বিদ্যুৎ খাতের দুর্দশা কাটাতে ক্যাপাসিটি চার্জ প্রত্যাহার ও দায়মুক্তি আইন বাতিলের সুপারিশ
ক্যাপাসিটি চার্জের মডেল ও দায়মুক্তি আইনসহ আরও বেশ কিছু কারণে বড় অঙ্কের আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে দেশের বিদ্যুৎ খাত। এর ফলে সরকারের ওপর বড় মাপের ভর্তুকির বোঝা তৈরি হচ্ছে।
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের সংস্থা বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) এক সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে এই পর্যবেক্ষণ উঠে এসেছে। ক্যাপাসিটি চার্জকে 'লুটেরা মডেল' হিসেবে উল্লখ করে আইএমইডির এ প্রতিবেদনে খাতটির সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
ক্যাপাসিটি চার্জ বন্ধ, জ্বালানি-অবান্ধব ক্যাপটিভ বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ, বিদ্যুৎ ও জ্বালানীর দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইন, ২০১০ বাতিলসহ বেশ কিছু সুপারিশ করেছে আইএমইডি।
আইএমইডির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১৪ বছরে বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে ৯০ হাজার কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে ক্যাপাসিটি চার্জ হিসেবে। এই অর্থের পুরোটাই দিতে হয়েছে ডলারে।
ক্যাপাসিটি চার্জ হলো বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) কর্তৃক বিদ্যুৎকেন্দ্রের মালিকদের তাদের বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ব্যবহারের বিনিময়ে দেওয়া অর্থ।
বর্তমান ব্যবস্থায় বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো থেকে বিদ্যুৎ নেওয়া হোক বা না হোক, কেন্দ্রমালিকদের ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে বাধ্য পিডিবি।
আইএমইডি বলেছে, এই মডেলের কারণে প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ অর্থ বেরিয়ে যাচ্ছে। এর ফলে ভর্তুকির পরিমাণ বাড়ছে। ক্যাপাসিটি চার্জ না থাকলে বিদ্যুৎ খাতে বিনিয়োগ কমে যাবে, এটিও সত্য নয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভর্তুকির চক্র থেকে বিদ্যুৎ খাতকে বের করার জন্য সুস্পষ্ট পরিকল্পনা দরকার। আর ক্যাপাসিটি চার্জের ব্যবস্থাও টেকসই নয়।
আইএমইডির প্রতিবেদনে 'ওভারহলিং'কে ক্যাপাসিটি চার্জের বিকল্প হিসেবে গ্রহণ করা যেতে পারে বলে সুপারিশ করা হয়েছে। অর্থাৎ যতটুকু সময় বিদ্যুৎকেন্দ্র রক্ষণাবেক্ষণের জন্য উৎপাদন থাকতে পারবে না (সর্বোচ্চ ২০ শতাংশ), ওই সময়ের জন্যও একটা চার্জ দেওয়া, যাতে বিনিয়োগ সুরক্ষিত হয়।
বেসরকারি উৎপাদনকারীরা স্থানভেদে ২৫-৫০ শতাংশ বর্ধিত দামে বিদ্যুৎ বিক্রির সুযোগ পাবে এবং সরকার অর্ধেক বিদ্যুৎ কেনার নিশ্চয়তা দেবে—এ দুই শর্তই যথেষ্ট বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
দায়মুক্তি আইন
বিদ্যুৎ ও জ্বালানীর দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইন, ২০১০ অনুযায়ী, এ আইনের অধীনে করা কোনো কার্য, গৃহীত কোনো ব্যবস্থা, কোনো নির্দেশ বা আদেশের বৈধতা সম্পর্কে কোনো আদালতে কোনো প্রশ্ন উত্থপান করা যাবে না।
দায়মুক্তি আইনের বলে ইউনিটপ্রতি বিদ্যুতের মূল্য ও খরচের মডেল জবাবদিহির ঊর্ধ্বে।
