পাঁচ শতাব্দী ধরে স্পেনে দেওয়ালের মধ্যে লুকিয়ে রাখা ১২ শতকের কোরআন, আরো অমূল্য বই
গণিত, কবিতা ও জ্যোতির্বিজ্ঞানে পারদর্শী ছিলেন মোহাম্মদ আল-ইয়েইয়ার। ছিলেন দক্ষ বিচারক। বিভিন্ন সংস্কার ও সমসময়ীক ঘটনাবলী নিয়েও ছিল তার আগ্রহ। স্বরচিত এক কবিতায় তিনি লিখে গেছেন, 'পুরো দুনিয়ায় তা কখনো হয়নি, যা হয়েছে আল- আন্দালুসে (স্পেনে)।
অনেক বছর সেভিল শহরে কারাবন্দি থাকার সময়, আল-ইয়েইয়ার নগরীর শাসক/ গভর্নরের জন্য বই কপি করেছেন। এরপর তাকে কারাগার থেকে মুক্তি দিয়ে নিয়োগ করা হয় 'আলফাক্বি' – আইন বিশেষজ্ঞ – এবং আকুতার (বর্তমানে যা করতার) ইমাম হিসেবে। স্পেনের মালাগা প্রদেশের সারকীয়া জেলায় অবস্থিত ছোট্ট এই মফঃস্বলের বর্তমান অধিবাসী সংখ্যা ৬০০ জন। ১৪৯০ সনের ৯ আগস্ট আকুতার নতুন ইমাম কর্মস্থলে যখন যোগ দেন, তখনও এটি সমসংখ্যক অধিবাসীর গ্রামীণ এক খামার-ভিত্তিক জনপদ ছিল।
ইমাম পদে যোগ দিয়ে জ্ঞান সাধনা অব্যাহত রাখেন আল-ইয়েইয়ার। প্যাপিরাসের কাগজে লিখেছেন তার দৈনন্দিন জীবন সম্পর্কে। উঠে এসেছে উত্তরাধিকার, তালাক সংক্রান্ত বিচারে তার ভূমিকা, ব্যক্তিগত মতামত থেকে শুরু করে ১৪৯২ সনে স্পেনের খৃষ্টানদের গ্রানাডা বিজয়ের ঘটনা; – ঐতিহাসিক যে লগ্ন ছিল স্পেনের মুসলিম সভ্যতার ভিত্তি ধসের শামিল, অচিরেই যার ভয়াবহ পরিণতি মালাগা প্রদেশের ওপরও নেমে আসে।
আনুমানিক ১৫০০ সনের দিকে তাকে হয় খৃষ্টধর্ম গ্রহণ, নয়তো মাতৃভূমি ত্যাগের শর্ত দেয় নতুন বিজেতারা। প্রতিকূল অবস্থায় দ্বিতীয় পথটিই বেছে নেন আল-ইয়েইয়ার। কিন্তু, পালানোর আগে নিজ বাড়ির একটি দেওয়ালের আড়ালে লুকিয়ে রাখেন তিনটি পাণ্ডুলিপি: যারমধ্যে দুটি তার লেখা বই আর অন্যটি হলো ১২ বা ১৩ শতকের একটি কোরআন। এরপর সময়ের স্রোত বয়ে গেছে আপন গতিতে। রিকনকয়েস্তার রক্তাক্ত অধ্যায় এক সময় শেষ হয়, শেষ হয় দুই দুটি মহাযুদ্ধ। এই দীর্ঘ সময়ে কেউই খোঁজ পায়নি গ্রন্থগুলোর। শেষতক ওই গ্রামের একটি বাড়ি সংস্কারের কাজ করার সময় নির্মাণশ্রমিকরা দেওয়ালের ইট সরালে বইগুলো আলোর মুখ দেখে আবার।
২০০৩ সালের ২৮ জুন এই আবিষ্কারের আগপর্যন্ত সুদীর্ঘ ৫০০ বছর লুকানোই ছিল অমূল্য বইগুলো। বাড়ির বর্তমান মালিক মাগডালেনা সান্তিয়াগো স্মৃতিচারণ করে বলেন, "আমি বিস্মিত হয়েছিলাম, আমরা কেউই ভাবিনি এমন কিছু পাওয়া যাবে।" সংস্কারের আগে বাড়িটির প্রায় ভগ্ন দশা ছিল। তবে আন্দালুসিয় যুগের বাড়িটির দেওয়ালের গোপন একটি কাপবোর্ডে পুরু খরের আচ্ছাদনে সুরক্ষিত ছিল বই তিনটি।
