বগুড়া-সিরাজগঞ্জ রেললাইন: দূরত্ব কমবে ১১২ কিলোমিটার, সহজ হবে ব্যবসা কার্যক্রম
দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর বগুড়া-সিরাজগঞ্জ প্রকল্পের মাধ্যমে ঘুচতে যাচ্ছে উত্তরের মানুষের দীর্ঘদিনের বঞ্চনার গল্প। এ প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে রাজধানীর সাথে বগুড়ার রেলপথের দূরত্ব যেমন কমবে, তেমনি ব্যবসা কার্যক্রম সহজ হবে।
প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে রাজধানীর সাথে বগুড়ার রেলপথের দূরত্ব কমবে ১১২ কিলোমিটার; সময় বাঁচবে ৩ থেকে ৪ ঘণ্টা। গতিপথ প্রসারিত হবে উত্তরের অর্থনীতিও।
এছাড়া, বছরে আন্তঃনগরের দুটি ট্রেনে জ্বালানি সাশ্রয় হবে প্রায় ৪ কোটি ৩৩ লাখ টাকার উপরে।
পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের সিনিয়র সাব এসিস্ট্যান্ট প্রকৌশলী (লোকো) মো. কাজী সুমন বলেন, বর্তমানে বগুড়ার উপর দিয়ে রংপুর ও লালমনি এক্সপ্রেস সরাসরি ঢাকাতে চলাচল করে। ১৪ বগির লালমনিহাট ট্রেন চলাচল করতে প্রতি কিলোমিটারে ২ দশমিক ১৫ লিটার ডিজেল লাগে।
"এই হিসেবে বগুড়া থেকে ঢাকায় চলাচলে ট্রেনের রাস্তা ১১২ কিলোমিটার কমলে একটি ট্রেনের বছরে প্রায় সোয়া ২ কোটি টাকার জ্বালানি (প্রতি লিটার ডিজেল ১২৫ টাকা ধরে) খরচ কমবে। তাহলে দুটি ট্রেনে খরচ কমবে অন্তত ৪ কোটি ৩৩ লাখ টাকার উপরে," বলেন তিনি।
আগামী বছরের শুরুতে রেল লাইন নির্মাণের ফিজিক্যাল ইমপ্লিমেন্টশন শুরু হবে।
বর্তমানে বগুড়া থেকে থেকে ঢাকার ট্রেন যায় সান্তাহার জংশয় হয়ে নাটোর। এরপর পাবনার ঈশ্বরদী ঘুরে সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া হয়ে বঙ্গবন্ধু সেতুতে উঠতে হয়। একইপথে রংপুর বিভাগের গাইবান্ধা, কুড়িগ্রাম বা রংপুরের ট্রেনও চলে। এতে উত্তরাঞ্চলের ট্রেনগুলোকে যাত্রী ও কৃষিপণ্য নিয়ে ঢাকায় পৌঁছতে পড়তে হয় ভোগান্তিতে।
শুধু বগুড়া রেলওয়ে স্টেশন থেকেই তিনটি জেলা ঘুরে বঙ্গবন্ধু সেতুতে পৌঁছতে ৩ থেকে ৪ ঘণ্টা সময় লাগে। আর প্রায় ৩২৪ কিলোমিটার পথে ঢাকায় যেতে লাগে প্রায় ৮ থেকে ৯ ঘণ্টা।
সড়কে গেলে এটি ২০০ কিলোমিটারের পথ। সময় লাগে ৫ থেকে ৬ ঘণ্টা।
অথচ বগুড়া থেকে সিরাজগঞ্জের বঙ্গবন্ধু সেতুতে সরাসরি ট্রেনযোগে পৌঁছতে সময় লাগবে এক থেকে সোয়া ঘণ্টা।
বগুড়া রেলওয়ে স্টেশন সূত্র বলছে, বগুড়া থেকে সরাসরি বঙ্গবন্ধু সেতুতে ট্রেন সার্ভিস চালু হলে বগুড়াসহ উত্তরের জেলার ট্রেন যাত্রীদের ১১২ কিলোমিটার পথ কমে আসবে।
এছাড়া সড়কপথ হয়ে বগুড়া, জয়পুরহাট, নওগাঁ, গাইবান্ধা, রংপুর, নীলফামারী, ঠাকুরগাঁও, দিনাজপুর, পঞ্চগড়, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম জেলার ঢাকাগামীরা যাতায়াত করে। এ কারণে সড়ক ও রেলপথে সবসময় যানজট লেগেই থাকে। এ দুর্ভোগ থেকে রেহাই পেতে বগুড়া ও সিরাজগঞ্জসহ উত্তরের বাসিন্দারা রেলপথ নির্মাণের দাবি তোলেন।
