সিমলেস গার্মেন্টস: বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি শিল্পে যেভাবে বৈচিত্র্যের নেতৃত্ব দিচ্ছে উর্মি গ্রুপ
বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানি শিল্পকে বৈচিত্র্যময় করে তুলছে সিমলেস গার্মেন্টস বা সেলাইবিহীন পোশাক। আর এই বৈচিত্র্যময়তার পথকে আরও প্রশস্ত করে তুলতে প্রযুক্তি ব্যবহার করে উর্মি গ্রুপ বিশ্ববাজারে নিজেদের অংশীদারিত্ব বাড়াচ্ছে।
২০১৫ সালে কোম্পানিটির নিট কম্পোজিট ইউনিট ফখরুদ্দিন টেক্সটাইল মিলস-এ মাত্র পাঁচটি মেশিন স্থাপনের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয় দেশের প্রথম সিমলেস ইউনিট; এরপর থেকে উন্নতির পথে এগোচ্ছে কোম্পানিটি।
বর্তমানে কারখানায় মেশিনের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে ৭৮টিতে। আগামী দুই বছরের মধ্যে এই সংখ্যা ১৫০টিতে উন্নীত করার পরিকল্পনা রয়েছে কোম্পানির।
কোম্পানির কর্মকর্তারা জানান, সিমলেস প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে কোম্পানির শক্তিশালী উপস্থিতি বিশ্বে তৈরি পোশাকের বাজারে বাংলাদেশের রিব্র্যান্ডিংয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
এই প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে গতানুগতিক সেলাই ছাড়াই পোশাক তৈরি করা যায়; আলাদা আলাদা কাপড়ের টুকরো কাটা এবং তা একসঙ্গে সেলাইয়ের প্রয়োজন হয় না। এটি সাধারণত অ্যাথলিজার বা স্পোর্টসওয়্যার (ক্রীড়া পোশাক) এবং আন্ডারগার্মেন্টস (অন্তর্বাস) উত্পাদনে ব্যবহৃত হয়।
২০২২ সালে বিশ্বে অ্যাথলিজারের বাজার ৩৩০.৯৭ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়ায়; আশা করা হচ্ছে, ২০২৮ সাল নাগাদ এটি ৭৯৩.৪৬ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছাবে।
শিল্প সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, সিমলেস প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে এই বাজারের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ দখল এবং বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে বাংলাদেশের সামনে।
যেভাবে শুরু
১৯৯০ এর দশকে ইউরোপে প্রথম উদ্ভূত হয় সিমলেস প্রযুক্তি। সেখান থেকেই ধীরে ধীরে এই প্রযুক্তি বাংলাদেশসহ এশিয়ার দেশগুলোতে প্রবেশ করে।
উর্মি গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও এর সিমলেস ইউনিটের প্রতিষ্ঠাতা আসিফ আশরাফ দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানান, ইতালিতে একটি পোশাক মেলা থেকে তিনি সিমলেস প্রযুক্তির বিষয়ে অনুপ্রাণিত হন।
তিনি বলেন, "প্রত্যেক বড় ক্রেতারই সিমলেস গার্মেন্টসের জন্য আলাদা সেগমেন্ট থাকে; অথচ বাংলাদেশ বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক হওয়া সত্ত্বেও আমাদের এই প্রযুক্তির অভাব রয়েছে।"
