পরিবারে শিশুর ওপর যৌন নিপীড়ন: নীরবতা ভাঙার এখনই সময়
ঠিক বুঝতে পারছি না লেখাটা কীভাবে শুরু করবো বা আদৌ বিষয়টা নিয়ে লিখবো কিনা বা লেখা উচিৎ হবে কিনা? এরকম একটি দ্বিধাদ্বন্দ্বের মধ্যে অনেকটা সময় পার করার পর মনে হলো, বর্বর এইসব ঘটনা সত্য, সমাজে ঘটছে, ঘটার সংখ্যা বাড়ছে এবং মিডিয়াতে আসছে। মানসিকভাবে বিকৃত কিছু মানুষ এমন জঘন্য আচরণ ও কাজ করছে, যাতে করে, পরিবারের ও সমাজের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও প্রিয় প্রতিষ্ঠানের চরিত্র নিয়ে কথা উঠেছে। হ্যাঁ, আমি সেইসব নোংরা অমানুষের কথা বলছি, যারা নিকট আত্মীয় সেজে পরিবারে আছে, কিন্তু এরা আসলে ধর্ষক বা যৌন নিপীড়ক। এই অমানুষগুলো কারো স্বজন নয়, এরা অপরাধী।
যে মেয়েরা ও ছেলেরা প্রিয়জন বা পরিচিতজন কারো দ্বারা যৌন নির্যাতনের শিকার হয়, এরা ভয়ে বা লজ্জায় চুপ করে থাকে এবং এইভাবে দিনের পর দিন ভয়াবহ অত্যাচার সহ্য করে। কাকে বলবে, কীভাবে বলবে, কেউ বিশ্বাস করবে কিনা এইসব ভেবে চুপ করে থাকে। কিন্তু সহ্য করতে করতে এমন একটা সময় আসে, যখন সে চরম বিপদের মুখে পড়ে যায়। সেই দায় তখন তাকে ও পরিবারকে বহন করতে হয়। অথচ শিশু-কিশোর-কিশোরীরা যদি ভয় না পেয়ে প্রথমদিকেই মুখ খোলে, তাহলে হয়তো অবস্থা এতটা বিপর্যয়কর হয় না। অপরাধী অনেক আগেই চিহ্নিত হতে পারে।
এক জরিপে অংশগ্রহণকারী শিশুদের মধ্যে শতকরা ৫৫ জন শিশু জানিয়েছে, তারা পরিবারের ভেতরেই যৌন হয়রানির শিকার হয়েছে। এটি মনে করার কোনো কারণ নেই যে, শুধু মেয়েশিশুরাই যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছে; গৃহে মেয়েশিশুর (৫০ শতাংশ) চাইতে ছেলেশিশুই (৬০ শতাংশ) বেশি যৌন হয়রানির শিকার হয়েছে। শতকরা ৮২ জন শিশু নির্যাতিত হচ্ছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। এরমধ্যে ২৪.১ শতাংশ শিশু যৌন হয়রানির শিকার হয়েছে। শুধু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বা সমাজে নয়, শিশু তার গৃহে ও কর্মক্ষেত্রেও শারীরিক, মানসিক ও যৌন নিপীড়ণের শিকার হচ্ছে। (সূত্র: "বাংলাদেশে শিশুর প্রতি সহিংসতা পরিস্থিতি" শীর্ষক এই জরিপ, জুন ২০২০ থেকে মে ২০২১ ইনসিডিন বাংলাদেশ, এমজেএফ)
তাহলে কেন শিশুরা তাদের প্রতি করা যৌন হয়রানি নিয়ে মুখ খোলে না? এ প্রসঙ্গে এই জরিপে জানতে চাওয়া হলে শতকরা ৬১.৭ জন বলেছে, লজ্জা এবং বাবা-মা ও অভিভাবকের ভয়ের কারণে তারা মুখ খোলেনি। শতকরা ৫২.৭ জন বলেছে, তারা তখন বুঝতে পারেনি যে তাদের প্রতি যৌন হয়রানি করা হচ্ছে। অপরাধী হুমকি দেওয়ার কারণে চুপ থেকেছে ৩০.১ ভাগ শিশু। যৌন অপরাধ যারা করে, তারা স্নেহ ও ভালবাসার ছদ্মাবরণে এটা করে বলে জানিয়েছে ১৬.২ ভাগ শিশু। ১৫.৬ জন শিশু বলেছে, তারা ঠিক জানেনা পরিবারের বাইরে কোথায় গিয়ে এই বিষয়ে অভিযোগ জানাতে হয়। শিশু তার বাবা-মাকে বলতে না পারার পেছনে আরেকটা বড় কারণ হলো হল বাবা-মায়েরা বিশ্বাস করতে চায় না।