রেলওয়ে সূত্র বলছে, ২০০৫ সালে এই রেলপথ নির্মাণের পরিকল্পনা করা হয়। এশিয়া উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) অর্থায়নে তখন প্রাক-সমীক্ষাও হয়েছিল। কিন্তু অর্থায়ন না হওয়ায় প্রকল্পটি এগোয়নি।
পরে ২০১৫ সালে বগুড়ার এক জনসভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধু সেতু থেকে বগুড়া হয়ে রংপুর পর্যন্ত রেললাইন নির্মাণের প্রতিশ্রুতি দেন।
২০১৭ সালে ভারতের তৃতীয় লাইন অফ ক্রেডিটের (এলওসি) ঋণে প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়। ফলে সিরাজগঞ্জের শহীদ এম মনসুর আলী স্টেশন থেকে বগুড়ার রানিরহাট রুটে সরাসরি রেল সংযোগ নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
বগুড়া স্টেশন থেকে শহীদ এম মনসুর আলী স্টেশনের মধ্যকার রুটের দৈর্ঘ্য হবে প্রায় ৭৫ কিলোমিটার।
এছাড়া রানিরহাট স্টেশন থেকে কাহালু স্টেশনের মধ্যকার রুটে ১১ দশমিক ৫ কিলোমিটার রেললাইন নির্মাণ হবে।
রেলওয়ে বলছে, রেল লাইন ছাড়াও ১৬ কিলোমিটার লুপ লাইন এবং বগুড়া থেকে সিরাজগঞ্জ পর্যন্ত নির্মাণ হবে নতুন আটটি রেলস্টেশন। এগুলো হলো, কাহালু, রানীরহাট, আড়িয়াবাজার, শেরপুর, চান্দাইকোনা, রায়গঞ্জ, কৃষাণদিয়া ও সদানন্দপুর।
এ প্রকল্পে বগুড়া-সিরাজগঞ্জ রেলপথের সাথে কাহালু স্টেশন থেকে শান্তাহারকেও যুক্ত করার পরিকল্পনা রয়েছে।
রেলপথ মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, বগুড়া-সিরাজগঞ্জ নতুন ডুয়েল গেজ রেলপথ নির্মাণ প্রকল্পে ব্যয় হবে ৫ হাজার ৫৮০ কোটি টাকা।
এতে ভারতীয় ঋণ পাওয়া যাবে ৩ হাজার ১৪৬ কোটি টাকা। বাকি ২ হাজার ৪৩৩ কোটি টাকা বাংলাদেশ সরকারের।
২০১৮ সালের জুলাইয়ে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটিতে (একনেক) অনুমোদন পাওয়া এ প্রকল্প ২০২৩ সালের জুনের মধ্যে শেষ হবার কথা। কিন্তু কাজের দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি হয়নি।
এই প্রকল্পে দুই ভাগে কাজ করবে ভারতের দুটি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান রাইটস লিমিটেড ও আরভি অ্যাসোসিয়েটস আর্কিটেক্টস ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড কনসালট্যান্ট প্রাইভেট লিমিটেড।
প্রথম ধাপে হবে সম্ভাব্যতা সমীক্ষা হালনাগাদ করা, বিস্তারিত নকশা তৈরির কাজ। দ্বিতীয় ধাপে নির্মাণকাজ তদারক করবে প্রতিষ্ঠান দুটি। গত বছরের সেপ্টেম্বরে এই বিষয়ে চুক্তি হয়। প্রকল্পের জন্য ৯৬০ একর জমি অধিগ্রহণ করতে হবে।