"এরই পরিপ্রেক্ষিতে আমরা এই খাতে বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নেই। যদিও এই পদক্ষেপ আমাদের জন্য যথেষ্ট চ্যালেঞ্জিং একটি যাত্রা হিসেবে প্রমাণিত হয়; কারণ এরজন্য আমাদের বিদেশ থেকে জ্ঞান অর্জন করতে হয়েছে। এই চ্যালেঞ্জ কাটিয়ে ওঠার জন্য আমরা শ্রীলঙ্কা থেকে অভিজ্ঞ ও পারদর্শী কর্মকর্তাদের নিয়োগ দিয়েছিল," বলেন তিনি।
"এছাড়া, আমরা কিছু ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারকেও সিমলেস মেশিন অপারেটর হিসেবে নিয়োগ দিয়েছি," যোগ করেন আসিফ আশরাফ।
সিমলেস প্রযুক্তির সাহায্যে বিভিন্ন টেক্সচার ও ডিজাইনে পোশাক তৈরি করা যায়।
এছাড়া, শরীরের নির্দিষ্ট পেশী বা অঞ্চলকে লক্ষ্য করে পোশাকে বিভিন্ন কম্প্রেশন মাত্রা প্রয়োগ করা যায়; ফলে ওই পোশাক পরে যেকেউ আরও স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন।
স্ট্র্যাটেজিক বিজনেস ইউনিটের (সিমলেস) প্রধান এবং উর্মি গ্রুপের চিফ ইনোভেশন অফিসার বিমল সিলভা বলেন, পোশাকের এই সেগমেন্টটি উল্লেখযোগ্য জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে; বিশেষ করে কোভিড-১৯ মহামারির পরে, কারণ মানুষ এখন আগের তুলনায় আরও বেশি স্বাস্থ্য-সচেতন।
বাড়ছে ব্যবসা
মোটামুটি ৫টি আইটেমের পণ্যের ওপর নির্ভার করে বাংলাদেশ বিশ্বব্যাপী দ্বিতীয় বৃহত্তম পোশাক রপ্তানিকারক দেশের হিসেবে নিজের অবস্থান ধরে রেখেছে। বাংলাদেশের মোট পোশাক রপ্তানির প্রায় ৮০ শতাংশই হল শার্ট, টি-শার্ট, ট্রাউজার, জ্যাকেট এবং সোয়েটার।
উর্মি গ্রুপের পরিচালক ফাইয়াজ রহমান বলেন, গবেষণা ও উন্নয়ন, সক্ষমতা এবং দক্ষ টিমের মাধ্যমে উর্মি গ্রুপ সফলভাবে অ্যাথলিজার গার্মেন্টস উৎপাদনে শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠান হয়ে উঠেছে।
উর্মি গ্রুপের সিমলেস ইউনিটটের মাসিক উৎপাদন ক্ষমতা ৭,০০,০০০ পিস। ইউনিটটি বিশ্বখ্যাত অ্যাথলিজার ব্র্যান্ড পুমা এবং সেইসঙ্গে ফ্রান্সের অচানের বৃহত্তম বৈশ্বিক সরবরাহকারী হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।
এছাড়া, কোম্পানিটি এমঅ্যান্ডএস এবং এইচঅ্যান্ডএম-এর স্পোর্টসওয়্যারও তৈরি করছে।
বিশেষ উৎপাদন ইউনিট
সম্পূর্ণ শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ও ধুলো-বালিমুক্ত পরিবেশে উর্মি গ্রুপের সিমলেস অ্যাথলিজার পণ্য উত্পাদিত হয়।
ফাইয়াজ রহমান জানান, অন্যান্য পোশাক কারখানায় প্রচলিত কাটিং ও সেলাই পদ্ধতি থেকে অনেকটাই ভিন্ন সিমলেস গার্মেন্টস পণ্যের উৎপাদন। সম্পূর্ণ অ্যাপ্লিকেশন-ভিত্তিক পোশাক প্রযুক্তিতে এই পণ্য তৈরি হয়।
উর্মি সিমলেস ইউনিটের প্রোডাক্ট ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড অপারেশনস'র ব্যবস্থাপক এম রিফাত কামাল বলেন, "ডিজাইনাররা প্রথমে বিশদভাবে পণ্যটি ডিজাইন তৈরি করেন। এরপর ফাইনাল ডিজাইনটি একটি পেনড্রাইভে করে মেশিনে ট্রান্সফার করা হয়। উৎপাদনের সময় প্রাথমিকভাবে প্রক্রিয়াটি তত্ত্বাবধান করেন অপারেটররা।"
তিনি আরও বলেন, ডিজাইনাররা সিমলেস প্যানেল ব্যবহার করে পোশাকের মধ্যে উন্নত বৈশিষ্ট্য যেমন- উইকিং, অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল বৈশিষ্ট্য, ঘর্ষণ-মুক্ত উপাদান এবং এমনকি সুগন্ধিও যুক্ত করেন।
"এই বিষয়গুলো পোশাকের কার্যকারিতা এবং কর্মক্ষমতা বজায় রেখে এটিকে নির্দিষ্ট সংখ্যকবার ব্যবহারে সক্ষম করে," যোগ করেন তিনি।
পরিচালক ফাইয়াজ রহমান জানান, একটি সিমলেস মেশিনের দাম প্রায় ৬০ লাখ টাকা। এই পরিমাণ অর্থ একটি টেন-লাইন ক্যাপাসিটি সেটআপের জন্য প্রচলিত পোশাক তৈরির মেশিন কিনতে যথেষ্ট।
ইউরোপ থেকে এশিয়া
প্রাথমিকভাবে, ইউরোপে উদ্ভূত হলেও ধীরে ধীরে এশিয়া এবং বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলের দেশগুলো সিমলেস প্রযুক্তি গ্রহণ করেছে।
বর্তমানে চীন, ভিয়েতনাম, শ্রীলঙ্কা এবং তুরস্কের মতো দেশগুলো সিমলেস গার্মেন্টস পণ্য উৎপাদনে অনেক এগিয়ে রয়েছে।
বিমল সিলভা বলেন, বিশ্বব্যাপী টেক্সটাইল শিল্পে প্রায় ৪০,০০০ সিমলেস মেশিন ব্যবহার করা হচ্ছে। এরমধ্যে শুধু চীনেই রয়েছে প্রায় ২০,০০০ থেকে ২৫,০০০ ইউনিট।
এছাড়া লাতিন আমেরিকা, তুরস্ক, জর্ডান এবং ইসরায়েলে কিছু মেশিন রয়েছে; আর বাকিগুলো ভিয়েতনাম, শ্রীলঙ্কা, ভারত এবং বাংলাদেশে রয়েছে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
বাংলাদেশের চ্যালেঞ্জ
বাংলাদেশে সিমলেস গার্মেন্টস পণ্য উৎপাদনে কিছু চ্যালেঞ্জের কথা তুলে ধরেন ফাইয়াজ রহমান।
প্রথমত, সিমলেস প্রযুক্তির অনেক বড় অঙ্কের বিনিয়োগ প্রয়োজন। দ্বিতীয়ত, সিমলেস পণ্য উৎপাদনে প্রয়োজন দক্ষ কর্মী বাহিনী গড়ে তোল, এটাকে একটি বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে উল্লেখ করেন ফাইয়াজ।
তিনি বলেন, উর্মির গ্রুপের সিমলেস ইউনিট এখনও তার সর্বোচ্চ উৎপাদন পর্যায়ে পৌঁছাতে পারেনি।
আগামী দুই বছরের মধ্যে তারা মেশিনের সংখ্যা দেড়শতে উন্নীত করার পরিকল্পনা করছেন বলে উল্লেখ করেন।
"আমরা গবেষণা ও উন্নয়ন এবং উদ্ভাবনের জন্য উল্লেখযোগ্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি; ধীরে ধীরে এটি ফল বয়ে আনছে। আমরা সিমলেস পণ্যের জন্য ইতোমধ্যেই প্রতিশ্রুতিশীল গ্রাহকদের কাছ থেকে অর্ডারের প্রতিশ্রুতি পেয়েছি, যে কারণে আমরা ধীরে ধীরে আমাদের সিমলেস মেশিনের সংখ্যা বৃদ্ধি করছি," যোগ করেন ফাইয়াজ।
অ্যাথলিজার পণ্য উৎপাদনের বৈশ্বিক প্রবণতা এবং এই শিল্পের ভবিষ্যতের কথা স্বীকার করে বিমল সিলভা জোর দিয়ে বলেন, বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম পোশাক উৎপাদনকারী দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে অবশ্যই এই বাজারে নিজের অবস্থান তৈরির সুযোগটিকে কাজে লাগাতে হবে।
তিনি স্বস্তি প্রকাশ করে বলেন, আরও কিছু গ্রুপ এখন সিমলেস প্রযুক্তিতে বিনিয়োগ করতে এগিয়ে আসছে, যা এই শিল্পকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাবে।