পানির লবণাক্ততার সমস্যা সমাধানে ৪০০ মিলিয়ন ডলারের প্রকল্প নিচ্ছে চট্টগ্রামে ওয়াসা
গেল গ্রীষ্মে চট্টগ্রামে সুপেয় পানির সংকট প্রকট হয়। সমুদ্র উপকূলীয় শহরের পানির লবণাক্ততা বাড়ায় সুপেয় পানি উৎপাদনে বেগ পেতে হয় চট্টগ্রাম ওয়াসাকে। বৃষ্টিপাতের অভাবে পানির উৎস কর্ণফুলী ও হালদা নদীতে লবণাক্ততা বেড়ে যায়। ফলে কঠিন পরিস্থিতির মুখে পড়তে হয় সংশ্লিষ্টদের। এ সমস্যা সমাধানে প্রায় ৪০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ব্যয়ে নতুন প্রকল্প নিতে যাচ্ছে চট্টগ্রাম ওয়াসা কর্তৃপক্ষ। এতে অর্থায়নে আগ্রহী দুই দাতা সংস্থাও রয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
প্রকল্পটি বাস্তবায়নে দুটি আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থা—ইকোনমিক ডেভেলপমেন্ট কোঅপারেশন ফান্ড (ইডিসিএফ) ও জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থা (জাইকা)—আগ্রহী বলে জানিয়েছেন কর্মকর্তারা।
ফ্রান্সভিত্তিক পরামর্শক সংস্থা সুয়েজ 'চট্টগ্রাম ওয়াসা ইম্প্রুভমেন্ট প্রজেক্ট (সিডব্লিইউআইপি)' শীর্ষক ধারণাপত্র দিয়েছে।
ধারণাপত্রে কর্ণফুলী নদীর উপরিভাগ থেকে পানি সংগ্রহের জন্য ইনটেক স্টেশন নির্মাণ, পাইপলাইন, নতুন পানি শোধনাগার নির্মাণের সুপারিশ করা হয়েছে।
চট্টগ্রাম ওয়াসার তথ্যমতে, সাধারণত বছরের ১৫-২০ দিন লবণাক্ততা নিয়ে বিপাকে পড়তে হয় সংস্থাটিকে। কিন্তু চলতি বছর বৃষ্টিপাত কম হওয়ার পাশাপাশি কাপ্তাইয়ের কর্ণফুলী পানিবিদ্যুৎকেন্দ্রের পানি নির্গমনের প্রবাহ কম থাকায় লবণাক্ততা প্রায় ৩ মাস স্থায়ী হয়।
চট্টগ্রাম ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী এ কে এম ফজলুল্লাহ দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সংকট তৈরি হচ্ছে। এখনই ব্যবস্থা নিতে হবে। ১০ বছর পর তা আরও বাড়তে পারে।
'ধারণাপত্র নিয়ে আমরা দাতা সংস্থার সঙ্গে আলোচনা করছি। তারাও সেটি পর্যালোচনা করছে।'
কী আছে পরিকল্পনায়?
চট্টগ্রাম ওয়াসার কর্মকর্তারা জানান, লবণাক্ত-সংক্রান্ত সমস্যা সমাধানের জন্য সুয়েজের ধারণাপত্রে বিকল্প ইনটেক স্টেশন ও নতুন পানি শোধনাগার নির্মাণের সুপারিশ করা হয়েছে।
পানির ভবিষ্যৎ চাহিদা মাথায় রেখে তিন অংশে অবকাঠামো নির্মাণের সুপারিশ করা হয়েছে ধারণাপত্রে।
ধারণাপত্রের প্রথম অংশে ভান্ডালজুড়িতে দৈনিক ৮৪ কোটি লিটার অপরিশোধিত পানি সংগ্রহের জন্য ইনটেক স্টেশন নির্মাণ ও প্রি-সেটেলমেন্ট রিজার্ভার নির্মাণের পরিকল্পনা দেওয়া হয়েছে।
একটি ইনটেক স্টেশন এমন একটি অবকাঠামো যা নদী বা হ্রদের মতো উৎস থেকে পানি তুলে নিয়ে তা পানি শোধনাগার বা বিতরণ ব্যবস্থায় পৌঁছে দেয়।
এছাড়া দৈনিক ৬৩ কোটি লিটার সক্ষমতার পানির পাম্প স্টেশন স্থাপনের সুপারিশও করা হয়েছে ধারণাপত্রে।
এছাড়া ভান্ডালজুড়ি থেকে মোহরা ও মদুনাঘাট পানি শোধনাগার পর্যন্ত দৈনিক ৪২ কোটি লিটার সক্ষমতার রিভার ক্রসিং পাইপলাইন (কর্ণফুলী ও হালদা নদীর তলদেশে), মোহরায় দৈনিক ২০ কোটি লিটার সক্ষমতার নতুন পানি শোধনাগার, সেবার পরিধি বাড়াতে মোহরা থেকে বায়েজিদ লিংক রোড় পর্যন্ত পাইপলাইন ও রিজার্ভার এবং সরবরাহের জন্য পাইপলাইন স্থাপনের সুপারিশ করা হয়েছে ধারণাপত্রে।