দুটি ধাপে এগিয়ে চলা এই রেললাইনের কাজের প্রথম পর্ব শেষের দিকে বলে জানিয়েছেন বগুড়া-সিরাজগঞ্জ নতুন ডুয়েলগেজ রেলপথ নির্মাণ প্রকল্প কর্মকর্তা মনিরুল ইসলাম ফিরোজী।
এই কর্মকর্তা জানান, "প্রথম পার্ট ডিটেইল ডিজাইন, টেন্ডারিং প্রসেস। এই অংশের কাজ শেষের দিকে। দ্বিতীয় ধাপের কাজ হলেও অধিগ্রহণ কাজ এগিয়ে নেওয়া হয়েছে।"
ইতোমধ্যে এই প্রকল্পের কাজ এক বছর বাড়ানোর প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে বলে জানান তিনি।
"জমি অধিগ্রহণের অনাপত্তির জন্য দুই জেলা প্রশাসককে চিঠি দেওয়া হয়েছে। তবে প্রকল্প ফিজিক্যাল ইমপ্লিমেনটেশনের জন্য এক বছর সময় লাগবে," বলেন তিনি।
গুরুত্ব বিবেচনায় নিয়ে প্রকল্পের জন্য প্রয়োজনীয় জমি অধিগ্রহণ করে এই প্রকল্প দ্রুত সম্পূর্ণ করা উচিত বলে মনে করে বগুড়ার সুশাসনের জন্য নাগরিক কমিটির সদস্য তাহমিনা পারভীন শ্যামলী।
তিনি বলেন, "উত্তরাঞ্চলের মধ্যে সবচেয়ে বেশি শিল্পকারখানা, পর্যটন খাত, আবাসন ব্যবসা, কর্মসংস্থান সৃষ্টি রয়েছে বগুড়ায়। বিভিন্ন কারণে এই জেলার অনেক গুরুত্ব রয়েছে জাতীয় অর্থনীতিতেও। সবগুলো বিষয় বিবেচনায় নিয়ে বগুড়া-সিরাজগঞ্জ রেলপথ দ্রুত নির্মাণ করা উচিত। এই রেলপথ হলে বগুড়ায় উৎপাদিত অনেক পণ্য ঢাকায় আনা নেওয়ায় সুবিধা হবে।"
রংপুর, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট ও গাইবান্ধা মানুষ ট্রেনযোগে ঢাকায় চলাচল করেন। এই পথে ট্রেন চালু হলে তারাও উপকৃত হবেন সমানতালে।
গাইবান্ধার বাসিন্দা সাগর হোসেন বলেন, "বগুড়া-সিরাজগঞ্জ রেলপথ নির্মাণ হলে সময় সাশ্রয় হবে, ভোগান্তি কমবে আমাদের। কৃষক তার উৎপাদিত শাক সবজি ঢাকায় বিক্রি করতে পারবে। রেলপথের পাশাপাশি উত্তরে রেল সংখ্যা বাড়ালে এর সুফল পাবে দেশের জনগণ।"
জানতে চাইলে বগুড়া চেম্বার অব কমার্সের সহসভাপতি মাহফুজুল ইসলাম রাজ বলেন, "বগুড়া-সিরাজগঞ্জ রেলপথের দাবি দীর্ঘদিনের। এই রেলপথ চালু হলে এ অঞ্চলের ব্যবসা-বাণিজ্যে নতুন দুয়ার উম্মোচিত হবে। বিনিয়োগ বাড়বে উত্তরাঞ্চলে। সবজি ভাণ্ডার বগুড়ায় নতুন প্রাণের সঞ্চার ঘটবে। কর্মসংস্থান বাড়বে হাজার হাজার মানুষের। অর্থনীতির চাকা আরও সচল হবে।"
বগুড়া কিংবা এই অঞ্চলের মানুষ রেলপথ নির্মাণের তাদের জমি সরকারকে দিতে প্রস্তুত বলে উল্লেখ করেন তিনি।
বগুড়া জেলা প্রশাসক মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, "এটি জাতীয় প্রকল্প। প্রকল্পের পক্ষ থেকে জমি অধিগ্রহণের প্রশাসনিক অনুমোদন পেয়েছে। আমাদের কাছে তারা জমি অধিগ্রহণের জন্য ছাড়পত্র চেয়েছে। আমরা পরিবেশ অধিদপ্তর, ফায়ার সার্ভিসসহ অন্যান্য দপ্তরের সাথে কথা বলে অনাপত্তি দিব।"