আমরা বলি, বাইরের জগৎ শিশুর জন্য নিরাপদ নয়, বাসাই হলো শিশুর জন্য সবচেয়ে নিরাপদ জায়গা। প্রতিটি বাবা-মা তাদের সন্তানকে আগলে রাখার চেষ্টা করেন। মনে করেন, সন্তান পরিবারেই সবচাইতে ভালো আছে এবং থাকবে। বিভিন্ন জরিপ জানিয়েছে, সমাজের সবচেয়ে বড় ও নিরাপদ যে প্রতিষ্ঠান পরিবার, তা এখন আর শিশুর জন্য ততোটা নিরাপদ আশ্রয় নয়, যতোটা আমরা ধারণা করি।
৭ থেকে ১৩ বছরের শিশুরা সবচেয়ে বেশি যৌন হয়রানির শিকার হয় তার পরিবারের ভেতরে। কারণ যৌন নিপীড়নকারী ব্যক্তি এমন একটা পরিচয়কে ব্যবহার করে, শিশু এবং তার পরিবারের কাছে আসে, যেন কেউ তাকে অবিশ্বাস না করে। তারা এমন মানুষের বেশে বা কজের দায়িত্ব নিয়ে শিশুর কাছে আসে, শিশু বা শিশুর পরিবারের কাছে যাদের বিশ্বাসযোগ্যতা রয়েছে। এমনও হতে পারে যৌন হয়রানি করার আগে যৌন নিপীড়ক ব্যক্তি শিশুটিকে স্পর্শ করে করে অভ্যস্ত করে তুলতে পারে, যেন শিশু কিছু বুঝতেই না পারে যে, সে যৌন নিপীড়নের শিকার হচ্ছে। এভাবেই তারা ক্রমশ পেছনে থেকে অপরাধ চালিয়ে যেতে থাকে।
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইন্সটিটিউট ও হাসপাতালের চাইল্ড অ্যাডোলেসেন্ট অ্যান্ড ফ্যামিলি সাইকিয়াট্রি'র সহযোগী অধ্যাপক ডা: হেলাল উদ্দিন আহমেদ দীর্ঘদিন ধরে যৌন হয়রানির শিকার শিশুদের নিয়ে কাজ করছেন। আর এই কাজ করতে গিয়ে তিনি যৌন হয়রানি নিয়ে ক্লিনিক্যাল গবেষণা করেছেন। তাঁর এই গবেষণায় শিশুদের যৌন হয়রানি বিষয়ে ভয়াবহ তথ্য উঠে এসেছে। তাতে দেখা যায়, শতকরা ৭৫ ভাগ যৌন হয়রানির ঘটনাই ঘটে পরিবারের ঘনিষ্ঠজন, বন্ধু বা আত্মীয়দের মাধ্যমে।
যৌন হয়রানি হচ্ছে যেকোনোভাবে শিশুকে জোর করে যৌন কাজে লিপ্ত করা। আইন অনুযায়ী, একজন শিশু যৌন কাজ করার ক্ষেত্রে কোনোরকম সম্মতি দিতে পারে না। তাই যখন কোনো বড় মানুষ ও শিশুর মধ্যে যৌন আচরণ ঘটে, তখন ধরে নিতে হবে শিশুকে বাধ্য করা হয়েছে এই কাজে এবং এটাই যৌন হয়রানি। শতকরা ৯০ জন শিশু এবং পরিবার সেই যৌন অপরাধীকে চেনেন। কিন্তু যেহেতু সেই অপরাধী পরিবারের পরিচিত তাই সাধারণত কেউ তা স্বীকার করেন না।
অধিকাংশ ক্ষেত্রে শিশু হয়তো সেই বিষয়টি ঠিকমতো বুঝেই উঠতে পারে না। এরমধ্যে আছে ধর্ষণ, অজাচার (ইনসেস্ট), ওরাল সেক্স, পর্ণোগ্রাফি, যৌনাঙ্গে বা মলদ্বারে কোনো কিছু প্রবেশ করানো, শিশুর নগ্ন ছবি প্রদর্শন অথবা ছবি তোলা।
