স্থানীয় শিল্পকে শক্তিশালী করতে কর ছাড়ের সুবিধা পর্যালোচনা করবে এনবিআর
দেশেই উৎপাদন হয় এমন মধ্যবর্তী কাঁচামাল ও যন্ত্রপাতি আমদানিতে দেওয়া শুল্ক ও কর অব্যাহতির সুবিধা পর্যালোচনা এবং সম্ভবত তা কমানোর পরিকল্পনা করছে সরকার। দেশজ প্রস্তুতকারক খাত ও ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ শিল্পকে শক্তিশালী করতেই এ পদক্ষেপ বলে জানা গেছে।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলেছেন, স্থানীয় কোম্পানিগুলোর সংযোজিত, কিন্তু উৎপাদিত নয় – এমন পণ্যের ক্ষেত্রেও মূল্য সংযোজন কর (মূসক বা ভ্যাট) এবং শুল্ক সুবিধা কমাতে একটি নীতিমালা তৈরি করছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)।
রাজস্ব কর্মকর্তারা বলেন, এ ধরনের আর্থিক সুবিধা হ্রাস স্থানীয় প্রস্তুতকারক খাতকে শক্তিশালী করে আমদানি-নির্ভরতা কমাবে; যা দেশের বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের ওপরও চাপ কমাবে।
এর আগে রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান আবু হেনা মো.রহমাতুল মুনিম বলেছিলেন, স্থানীয়ভাবে উৎপাদন করা যায় এমন পণ্য আমদানিতে দেয়া কর অব্যাহতির সুবিধা হ্রাস করা হবে, এরপরেই এনবিআরের এ পদক্ষেপের কথা জানা গেল।
কয়েকজন রাজস্ব ও আবগারী (কাস্টমস) কর্মকর্তা জানান, এতে খাত-ভিত্তিক বিভিন্ন শিল্পকে শুল্ক ছাড় বাবদ দেওয়া কর অব্যাহতি সাশ্রয় করতে পারবে রাজস্ব কর্তৃপক্ষটি।
চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন, ২০২২-২৩ অর্থবছরে কর অব্যাহতির পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৭৮ হাজার কোটি টাকার বেশি। এর মধ্যে তথ্যপ্রযুক্তি, পোশাক ও টেক্সটাইল, অর্থনৈতিক অঞ্চলসমূহ ও হাইটেক শিল্পের জন্য সম্মিলিত কর অব্যাহতির পরিমাণ প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা।
মূলত 'মেইড ইন বাংলাদেশ' উদ্যোগের অংশ হিসেবে দুই বছর আগে স্থানীয় শিল্পের জন্য কিছু সুবিধা বাড়ায় এনবিআর।
আগামী বাজেটে বা তার আগেই নতুন কর নীতিমালা প্রকাশ করা হতে পারে। এজন্য খাত-ভিত্তিক পণ্য ও সেবার শ্রেণিকরণ করে দেশের উৎপাদন সক্ষমতা ও মান যাচাই করবে এনবিআর।
এর আওতায়, কাঁচামাল আমদানির কর রেয়াত সুবিধা পাওয়ার জন্য একটি নির্দিষ্ট হারে স্থানীয় মূল্য সংযোজন অর্জনের শর্ত পূরণ করতে হতে পারে স্থানীয় কোম্পানিগুলোকে।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, বেশ দেরীতে নেওয়া হলেও এটি একটি সঠিক পদক্ষেপ, যা আমদানি-নির্ভরশীলতা কমিয়ে স্থানীয় শিল্পকে শক্তিশালী করার অঙ্গীকার তুলে ধরছে।
নাম না প্রকাশের শর্তে রাজস্ব বোর্ডের একজন ঊধর্বতন কর্মকর্তা দ্য বিজনেস স্টান্ডার্ডকে (টিবিএস) বলেন, অনৈতিক কর সুবিধা নেয়– এমন একটি প্রতিষ্ঠানের অডিট রিপোর্টের ভিত্তিতে, চলতি অক্টোবর মাসের প্রথম সপ্তাহে এনবিআরের কাস্টমস এক্সেম্পশন বিভাগ কর অব্যাহতিতে কড়াকড়ি আরোপের সুপারিশ করে একটি প্রতিবেদন দেয়।
কাস্টমস এক্সেম্পশন বিভাগ প্রতিবেদনে- উৎপাদন বা সংযোজনকারী প্রতিষ্ঠানের গুরুত্ব অনুযায়ী– পণ্য আমদানিতে কর ছাড় পাওয়ার যোগ্যতা হিসেবে তাদের জন্য মূল্য সংযোজন হার নির্ধারণ করে দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছে'- বলেন তিনি।