স্পেনের মুসলমানরা জ্ঞান চর্চাকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিতেন। রিকনকয়েস্তার সমসাময়ীক আরও অনেক বই কয়েক শতাব্দী পরেও স্পেনের বিভিন্ন স্থানে প্রাচীন দেওয়ালে লুকানো অবস্থায় উদ্ধার হয়েছে। কিন্তু, মাগডালেনার বাড়িতে আবিষ্কৃত কুরআনটি স্পেনে আবিষ্কৃত সবচেয়ে পুরোনো দুটি কোরআনের মধ্যে একটি। আবিষ্কারের পর কুরআনটি স্থান পায় মালাগা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠাগারে। সেখানে এর মূল কপি দীর্ঘ ২০ বছর অধ্যয়ন করেছেন আরবি ভাষাবিদ মারিয়া ইসাবেল কালেরো। তার মতে, 'এর আবিষ্কার ছিল অত্যাশ্চর্য'।
কালের আবহে কুরআনটির অনেক আয়াতই অস্পষ্ট হয়ে যায় প্রাচীন কাগজে। জোড়কলম দেওয়া কাগজের মাধ্যমে সেগুলো পুনরুদ্ধার করে বর্তমানে কুরআনটি সংরক্ষণ করা হচ্ছে – আর্চিভো হিস্তোরিকো প্রভিন্সিয়াল ডি মালাগায় (বা মালাগার প্রদেশের ঐতিহাসিক আর্কাইভে)। আর্কাইভের দায়িত্বে রয়েছে আন্দালুসিয়ার আঞ্চলিক সরকার।
করতারে পাওয়া প্রাচীন পাণ্ডুলিপিগুলোকে 'লস ম্যানুস্ক্রিতোস দি করতার' নাম দেন স্পেনিশ প্রত্নবিদেরা। ২০০৯ সালে প্রশাসনের পক্ষ থেকে প্রাচীন কোরআনটির অবিকল একটি অনুলিপি প্রস্তুত করা হয়। একইসঙ্গে প্রকাশিত হয় তিনটি গ্রন্থ নিয়ে করা গবেষণা। ইসাবেল কালেরো গবেষক দলের নেতৃত্ব দেন।
গবেষকরা জানান, আলমোহাদ শাসকদের সমকালীন বা ১৩ শতকে লিখিত এই কুরআনের লেখনীশৈলী বর্গাকার ধাঁচের। বাছুর ও ভেড়ার চামড়ার পার্চমেন্ট থেকে এটি তৈরি করা হয়। সোলেমানি নট, লাল রঙা ফুল, কালো ও সবুজ রঙা ক্যালিওগ্রাফি ইত্যাদি অলঙ্করণের মাধ্যমে ধর্মীয় গ্রন্থটির গুরুত্ব ফুটিয়ে তোলা হয়েছে বিভিন্ন স্থানে। ফলে শৈল্পিক দিক থেকেও এই কুরআন এমনই আকর্ষণীয়, বহু শতাব্দী পর যার আবেদন আরও বেড়েছে।
