকা করে বেড়ে যাবে বলে এক প্রতিক্রিয়ায় জানিয়েছে বাংলাদেশ সিমেন্ট ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিসিএমএ)।
বাজেটের পর সংগঠনটির পক্ষ থেকে বলা হয়, "এমনিতেই ডলার সংকটের কারণে সিমন্টে ক্লিংকার আমদানি কমে গেছে স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় অর্ধেকের বেশি। এমন সংকটকালীন সময়ে কাঁচামালে বাড়তি শুল্ক আরোপ এই সেক্টরকে আরো সংকটে ফেলে দেবে।"
বিসিএমএ'র ভাইস প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ টিবিএসকে বলেন, "আমাদের শিল্পকে সুরক্ষা দেওয়ার কিছু নেই। কারণ এটি সাধারণত আমদানি করা হয় না; বরং শুল্ককর কমিয়ে রাখলে শিল্প ও ভোক্তার জন্য তা সুবিধাজনক হবে।"
তিনি বলেন, "দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ১২টি দেশে সিমেন্টের উৎপাদন ও বিপণন পর্যায়ে আমাদের মত এত বেশি কর কোনো দেশে নেই।"
বার্জার পেইন্টস বাংলাদেশ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রূপালী চৌধুরী, টিবিএসকে বলেন, "এটি কর বাড়ানোর সঠিক সময় নয়, কারণ বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে প্রায় প্রতিটি ব্যবসাই এখন খুব কঠিন সময় পার করছে এবং ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে।"