ওই কর্মকর্তা বলেন, 'কোন প্রতিষ্ঠান বছরের পর বছর কেবল অ্যাসেম্বলিং (সংযোজন) করেই ম্যানুফ্যাকচারার (উৎপাদনকারী) হিসেবে কর অব্যাহতি বা হ্রাসকৃত হারের সুবিধা নেবে – তা যৌক্তিক বা বৈধ নয়। আবার স্থানীয়ভাবে পাওয়া যায় এমন পণ্য আমদানিতে কর সুবিধা দিলে, স্থানীয় পর্যায়ে ব্যাকওয়ার্ড-লিঙ্কেজ শিল্প গড়ে উঠবে না।'
দেশের শিল্প উদ্যোক্তারা বলছেন, বর্তমানে পোশাক ও টেক্সটাইল খাতসহ বেজা, বেপজা ও এর বাইরের শিল্প প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন ধরণের পণ্য আমদানিতে কর ও শুল্ক অব্যাহতি পেয়ে আসছে। মোবাইল ফোন, হাইটেক পণ্য, ফ্রিজ, এসি, মোটরসাইকেল, মোটরগাড়িসহ বিভিন্ন ইলেকট্রনিক্স পণ্যের কাঁচামাল আমদানিতে শুল্ক সুবিধা পান উদ্যোক্তারা। গামেন্টস শিল্পের মধ্যবর্তী কাঁচামাল ও মূলধনী যন্ত্রপাতি, রড-সিমেন্টসহ ভারি শিল্পের কাঁচামাল আমদানিতেও মেলে এ বিশেষ সুবিধা।
অনেক আগে থেকে এসব সুবিধায় আমদানি হলেও, বর্তমানে স্থানীয় পর্যায়েও কিছু শিল্প গড়ে উঠেছে। তবে তাদের অসম প্রতিযোগীতার মুখোমুখি হতে হয়, বলে জানান তারা।
বাংলাদেশের প্রকৌশল শিল্প মালিক সমিতির সভাপতি মো. আব্দুর রাজ্জাক বলেন, 'ইলেকট্রিক মোটর, ফ্যান, কেবলস, সকেটসহ ইলেকট্রিক প্রায় সব পণ্য এবং মোটরগাড়ির যন্ত্রাংশের বহু কিছু এখন দেশে উৎপাদন হয়। উৎপাদিত এসব পণ্যে ভ্যাট ও উৎস করসহ ১৮ থেকে ৪৮ শতাংশ পর্যন্ত কর দিতে হয়। এর বিপরীতে, বড় শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো মূলধনী যন্ত্রপাতি হিসেবে এসব পণ্য ১ থেকে ১০ শতাংশ শুল্ক দিয়ে নিয়ে আসে। ফলে স্থানীয় ব্যাকওয়ার্ড- লিংকেজ শিল্প (প্রতিযোগিতায়) টিকতে পারছে না।'
আমদানি সীমিত হলে তা স্থানীয় শিল্পের জন্য সুফল নিয়ে আসবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
আমদানি হ্রাস বর্তমানে জরুরি কেন
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, আগের অর্থবছরের তুলনায়– ২০২২-২৩ অর্থবছরে দেশের আমদানি ব্যয় ১৬ শতাংশ কমে দাঁড়ায় ৭৫.০৬ বিলিয়ন ডলারে। এই হ্রাসের পরেও অব্যাহত ডলার সংকটের কারণে দেশের বৈদেশিক মুদ্রাবাজারের অস্থিতিশীলতা কাটেনি।
এই অতি-নির্ভরশীলতা বড় নেতিবাচক ভূমিকা রাখে টাকার বিনিময় দর পতনে। গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর টাকার ৩৫ শতাংশ অবমুল্যায়ন হয়েছে।
একইসময়, এক দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতির কবলে পড়ে বাংলাদেশ। বিশ্ববাজারে পণ্যদ্রব্যের দরবৃদ্ধি এবং মার্কিন ডলারের বিপরীতে টাকার দরপতন মূল্যস্ফীতিকে উস্কে দেয় এবং দেশের অর্থনীতিকে বড় চ্যালেঞ্জের মধ্যে ফেলে।
অর্থনীতির জটিল এই পরিস্থিতিতে আমদানি-নির্ভরতা কমানোর নানান পদক্ষেপ নিচ্ছে বাংলাদেশ।
কর ছাড়ের চিত্র
এনবিআরের তথ্যমতে, গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে সরকার মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানিতে যে শুল্ক অব্যাহতি দিয়েছে, তার পরিমাণ প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা। এরমধ্যে মোবাইল প্রস্তুতকারক শিল্পকে ২ হাজার ২৪১ কোটি টাকা, ফ্রিজ ও এসি প্রস্তুতকারকদের প্রায় ৫ হাজার ৭০০ কোটি টাকা, টেক্সটাইল খাতে প্রায় ১ হাজার কোটি টাকা, এবং বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা)-র আওতায় থাকা শিল্প প্রতিষ্ঠানকে প্রায় ১,১০০ কোটি টাকা শুল্ক অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।