চিকিৎসকরা বলেন, যৌন হয়রানি হলে শিশুর ওপর দুই ধরনের প্রভাব পড়তে পারে; তাৎক্ষণিক এবং দীর্ঘস্থায়ী। যৌন নিপীড়ন শিশুর মনের মধ্যে রাগ, ভয়, অপরাধবোধ, লজ্জা তৈরি করে। শিশু খুব বেশিমাত্রায় আতংকগ্রস্ত হতে পারে, হাতাশা এবং ভুল যৌন আচরণ শিখতে পারে। শিশু নিজে ও পরিবার ঠিকমতো সচেতন না হলে যৌন হয়রানির ঘটনা একজন শিশুর জীবনে বহুবার ঘটতে পারে।
যৌন অপরাধী যে সমসময় শিশুকে স্পর্শ করবে, তা নয়। সে শিশুকে তার যৌন অঙ্গ দেখাতে পারে, বিরক্ত করতে পারে, শিশুর সামনে যৌন আচরণ করা, যেমন- মাস্টারবেশন করতে পারে, ফোনে বাজে কথা বলা, এসএমএস এ অশ্লীল বার্তা বা ছবি দিতে বা দেখতে বাধ্য করতে পারে। তাই অভিভাবক বা বাবা-মাকে সব ধরনের ট্যাবুর বাইরে এসে শিশুকে এসব বিষয়ে সচেতনতা ও সাবধানতা শিক্ষা দিতে হবে।
বাংলাদেশে পরিবারের সদস্য বা নিকট আত্মীয়দের দ্বারা শিশু নির্যাতনের ঘটনা গণমাধ্যমের খবর হতে দেখা যাচ্ছে প্রায়ই। ন্যাশনাল ট্রমা কাউন্সিল সেন্টারের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট ইশরাত শারমিন রহমান গণমাধ্যমকে বলেছেন তিনি তার দীর্ঘ অভিজ্ঞতায় দেখেছেন শিশুরা বাইরের মানুষের দ্বারা নয়, বরং পরিবারের খুব কাছের মানুষদের দ্বারা যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছে।
তিনি বলেন, "এটা অনেক দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে শিশুরা অপরিচিত ব্যক্তিদের চেয়ে বেশি নির্যাতিত হয়, পরিচিত ব্যক্তিদের দ্বারা। এক্ষেত্রে ভাই, কাজিন, চাচা, ফুফু, টিউটর, বাসার গার্ড, কেয়ারটেকার, গৃহকর্মী এরকম যেকোনো ব্যক্তির দ্বারাই নির্যাতনের শিকার হবার আশঙ্কা থাকে।"
আমরা অনেকেই মনে করি, শুধু মেয়েশিশু ও নারীরাই যৌন হয়রানি ও ধর্ষণের শিকার হয়। কিন্তু এই ধারণা একেবারে ভুল। বাংলাদেশে প্রতি চার জন মেয়েশিশুর মধ্যে একজন যৌন নিপীড়নের শিকার হয়, আর প্রতি ছয় জন ছেলেশিশুর মধ্যে যৌন নিপীড়নের শিকার হয় একজন। শুধু পুরুষ নয়, শিশুরা কখনো কখনো নারীর হাতেও যৌন হয়রানির শিকার হয়৷ পুরুষরাই প্রধানত যৌন নির্যাতনকারী হলেও, নারীদের বিরুদ্ধেও আছে যৌন হয়রানির অভিযোগ।
বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কাছের আত্মীয় ও পরিবারের সদস্যদের দ্বারা ধর্ষণ বা যৌন নিগ্রহের ঘটনাগুলো প্রকাশিত হয়না। বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির নির্বাহী পরিচালক সালমা আলী বলেছেন, প্রথমত লোকলজ্জা ও পারিবারিক বন্ধনজনিত কারণে বিষয়গুলো পরিবারের মধ্যেই মিটিয়ে ফেলার চেষ্টা করা হয়। (বিবিসি)
