ভারত মহাসাগরে বিশাল গ্র্যাভিটি হোল, অবশেষে কারণ খুঁজে পেলেন বিজ্ঞানীরা
ভারত মহাসাগরের মাঝখানে একটি বিশাল মাধ্যাকর্ষণজাত গর্ত (গ্র্যাভিটি হোল) আছে। কয়েক দশক ধরে এই গ্র্যাভিটি হোলের সৃষ্টি নিয়ে গবেষণা করেছেন বিজ্ঞানীরা। অবশেষে ভারতের দুই বিজ্ঞানী এ বিষয়ে একটি সম্ভাব্য তত্ত্ব প্রকাশ করেছেন।
গ্র্যাভিটি হোল মূলত ভৌত কোনো গর্ত নয়। বরং এটি কয়েক লাখ বর্গমাইলজুড়ে বিস্তৃত সমুদ্রের একটি এলাকা, যেখানে পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ স্বাভাবিক গড়ের চেয়ে কম।
এই 'গর্ত' অধ্যয়নরত বিজ্ঞানীরা দীর্ঘদিন ধরে ভেবেছিলেন, সমুদ্রতলের কোনো কিছুর প্রভাবে এই অসামঞ্জস্যতার সৃষ্টি হয়েছে।
কিন্তু একটি নতুন গবেষণায় বলা হয়েছে, গ্র্যাভিটি হোল কীভাবে তৈরি হয়েছে সে রহস্য সমাধান করতে 'গর্তের' নিচে নয়, বরং চারপাশে নজর দেওয়া প্রয়োজন ছিল।
গবেষকেরা দাবি করেছেন, প্রাচীন সমুদ্রতটের অবশিষ্টাংশ থেকে গলিত শিলার ঊর্ধ্বমুখী প্রবাহ (প্লুম) থেকে এই গ্র্যাভিটি হোলের সৃষ্টি।
সমুদ্রস্তর নিচে নামিয়ে দিচ্ছে গ্র্যাভিটি হোল
পৃথিবীর পৃষ্ঠের উপর মাধ্যাকর্ষণ খুব সামান্য পরিবর্তিত হয়। পরিবর্তনের বেশিরভাগ কারণই সহজে ব্যাখ্যা করা যায়। তবে ভারত মহাসাগরের গ্র্যাভিটি হোল ব্যাখ্যা করতে বিজ্ঞানীদের সংগ্রাম করতে হয়েছে। এই গ্র্যাভিটি হোলকে বলা হয় 'ইন্ডিয়ান ওশান জিওড লো'।
জিএফজেড জার্মান রিসার্চ সেন্টার অভ জিওসায়েন্সেস-এর জিওডাইনামিকস গবেষক বার্নহার্ট স্টেইনবার্গার বলেন, মাধ্যাকর্ষণ পার্থক্য সাধারণত বিশাল হয় না। আপনি যদি কোনো অসঙ্গতির (মাধ্যাকর্ষণের ক্ষেত্রে) মাঝখানেও দাঁড়িয়ে থাকেন, তারপরও আপনি এটি লক্ষ্য করতে পারবেন না। কিন্তু ১১ লাখ বর্গমাইলজুড়ে সমুদ্রস্তর যখন পার্শ্ববর্তী সমুদ্রগুলো থেকে ৩০০ ফুট নিচু হয় তখন তা অবশ্যই তাৎপর্যপূর্ণ।
স্টেইনবার্গার বলেন, লোকেরা সাধারণত অনুমান করে যে, নিচে কম ঘনত্বের কোন পদার্থ আছে যা এমন কিছু ঘটাচ্ছে। কিন্তু এই গবেষণায় দুই বিজ্ঞানী ভিন্ন একটি তত্ত্ব দেখিয়েছে।
রহস্যের উত্তর গ্র্যাভিটি হোলের চারপাশে
বেঙ্গালুরু'র ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্স-এর ভূ-পদার্থবিদ আত্রেয়ী ঘোষ এবং ডক্টরাল শিক্ষার্থী দেবাঞ্জন পাল কী কারণে গর্ত হয়েছে তা বোঝার জন্য একটি কম্পিউটার সিমুলেশন করেছেন।
গত ১৪ কোটি বছরে গ্র্যাভিটি হোলের চারপাশে কীভাবে টেকটনিক প্লেটগুলোর সম্ভাব্য স্থানপরিবর্তন হয়েছে তার ১৯টি পরিস্থিতি দুই গবেষক তৈরি করেন।
মে মাসে জিওফিজিক্যাল রিসার্চ লেটার্স-এ প্রকাশিত তাদের গবেষণায় দেখা গেছে, কেবল কয়েকটি পরিস্থিতি গ্র্যাভিটি হোল সৃষ্টির জন্য দায়ী হতে পারে। এবং সেগুলোর কোনটিতেই ওই হোলের সরাসরি নিচের কোনো বস্তুর কারণে নিম্ন মাধ্যাকর্ষণ তৈরি হয়নি।
বরং তারা খুঁজে পেয়েছেন, গর্তটি সম্ভবত কম-ঘনত্বের ম্যাগমার প্লুমের কারণে সৃষ্টি হয়েছে। ম্যাগমা হলো গলিত বা আধা-গলিত শিলা যা পৃথিবীর পৃষ্ঠের নিচে পাওয়া যায়।
স্টেইনবার্গার বলেন, এটি এমন কিছু যা আপনি আগে ভাবেননি। কারণ আপনার মনে হবে যে, নিচে অবশ্যই কিছু আছে।
১২ কোটি বছর আগে
গবেষণা অনুসারে, গ্র্যাভিটি হোল সৃষ্টির সবচেয়ে সম্ভাব্য ব্যাখ্যা ১২ কোটি বছর আগে গন্ডোয়ানা পৃথক হওয়ার সঙ্গে সম্পৃক্ত। গন্ডোয়ানা হলো একটি প্রাচীন অতিমহাদেশ। এটি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়া ও ভারতের সৃষ্টি হয়েছে।
ভারত আফ্রিকা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ইউরোপীয় প্লেটের মধ্যে পড়ার পর সেখানে থাকা টেথিস নামক মহাসাগরটি ভাগ হয়ে যায় এবং মহাদেশীয় প্লেটের মধ্যে চাপা পড়ে।
প্লেটের কিছু ক্ষুদ্র অংশ এখনও ভূমধ্যসাগরে বিদ্যমান, কিন্তু সেই প্লেটের বেশিরভাগই এখনো ধীরে ধীরে পূর্ব আফ্রিকার চারপাশে পৃথিবীর গভীর অভ্যন্তরে পুনরায় গলে যাচ্ছে।
স্টেইনবার্গার বলেন, এটি ভূপৃষ্ঠকে নিচে টেনে নিয়ে যায়। যার ফলে বিশাল এলাকাজুড়ে নিম্ন মাধ্যাকর্ষণ তৈরি হয়।
ভারতের ন্যাশনাল জিওফিজিক্যাল রিসার্চ ইনস্টিটিউট-এর বিজ্ঞানী হিমাংশু পাল বলেন, ভবিষ্যতের সমুদ্র জরিপগুলোয় এই প্লুমগুলো কেবল কম্পিউটার সিমুলেশনে নয়, বাস্তবেও বিদ্যমান কি না তা নিশ্চিত করতে হবে ।