অলস বসে থাকা বিদ্যুৎকেন্দ্রের ক্যাপাসিটি চার্জ হিসেবে দেখা যায়, কিছু বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের (আইপিপি) ইউনিটপ্রতি বাৎসরিক গড় মূল্য ১০০ টাকাও ছাড়িয়েছে। ডলারে পেমেন্ট করতে হয় বলে এতে পিডিবির লোকসান থামানো যাচ্ছে না বলে উল্লেখ করা হয়েছে প্রতিবেদনে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত ১২ বছরে পিডিবি লোকসান গুনেছে প্রায় ১ লাখ ৫ হাজার ৪১৯ কোটি টাকা। আর সদ্য-বিদায়ী ও আগামী অর্থবছর মিলিয়ে সংস্থাটি লোকসান গুনবে প্রায় ১ লাখ ১২ হাজার কোটি টাকা।
বিদ্যুৎ খাতে এই 'দুর্বৃত্তায়ন' থামানোর সুপারিশ করে ২০২৬ সাল পর্যন্ত দায়মুক্তি আইনের মেয়াদ বাড়ানোর জন্য সরকারের সমালোচনা করেছে আইএমইডি।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক এম শামসুল আলমের মতে, এই আইনের মূল উদ্দেশ্য ছিল বিদ্যুৎ খাতে বিনিয়োগকে প্রতিযোগিতাহীন করা। এর ফলে বিনিয়োগ ব্যয় লাগামহীন হয়ে পড়েছে।
'ঘাটতি, ভর্তুকি ও বিদ্যুতের দাম—সব এর কারণেই বাড়ছে।'
এই অধ্যাপক মনে করেন, এ আইনই বিদ্যুৎ খাত ধ্বংসের মূল কারণ এবং এটি অনেক আগেই বাতিল করা উচিত ছিল। তিনি বলেন, 'যত তাড়াতাড়ি আইনটি বাতিল করা হবে, তত দ্রুত বিদ্যুৎ খাত ঘুরে দাঁড়ানোর সুযোগ পাবে।'
টেকসই ও স্থিতিশীল বিদ্যুৎ খাত নিশ্চিত করতে, সিস্টেম লস কমাতে ও সবুজ বিদ্যুতের রোডম্যাপ বাস্তবায়ন করতে শিল্প বিকাশ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের সুপারিশ করেছে আইএমইডি।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী (আইপিপি) চুক্তি বিদ্যুৎ খাতের প্রধানতম সংকটের জায়গা। এ চুক্তির জন্য বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রকে ডলার নয়, বরং টাকায় পেমেন্ট দিতে হয়। বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে টাকায় পেমেন্ট দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে।
বেশ কিছু মূল কারণের সমাধান না করে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের চ্যালেঞ্জগুলোর সমাধান করা যাবে না বলে উল্লেখ করা হয়েছে প্রতিবেদনে।
এসবের মধ্যে রয়েছে ইউনিটপ্রতি উচ্চমূল্যের অবসান ঘটানো, জ্বালানি ও জমির ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করা, সহজ ব্যাংকঋণ-সংক্রান্ত নীতিমালা সংশোধন এবং শুল্কমুক্ত আমদানি সুবিধার বিধান পুনর্মূল্যায়ন করা।
ক্যাপটিভ ও অদক্ষ বিদ্যুৎকেন্দ্র
শিল্প বিদ্যুতের দাম বেশি এবং নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহের নিশ্চয়তা নেই বলে ক্যাপটিভ বিদ্যুৎ উৎপাদনে চলে গেছে মাঝারি থেকে বড় শিল্পগুলো।
শিল্পমালিকদের দাবি, নিজস্ব গ্যাস জেনারেটরে উৎপাদন খরচ সরকারি মূল্যের মাত্র এক-তৃতীয়াংশ।
তবে আইএমইডির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ক্যাপটিভে নিম্ন-দক্ষতার জেনারেটরে বেশি জ্বালানি পুড়ে কম বিদ্যুৎ উৎপাদন হয় বলে পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে। ক্যাপটিভ বিদ্যুৎ স্থায়ীভাবে বন্ধের জন্য শিল্পে বিদ্যুৎ সঞ্চালন, বিতরণ ও শিল্প সহায়ক সাশ্রয়ী বিলিং নীতিমালা প্রয়োজন বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কয়েক ডজন বিদ্যুৎকেন্দ্রের জ্বালানি দক্ষতা ৩০ শতাংশের কম। অর্থাৎ অনেক বেশি জ্বালানি পুড়িয়ে এসব কেন্দ্র থেকে কম বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয়। এতে আমদানিনির্ভর জ্বালানি সরবাহের চাপ বাড়ছে।