এ ছাড়া ঢাকার বাইরে অর্থনৈতিক অঞ্চল ও ইপিজেডে শিল্প স্থাপন এবং বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে উদ্যোক্তাদের আয়কর ও ভ্যাটেও বড় ছাড় দেয়া হয়েছে।
দেশের প্রস্তুতকারক শিল্পগুলো কী পরিমাণ ভ্যাট ছাড় পাচ্ছে, তার সুনির্দিষ্ট হিসাব নেই। তবে এনবিআরের একটি প্রাথমিক হিসাবে, ২০২০-২১ অর্থবছরে প্রায় দেড় লাখ কোটি টাকার সমপরিমাণ ভ্যাট ছাড় দেয়া হয়েছে বলে উল্লেখ করেছে সংস্থাটি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, স্থানীয় পণ্য বা কাঁচামাল ব্যবহারের মাধ্যমে মূল্য সংযোজন হার বেশি থাকা উৎপাদকদের কর সুবিধাও বেশি দেওয়া উচিত।
এনবিআরের সাবেক সদস্য (কাস্টমস নীতি) মো. ফরিদ উদ্দিন টিবিএস'কে বলেন, 'শক্তিশালী স্থানীয় উৎপাদন ও ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ ইন্ডাস্ট্রি করতে হলে – যারা বেশি স্থানীয় মূল্য সংযোজন করবে, তাদেরকে বেশি কর সুবিধা দিতে হবে। যারা কম করবে, তাদেরকে এ সুবিধা কম দিতে হবে। '
তিনি বলেন, 'বাংলাদেশে কোন কোন কোম্পানিকে অস্বাভাবিক কর অব্যাহতির সুবিধা দেওয়া হয়েছে, যাতে বৈষম্য তৈরি হয়েছে। চীন, কোরিয়া, জাপান আর ইন্ডিয়া উৎপাদন কেন্দ্র হয়েছে। আমরা কেবল অ্যাসেম্বলিং করে খুব বেশি দূর এগুতে পারবো না।'
উদাহরণ তুলে ধরে তিনি বলেন, ১৯৮০'র দশকে দেশে গ্যালভানাইজড প্লেইন (জিপি) শিট পুরোপুরি আমদানি-নির্ভর ছিল। অথচ এখন দেশে জিপি শিটের কাঁচামাল কোল্ড-রোলড (সিআর) কয়েল শিটও উৎপাদন হচ্ছে।
মানসম্মত কাঁচামাল বা উপকরণের জোগান কী ব্যাহত হতে পারে?
বর্তমানে মোবাইল ফোন শিল্পের জন্য ন্যূনতম মূল্য সংযোজনের বাধ্যবাধকতা ২০ শতাংশ, এবং ফ্রিজ-এসি প্রস্তুতকারকদের ক্ষেত্রে ন্যূনতম হার ৩০ শতাংশ। মোটরগাড়িসহ অন্য কয়েকটি শিল্পেও এ শর্ত রয়েছে। এনবিআর নতুন করে নীতিমালা করলে মূল্য সংযোজন হার আরো বাড়বে।
খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এতে উন্নত কাঁচামাল ও যন্ত্রপাতি আমদানি ব্যাহত হয়ে হাইটেক-সহ কিছু শিল্পে অসুবিধা তৈরি হতে পারে। তাই আমদানি সীমিত করার এ ধরনের পদক্ষেপ বাস্তবায়নের আগে সম্ভাব্য সুবিধা-অসুবিধা খতিয়ে দেখার আহ্বান জানান তারা।
ফেয়ার গ্রুপের প্রধান বিপণন কর্মকর্তা মেসবাহ উদ্দিন উদ্দিন বলেন, 'রেফ্রিজারেটরের কিছু ফুড গ্রেডেড উপকরণ রয়েছে, যা স্থানীয় প্রতিষ্ঠানগুলো মানসম্মতভাবে তৈরি করতে পারে না। এজন্য আমদানি করতে হয়। আবার স্যামসাং যে মনিটর ও ডিসপ্লে ব্যবহার করে তা বর্তমানে স্থানীয় উৎপাদন হয় না। এই অবস্থায়, আমদানি সীমিত করলে উচ্চ-মানের পণ্যের সংকট দেখা দেবে।'
এই ধরনের উদ্যোগ স্থানীয় ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ শিল্পকে সাহায্য করতে পারে, তবে একইসঙ্গে একারণে উৎপাদনকারীদের বাধ্য হয়ে মানহীন পণ্য বা যন্ত্রাংশ কিনতে হতে পারে।
ওয়ালটন হাইটেক ইন্ডাস্ট্রিজ পিএলসি'র অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক এস এম শোয়েব হোসেন নোবেল বলেন, প্রস্তুতকারক, সংযোজনকারী ও আমদানিকারকদের মধ্যে মূল্য সংযোজনের ভিত্তিতে শুল্ক সুবিধার ক্ষেত্রে বড় ধরনের পার্থক্য রাখতে হবে। এ ছাড়া এ বিষয়ে নীতিমালা প্রণয়ণে অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনা করতে হবে এবং তাদের মতামতকে গুরুত্ব দিতে হবে।