এছাড়া মোহরা পানি শোধনাগারে ব্যবহারোপযোগী জমি থাকায় নতুন পরিকল্পনার দ্বিতীয় ও তৃতীয় অংশে আরও দুটি নতুন শোধনাগার নির্মাণের সুপারিশ করা হয়েছে।
চট্টগ্রাম ওয়াসার প্রধান প্রকৌশলী মাকসুদ আলম বলেন, ধারণাপত্রের আলোকে প্রিলিমিনারি ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট প্রপোজাল (পিডিপিপি) প্রণয়নের কাজ চলছে।
'চলতি মাসেই এই পিডিপিপি অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগে (ইআরডি) পাঠানো হবে। এরপর দাতা সংস্থার পর্যালোচনা ও সাম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কাজ শুরু হবে,' বলেন তিনি।
তিনি বলেন, বর্তমান বিশ্বে লবণাক্ততা দূরীকরণে রিভার্স অসমোসিস পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়, যা ব্যয় বহুল।
বছরে মাত্র ২-৩ মাস সময়ের জন্য ব্যয়বহুল পানি শোধনাগার প্রয়োজন নেই উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'অপরিশোধিত পানি সংগ্রহের ইনটেক পয়েন্ট সরিয়ে নিলে সমাধান হবে।'
লবণাক্ততা সংকট
১৯৯৪ সাল থেকে চট্টগ্রাম নগরবাসী প্রায় প্রতি বছরই লবণাক্ততার সমস্যায় ভুগছে। শুষ্ক মৌসুমে যখন উজান থেকে পর্যাপ্ত পানি পায় না, নদী তখন বঙ্গোপসাগর থেকে লবণাক্ত পানি টেনে ঘাটতি পূরণ করে।
কিন্তু চলতি বছরের মার্চে হালদা নদীর পানিতে অতিরিক্ত লবণাক্ততার ফলে চট্টগ্রাম সিটিজি ওয়াসাকে তাদের মোহরা পানি শোধনাগারের কার্যক্রম প্রতিদিন একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য বন্ধ রাখতে বাধ্য হয়, যার ফলে নগরবাসীর জন্য পানি সরবরাহ হ্রাস পায়।
চট্টগ্রাম ওয়াসার কর্মকর্তারা জানান, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি ও উজান থেকে পানি প্রবাহ কমে যাওয়ায় লবণমিশ্রিত জোয়ারের পানি হালদা নদীতে প্রবেশ করছে।
বর্তমানে চট্টগ্রাম ওয়াসা চারটি শোধনাগারের অপরিশোধিত পানি সংগ্রহ করে তিনটি ইনটেক স্টেশন থেকে।
এরমধ্যে রাঙ্গুনিয়ার ইনটেক স্টেশনের সক্ষমতা দৈনিক ৩০ কোটি লিটার, মোহরা ও মদুনাঘাটের ইনটেক স্টেশনের সক্ষমতা ৯ কোটি লিটার করে।
এছাড়া বোয়ালখালীতে চলমান ভান্ডালজুড়ি পানি সরবরাহ প্রকল্পের অধীনে দৈনিক ৬.৬ কোটি লিটার সক্ষমতার ইনটেক স্টেশন নির্মাণাধীন।
চট্টগ্রাম ওয়াসার প্রকৌশলীরা জানান, সাধারণত গ্রীষ্মকালে বৃষ্টিপাতের অভাবে এবং কাপ্তাই পানিবিদ্যুৎকেন্দ্রের পানি নির্গমনের প্রবাহ না থাকলে মোহরা ও মদুনাঘাট ইনটেক স্টেশনের লবণাক্ততায় প্রভাব পড়ে।
লবণাক্ততার স্বাভাবিক হার প্রতি ঘণ্টায় ২০০ থেকে ৩০০ মিলিগ্রাম। গ্রীষ্মে তা ১,৫০০ থেকে ১,৮০০ মিলিগ্রামে গিয়েও ঠেকে। অতি লবণাক্ত পানি শোধন অনুপযোগী থাকে।
চট্টগ্রাম ওয়াসার সক্ষমতা
বর্তমানে চট্টগ্রাম ওয়াসার দৈনিক পানি উৎপাদন সক্ষমতা প্রায় ৪৬ কোটি লিটার।
শেখ রাসেল পানি সরবরাহ প্রকল্প থেকে দৈনিক ৯ কোটি লিটার, শেখ হাসিনা পানি শোধনাগার প্রকল্প থেকে ১৪.৩ কোটি লিটার, শেখ হাসিনা পানি শোধনাগার-০২ থেকে ১৪.৩ কোটি লিটার এবং মোহরা পানি সরবরাহ প্রকল্প থেকে ৯ কোটি লিটার পানি উৎপাদন করা হয়।
চট্টগ্রাম ওয়াসার তথ্যমতে, বর্তমানে তাদের আবাসিক গ্রাহক সংযোগ ৭৮ হাজার ৫৪২টি ও বাণিজ্যিক সংযোগ ৭ হাজার ৭৬৭টি। বছরে প্রায় ৫ কোটি লিটার পানি সরবরাহের চাহিদা বাড়ছে।
ফলে দৈনিক পানির চাহিদা ২০৩২ সাল নাগাদ ৬৩ কোটি লিটার এ ২০৪২ সালে ১২২ কোটি লিটারে পৌঁছাবে।