৩৮টি বন্ধ ও ৯৮টি আংশিক সচল বিদ্যুৎকেন্দ্রের মধ্যে যেগুলোর তাপীয়-দক্ষতা ভালো, সরকারি-বেসরকারি যা-ই হোক, সেগুলো সচল রাখার পরিকল্পনা দরকার।
৪০ শতাংশের বেশি জ্বালানি দক্ষতা ও ৬০ শতাংশের বেশি প্ল্যান্ট ফ্যাক্টর রয়েছে, এমন কেন্দ্রগুলোকে প্রাধান্য দিলে বিদ্যুৎ উৎপাদনে জ্বালানি অপচয় কমানো যাবে বলে মনে করছে আইএমইডি।
অলস বসে আছে ৪৪ শতাংশ বিদ্যুৎকেন্দ্র
কয়লা ও ডলার সংকটের কারণে দেশের বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর উৎপাদন সক্ষমতার ৪৪ শতাংশ ব্যবহার করা যাচ্ছে না বলে আইএমইডির প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
কয়লা ও ডিজেল সরবরাহ করতে না পারায় দেশের বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোতে মোট সক্ষমতার মাত্র ৫৬ শতাংশ ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হচ্ছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জ্বালানি হিসেবে ডিজেল ও কয়লানির্ভর বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোতে ইউনিটপ্রতি বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ অনেক বেশি হয়ে থাকে।
এই অতিরিক্ত মূল্যে বিদ্যুৎ কিনে গ্রাহকদের কাছে পৌঁছে দিতে সরকারকে বিপুল পরিমাণ অর্থ ভর্তুকি দিতে হয়।
সিস্টেম লস
আইএমইডির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ৩ শতাংশের বেশি যেকোনো সিস্টেম লস মানেই হলো বিদ্যুৎ চুরি।
তবে ২০১৯-২০ অর্থবছর শেষে বিদ্যুতের সিস্টেম লস ৮.৭৩ শতাংশে উঠে গিয়েছিল।
কাঠামোগত সিস্টেম লসের 'চুরি ও দুর্নীতি' থামিয়ে জ্বালানি সাশ্রয়ের স্বচ্ছ পরিকল্পনা নেই বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শিল্পে বিদ্যুৎ-সাশ্রয়ী যন্ত্রপাতি ব্যবহারে উৎসাহ ও শুল্কায়ন সুবিধা প্রয়োজন।
খাতটির উন্নয়নে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ তুলে ধরতে চলমান বিদ্যুৎ প্রকল্প ও বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর কার্যক্রম বিশ্লেষণ করে আইএমইডি এই প্রতিবেদন তৈরি করেছে।
আইএমইডির সচিব আবুল কাশেম মো. মহিউদ্দিন বলেন, 'বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের কাজ হচ্ছে উন্নয়ন প্রকল্পগুলো পর্যবেক্ষণ করা। সংস্থাটি প্রকল্প বাস্তবায়নে বিলম্ব চিহ্নিত করে এবং প্রকল্পগুলোর প্রভাব বা ফলাফল মূল্যায়ন করে।'
এরই অংশ হিসেবে আইএমইডি বিদ্যুৎ খাতের চলমান সব প্রকল্প নিয়ে গবেষণা করে প্রতিবেদন দিয়েছে বলে জানান তিনি।
বিধি মোতাবেক প্রতিবেদন ও কিছু সুপারিশ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানো হয়েছে বলে জানান সচিব।
তিনি বলেন, 'সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেবে। সুপারিশ বাস্তবায়নের পর্যবেক্ষণ অব্যাহত থাকবে।'
পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেন, আইএমইডি শুধু সমস্যাগুলো তুলে ধরতে পারে, ব্যবস্থা নেবে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়।
কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হোক বা না হোক, আইএমইডির প্রতিবেদন গণমাধ্যমে জনমত তৈরি করবে বলে মনে করেন মন্ত্রী।
মন্ত্রী আরও বলেন, আইএমইডি দায়মুক্তি অধ্যাদেশের পর্যালোচনা উপস্থাপন করেছে। 'সরকার সিদ্ধান্ত নেবে আইনটি বাতিল করা দরকার কি না।'