কীভাবে এটি আল-ইয়াইয়ারের হাতে এসেছিল এবং ১৬ শতকের গোড়ার দিকেই ইসলাম ধর্মের গ্রন্থগুলো স্পেনে নিষিদ্ধ করার পরও কেন তিনি এত যত্নের সাথে লুকিয়ে রেখেছিলেন, তা নিয়ে দুটি তত্ত্ব দিচ্ছেন গবেষকরা। প্রথম তত্ত্ব হচ্ছে, তিনি কোরআনটি পারিবারিক উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছিলেন। দাদা থেকে বাবা, তারপর ছেলের হাতে – এভাবে প্রজন্মের পর প্রজন্মের হাতে আসা কোরআনটি তিনি যেকোনো মূল্যে রক্ষা করতে চেয়েছিলেন। দ্বিতীয় তত্ত্বটি হলো – কোরআনটি ছিল করতার জামে মসজিদের। ১৬ শতকে ওই মসজিদের স্থানে নির্মাণ করা হয় গ্রামের চার্চ। মসজিদের ইমাম আল-ইয়াইয়ার বুঝেছিলেন, লুকিয়ে না রাখলে এই কোরআনও ধবংস করা হবে।
ঘটনা যাই হোক না কেন, একদিন এই কোরআন আর অন্য পাণ্ডুলিপিগুলো ফিরে পাবার আশা করেছিলেন আল-ইয়াইয়ার। কালেরো বলেন, 'অনাকাঙ্ক্ষিত কেউ এগুলো খুঁজে পাবে, তারপর চিরতরে হারিয়ে যাবে – এই কাহিনির কেন্দ্রে রয়েছে সেই ভয়'।
গবেষণাকালে অন্য দুটি পাণ্ডুলিপিও মুগ্ধ করে কালেরোকে। তিনি জানান, 'কৌতূহল উদ্দীপক' সব ঘটনাবলী বর্ণিত এই পাণ্ডুলিপি দুটিতে শেষ পংক্তি লেখা হয়েছিল ১৫০০ সনেই।
আল-ইয়াইয়ার-ই ছিলেন এ দুটির মূল লেখক। তবে অন্য লেখকরাও ছিলেন, কারণ অনেক পাতায় বিভিন্ন হস্তলেখনী দেখা যায়, যা লিনেনের সুতায় সেলাই করে যুক্ত করা হয়েছে। এরমধ্যে একটি পাণ্ডুলিপির সাংকেতিক নাম দেওয়া হয়েছে এল১৪০২৯ – যা মোট ১১১ পাতা আরবি লেখনীযুক্ত। ইতিহাস বিস্মৃত আলফাক্বি (আল-ইয়াইয়ার) কাজ সংক্রান্ত লেখাই ছিল এর মূল উপজীব্য, যাকে 'সংস্কৃতিমনা ব্যক্তিত্ব' বলে অভিহিত করেন কালেরো।
তার বিশ্বাস, আল-ইয়াইয়ারকে করতারে নিযুক্ত করার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল দুটি: ক্যাথলিক রাজাদের কাছে মালাগাকে সমর্পণ করা। দ্বিতীয়ত, শ্বশুরবাড়ির কাছাকাছি বসবাস, কারণ তার স্ত্রী উম্ম- আল ফাথ ছিলেন এই অঞ্চলের মেয়ে।
পাণ্ডুলিপিতে ভূমি বন্টন, বিবাহ, উত্তরাধিকার, প্রতিবেশীদের মধ্যেকার বিরোধ ও বিবাহ বিচ্ছেদ সম্পর্কিত যেসব বিচার আলফাক্বি হিসেবে করেছেন আল-ইয়াইয়ার, তা পৃথক পৃথক অধ্যায়ে বর্ণনা করা হয়েছে। এরমধ্যে দ্বিতীয়বারের মতো তালাক নেওয়া আয়শা বিনতে আল-কুতুবি নামক এক নারীর উল্লেখ পাওয়া যায়। এছাড়া, অঙ্কশাস্ত্র নিয়ে আলোচনা রয়েছে বেশকিছু পাতায় – যেখানে গাণিতিক বিভাজন টেবিল সংখ্যাসহ তুলে ধরা হয়েছে। আরও রয়েছে, কিছু কবিতা এবং রমজান মাসে সুর্যাস্ত ও সুর্যোদয়ের সময় গণনা।