দু'একটি ব্যতিক্রম ছাড়া বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নিপীড়নের ঘটনা প্রকাশ করছেন তারাই, যারা পরবর্তীতে নিপীড়নজনিত কারণে শারীরিক বা মানসিক অসুস্থতায় ভুগছেন। ক্লিনিকাল সাইকোলজিস্ট ফরিদা আক্তার বলছিলেন, প্রতিমাসে তিনি এ ধরনের অন্তত তিন থেকে চারজন রোগী পান।
যৌন নিপীড়নের শিকার শিশুদের জন্য বিশেষ সেবার প্রয়োজন হয়। তারা ট্রমায় আক্রান্ত হয়ে পড়ে, এমনকি বাবাকে দেখলেও ভয় পায়। বিশেষ কোনো স্থান বা পোশাকের প্রতিও তাদের ভীতির সৃষ্টি হতে পারে। কেউ কেউ মানসিক ভারসাম্যই হারিয়ে ফেলে এবং আত্মঘাতী হয়। শিশুরা সাধারণত যৌন নিপীড়নের শিকার হলে তা প্রকাশ করতে পারে না। তবে তাদের কিছু আচরণ পর্যবেক্ষণ করলে মা-বাবা অথবা পরিবারের সদস্যরা তা বুঝতে পারেন। শিশুরা কোনো ব্যক্তিকে দেখলে ভয় পেতে পারে বা এড়িয়ে যেতে চাইতে পারে, কোনো বাসায় যেতে নাও চাইতে পারে। কোনো স্থানকে ভয় পেতে পারে বা কাউকে দেখলে লুকিয়ে থাকতে পারে। এমনও হতে পারে, কারোর কাছে আগে যেতো, কিন্তু এখন যেতে চায় না। মা-বাবাকে এসব বিষয় খেয়াল করে জানার চেষ্টা করতে হবে।
ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, ''শিশুকেও সচেতন করা যায়। কোনটা গুড টাচ, কোনটা ব্যাড টাচ তাকে তা জানাতে হবে। খেয়াল রাখতে হবে, শিশুর প্রতি পরিচিতজন কেমন আচরণ করে৷ এমন কারো কাছে শিশুকে রাখা যাবে না, যার মাধ্যমে শিশুর যৌন হয়রানির শিকার হওয়ার আশঙ্কা আছে। তার স্কুল, খেলার জায়গা, বেড়ানোর জায়গায় যেসব আশঙ্কা আছে, সেসব সম্পর্কে তাকে কৌশলে সচেতন করতে হবে।"
তাই পারিবারিক সুরক্ষা সবার আগে প্রয়োজন। শিশুকে পরিবারের কোনো বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়ের বাসা, পরিচিতদের কাছে, গৃহকর্মী বা ড্রাইভারের কাছে একা রাখা উচিত হবে না। মোট কথা, যতদূর সম্ভব শিশুকে বাবা-মায়ের তত্ত্বাবধানে ও তাদের দৃষ্টির মধ্যে রাখতে হবে। বাচ্চাদের ছোটবেলা থেকে মন খুলে কথা বলা শেখাতে হবে, তারা যখন কিছু বলবে, তখন বকাঝকা না করে বোঝার চেষ্টা করতে হবে। তাহলে যৌন নির্যাতনের মত যে ঘটনাগুলো আছে সেগুলো ভয় না পেয়ে তারা বাবা-মায়ের সাথে শেয়ার করতে পারবে।
অনেক ক্ষেত্রে মা-বাবা তথাকথিত পারিবারিক সম্মানের ভয়ে নির্যাতনকারীর (যদি পরিবারের সদস্য হন) বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নেন না। এতে সন্তানের মনে বিরূপ প্রভাব পড়ে। শিশুর ওপর যৌন নিপীড়ন নিয়ে আমাদের নীরবতা ভাঙার এখনই সময়। আমরা কি প্রস্তুত?
লেখক: যোগাযোগকর্মী