সবুজ পাওয়ার হাব হওয়ার আশা মহেশখালীর
অপরিচ্ছন্ন জ্বালানি থেকে সরে এসে নবায়নযোগ্য শক্তি ব্যবহার ও জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব প্রশমনের জন্য নেওয়া পদক্ষেপের অংশ হিসেবে কক্সবাজারের মহেশখালী পাওয়ার হাবে প্রস্তাবিত কয়লাবিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য নির্ধারিত জায়গায় এলএনজি ও সৌরভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।
বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিপি) সূত্রে জানা গেছে, পরিকল্পিত হাবটির প্রথম সাত ব্লকের প্রতিটিতে ১,২০০ মেগাওয়াটের এলএনজিভিত্তিক এবং এর সঙ্গে ৫০ মেগাওয়াটের সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের প্রস্তাব করা হয়েছে।
মহাপরিকল্পনাটিতে প্রথমে ৯টি ব্লকে ভাগ করা মহেশখালীর পাওয়ার হাবকে নতুন করে ১১টি ব্লকে ভাগ করা হয়েছে। প্রথমে হাবটিতে আটটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র ও একটি এলএনজিভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের পরিকল্পনা করা হয়েছিল।
কোন ব্লকে কোন ধরনের বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করা হবে, তা এখনও পর্যালোচনা পর্যায়ে রয়েছে বলে জানিয়েছেন বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মকর্তারা।
৮ ও ৯ নম্বর ব্লকে বড় পরিসরে সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের কথা ভাবা হচ্ছে। ১০ নম্বর ব্লকে সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্র অথবা বিদ্যুৎ-সংক্রান্ত উৎপাদন প্ল্যান্ট স্থাপনের কথা ভাবা হচ্ছে।
এছাড়া ১০ নম্বর ব্লকের মধ্যবর্তী স্থানে একটি কোল স্টক ও অ্যাশ ডাইক এরিয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে বলে জানান সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
আর ১১ নম্বর ব্লক ব্যবহারের বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।
বিদ্যুৎ বিভাগের সচিব মো. হাবীবুর রহমান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, মহেশখালীর পাওয়ার হাবে ব্লকভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের পরিকল্পনা এখনও চূড়ান্ত হয়নি।
'এসব বিষয় এখনও পর্যালোচনা করা হচ্ছে। পর্যালোচনা শেষে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। তখনই জানা যাবে পাওয়ার হাবে এলএনজিভিত্তিক মোট কত মেগাওয়াটের বিদ্যুৎকেন্দ্র হবে এবং সৌরভিত্তিক মোট কত মেগাওয়াটের বিদ্যুৎকেন্দ্র হবে,' বলেন তিনি।
২০১৭ সালে বিদ্যুৎ বিভাগের নিয়োগ করা পরামশর্ক প্রতিষ্ঠান এসটিইএজি এনার্জি সার্ভিসেস (ইন্ডিয়া) প্রাইভেট লিমিটেড মহেশখালীর পাওয়ার হাবকে মোট ৯টি ব্লকে ভাগ করে।
এর মধ্যে আট ব্লকে ১,৩২০ মেগাওয়াটের আটটি কয়লাবিদ্যুৎকেন্দ্র এবং একটি ব্লকে ৩,০০০ মেগাওয়াটের একটি এলএনজিভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের প্রস্তাব দেয় প্রতিষ্ঠানটি। সব মিলিয়ে মহেশখালী পাওয়ার হাব থেকে মোট ১৩ হাজার ৫৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছিল ।
পরে ওই ৯ ব্লকের দুটিতে বিপিডিবি ও বে অভ বেঙ্গল পাওয়ার কোম্পানি—বিপিডিবি ও চায়না হুয়াদিয়ান হংকং কোম্পানির যৌথ উদ্যোগের প্রতিষ্ঠান—যৌথভাবে কয়লাবিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের পরিকল্পনা নেয়।
এছাড়াও মালয়েশিয়ার প্রতিষ্ঠান তেনেগা নাসিওনাল বেরহাদ, দক্ষিণ কোরিয়ার কেপকো ও চীনের সেপকো-র সঙ্গে যৌথভাবে একটি করে কয়লাবিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের পরিকল্পনা করে পিডিবি।
বিপিডিবির কর্মকর্তারা জানান, তেনেগা নাসিওনাল বেরহাদ, কেপকো ও সেপকোর সঙ্গে পিডিবি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করলেও তা আর বাস্তবায়নের দিকে অগ্রসর হয়নি। এসব সমঝোতার মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়ে গেছে।
অন্যদিকে এলএনজি ব্লকে ৩,৬০০ মেগাওয়াটের বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনে ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে পিডিবির সঙ্গে জেনারেল ইলেকট্রিকের (জিই) চুক্তি সই হয়। যৌথ উদ্যোগের চুক্তি অনুমোদনের প্রক্রিয়া বর্তমানে বিদ্যুৎ বিভাগে রয়েছে বলে জানা গেছে।
২০২১ সালে সরকার পাওয়ার হাবে আটটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের নির্মাণ বাতিল করে।
পাওয়ার হাবের জমির সুষ্ঠু ব্যবহারের লক্ষ্যে ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে বিপিডিবির প্রধান প্রকৌশলীকে প্রধান করে একটি কমিটি গঠন করা হয়। ওই কমিটির সুপারিশের ভিত্তিকে এই নতুন পরিকল্পনা করা হয়েছে।
বিপিডিবি সূত্রে জানা গেছে, কক্সবাজারের মহেশখালী উপজেলায় কয়লা ও এলএনজিভিত্তিক তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের লক্ষ্যে ইতিমধ্যে 'মহেশখালী পাওয়ার হাবের ভূমি অধিগ্রহণ' শীর্ষক প্রকল্পের মাধ্যমে ৫,৫১৮.৬ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। এছাড়া পাওয়ার হাবের নকশার অ্যালাইনমেন্ট থেকে বিভিন্ন দাগে বাদ পড়া আরও ৯৬.৯৯৮ একর জমির অধিগ্রহণের কাজ প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
এলএনজি ও সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য সম্ভাব্যতা সমীক্ষা শুরু
বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, বে অভ বেঙ্গল পাওয়ার কোম্পানি মহেশখালীর পাওয়ার হাবে একটি গ্যাসভিত্তিক কম্বাইন্ড সাইকেল বিদ্যুৎকেন্দ্র এবং একটি গ্রিড-টাইড সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনে ইতিমধ্যে সম্ভাব্যতা সমীক্ষার কাজ শুরু করেছে।
বাংলাদেশ-চীনের যৌথ উদ্যোগের প্রতিষ্ঠানটিকে ইতিমধ্যে প্রস্তাবিত ব্লক-১-এর ৪০০ একর জমি সাময়িকভাবে হস্তান্তর করা হয়েছে। সমীক্ষা শেষে আগামী দুই বছরে বাস্তবায়ন কাজ শুরুর লক্ষ্য রয়েছে প্রতিষ্ঠানটির।
১৩৫ মেগাওয়াট সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্রের স্থাপনের পরিকল্পনা
পাওয়ার হাবে প্রথমবারের মতো সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছে বিপিডিপি। প্রস্তাবিত ৯ নম্বর ব্লকের ৪১০ একর ভূমিতে ১৩৫ মেগাওয়াটের প্রকল্পের বাস্তবায়ন ২০২৬ সালের মধ্যে শেষ করার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে সংস্থাটি। এতে ব্যয় ধরা হয়েছে ১,১৮৪.৪৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৮০২ কোটি টাকা উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে ঋণ হিসেবে নেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে।
এ-সংক্রান্ত প্রাথমিক উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (পিডিপিপি) ইতিমধ্যে পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়েছে। পরিকল্পনা কমিশনের নীতিগত অনুমোদনের পর অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) মাধ্যমে বৈদেশিক ঋণ নিশ্চিত করতে উন্নয়ন সহযোগীদের কাছে এই পিডিপিপি পাঠানো হবে বলে বিপিডিবি সূত্রে জানা গেছে।
পাওয়ার সিস্টেম মাস্টার প্ল্যান ২০১৬ অনুযায়ী, ২০৩০ ও ২০৪১ সালের মধ্যে দেশে বিদ্যুতের চাহিদা বেড়ে যথাক্রমে ২৭ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট এবং ৫১ হাজার মেগাওয়াট হবে। তাই বিদ্যুতের চাহিদা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে আনুপাতিক হারে বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতাও বাড়াতে হবে।
প্রথাগত জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের পাশাপাশি মহাপরিকল্পনাটিতে নবায়নযোগ্য উৎস থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং আন্তঃসীমান্ত বিদ্যুৎ বাণিজ্যের অধীনে বিদ্যুৎ আমদানির পরিকল্পনা ও লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।
বাংলাদেশ ২০৪১ সালের মধ্যে নবায়নযোগ্য শক্তি থেকে ৪০ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিকল্পনা করছে।
বর্তমানে পিক আওয়ারে ১৫ হাজার ৫০০ থেকে ১৬ হাজার মেগাওয়াট চাহিদার বিপরীতে ক্যাপটিভ ও নবায়ননযোগ্যসহ দেশের মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ২৭ হাজার ৩৬১ মেগাওয়াট।
২০২১ সালে গ্লাসগো জলবায়ু সম্মেলনে বাংলাদেশ ঘোষণা করেছিল, নবায়নযোগ্য শক্তি, জ্বালানি সাশ্রয় ও সংরক্ষণের প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে ২০৪০ সালের মধ্যে ৮৯.৪৮ মিলিয়ন টন কার্বন নিঃসরণ কমাবে।