দ্বিতীয় বইটির সাংকেতিক নাম দেওয়া হয়েছে এল১৪০৩০। ১৩৪ পাতা ইতালীয় কাগজে বেশিরভাগ ব্যক্তিগত অভিমত, পর্যবেক্ষণ, দৈনিক ঘটনাবলী লিখেছেন আল-ইয়াইয়ার। এরমধ্যে অনেক অংশ অন্যান্য পুস্তক ও ধর্মীয় বাণীর অনু্লিপি (যেমন- নিজে শক্তিশালী হলে দুর্বলের বিচার করো না)। আরও রয়েছে কিছু তাত্ত্বিক ও সংস্কারমূলক প্রশ্ন। ইমামের স্বরচিত কিছু কবিতার দেখা মেলে এই পাণ্ডুলিপিত। এছাড়া, খৃষ্টানদের গ্রানাডা জয়, ১৪৯৪ সনের ভূমিকম্প-সহ এমন কিছু সংবাদও ছিল যা গভীরভাবে তাকে বিচলিত করেছিল।
সর্বসাধারণ যাতে পড়তে পারেন, সেজন্য গত শরৎকালে করতার শহরের প্রদর্শনী কেন্দ্রের একটি কক্ষে রাখা হয় এসব বইয়ের ডিজিটাল কপি। বইগুলো কীভাবে আবিষ্কৃত হলো, এতে গুরুত্বপূর্ণ কী কী রয়েছে – তাও জানা যাবে ডিজিটাল মাধ্যমে।
বেনামারগোসা, আলমাচার, এল বোর্গে, কোমারিস ও করতার এই পাঁচটি খামার-ভিত্তিক জনপদ (গ্রাম) নিয়ে 'তাহা দি কোমারিস' জেলা। নিকটবর্তী এসব গ্রাম আঁকাবাঁকা এক পথ ধারা সংযুক্ত। যে পথের দুধারে সার সার আম, অ্যাভোকাডো, আঙ্গুর ফলের বাগান। এরমধ্যে অনেক বাগানই সুপ্রাচীন।
করতারের মেয়র ফ্রান্সিসকো রুইজ বলেন, "চারপাশের পরিবেশ হয়তো কিছুটা বদলেছে। কিন্তু এই জনপদ আল-আন্দালুসের সময় যেমন ছিল, এখনও অনেকটা তেমনই রয়েছে।"
অনেক চেষ্টাচরিত্রের পর বইগুলোর প্রদর্শনী ব্যবস্থাপনার উপযুক্ত ব্যক্তি– প্রত্নতাত্ত্বিক হুয়ান বাতিস্তা সালাদোকে খুঁজে বের করে করেছেন স্থানীয় এই নগরপিতা। হুয়ান আল-আন্দালুস যুগের একজন বিশেষজ্ঞ এবং নির্জা জাদুঘরেরও পরিচালক। তিনি বলেন, "আমাদের লক্ষ্য ছিল, বইগুলোর মূল্যকে (সাধারণ মানুষের কাছে) বাড়িয়ে তোলা, একইসঙ্গে এগুলো থেকে আমরা যে তথ্য পেয়েছি, সেগুলোও সঠিকভাবে উপস্থাপন। যাতে আন্দালুসীয় সমাজ ও জীবনযাপন কেমনতর ছিল – সে সম্পর্কে তারা স্পষ্ট ধারণা পান।"
বইগুলো প্রাচীন যে দেওয়ালে রক্ষিত ছিল, সেটি কেন সংরক্ষণ করা হয়নি - তা নিয়ে আক্ষেপ প্রকাশ করেন এই প্রত্নবিদ। হুয়ান বলেন, 'খুব সম্ভবত বাড়িটিও অন্তত ১৫ শতকেই নির্মিত হয়েছিল, এখন মূল দেওয়ালগুলোর মাত্র কয়েকটা টিকে আছে। সংস্কারের সময় বাকিগুলো ভেঙ্গে ফেলা হয়।'
তার মতে, জন্মভূমি থেকে উচ্ছেদ হতে হলেও, আল-ইয়াইয়ার কাহিনি আশার, নিরাশার নয়। কারণ তিনি একদিন আবার নিজের মাতৃভূমি, এই বাড়ি ও বইগুলো ফিরে পাওয়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন।