ইউক্রেনীয় বৈশিষ্ট্যের ‘ওয়ার অ্যান্ড পিস’ কেন জটিল অঙ্ক!
রাশিয়ার শক্তিশালী প্রতিরোধ ব্যূহ ভেদ করে এগুতে পারছে না ইউক্রেনীয় বাহিনী, যুদ্ধের এই অচলাবস্থা নিয়ে ওয়াশিংটনের নীতিনির্ধারকদের সামান্য অংশকেই দুশ্চিন্তা করতে দেখা যাচ্ছে। একইসময়ে, আমেরিকার প্রশাসন মহাব্যস্ত অন্য এক খবরে – চীনের তৈরি করা এক জটিল ম্যালওয়্যার নিয়ে, যা নাকি আমেরিকার সাইবার ব্যবস্থায় বিপর্যয় ঘটাবে।
চীনা ম্যালওয়্যারের খবর প্রথম প্রকাশ করে দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস। মার্কিন সামরিক, গোয়েন্দা ও জাতীয় নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের বরাতে দৈনিকটির প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশ্বব্যাপী আমেরিকার সামরিক ঘাঁটিগুলোর বৈদ্যুতিক গ্রিড, যোগাযোগ, পানি সরবরাহ ব্যবস্থার নেটওয়ার্কে গোপন এই কোড লুকিয়ে রেখেছে চীন।
প্রভাবশালী দৈনিকটি জানায়, এই ম্যালওয়্যারের উপস্থিতি জানার পর থেকেই হোয়াইট হাউসের জরুরি অধিবেশন কক্ষে একের পর এক বৈঠক হচ্ছে। সমস্যার তীব্রতা ও তার সমাধানে করণীয় ঠিক করাই যার লক্ষ্য।
খবরে প্রকাশ, 'চীনের রাষ্ট্র-সমর্থিত হ্যাকারদেরই এজন্য দায়ী করেছে যুক্তরাষ্ট্রের সরকার ও মাইক্রোসফট। কিন্তু, কীভাবে এবিষয়ে তারা নিশ্চিত হয়েছে তার কোনো ব্যাখ্যা দেয়নি। চীনের অভিসন্ধি নিয়ে মার্কিন সরকারের বিভিন্ন দপ্তরের মধ্যে মতভেদ থাকলেও – ম্যালওয়্যারের উৎসের বিষয়ে তারা নিশ্চিত।'
এই ঘটনায় আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। অনেক বছর ধরেই চীনের সাইবার স্পেস সক্ষমতার উন্নতি দেখা যাচ্ছে। তবে এবারই প্রথম এত উচ্চ মাত্রার উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে – যা ইউক্রেন যুদ্ধে দীর্ঘ ছায়া ফেলে পরিস্থিতিকে নতুন মোড় দিতে পারে। ইউক্রেনের যুদ্ধক্ষেত্রে অদ্ভুত কিছু হচ্ছে, (পশ্চিমা ড্রোন ও মিসাইল অনায়সে ঘায়েল করছে রাশিয়া)- যার ব্যাখ্যাও হতে পারে চীনের এই সক্ষমতা।
হং নদীর যুদ্ধ
দৃশ্যপটে ছায়া ফেলেছে যে চীন, তারই প্রাচীন ইতিহাস থেকে একটি উদাহরণ টানা যাক। ৬৩৮ খ্রিষ্টাব্দে সং ও চু রাজবংশের মধ্যে একটি সংঘাত ছিল হং নদীর যুদ্ধ। চু সৈন্যরা নদী পাড়ি দিয়ে এপাড়ে আসছিল, আর তাদের মোকাবিলার জন্য সেনাদল নিয়ে প্রস্তুত ছিলেন সং রাজ্যের ডিউক জিয়াং। নদী পাড়ি দেওয়ার সময় চু সেনাদল কিছুটা অসংগঠিত অবস্থায় ছিল, তখনই তাদের ওপর হামলা করে জয় নিশ্চিত করতে চেয়েছিলেন সং সেনাপতি জিয়ু। কিন্তু, সেটা অন্যায্য হবে এমন যুক্তি দিয়ে তাকে নিবৃত্ত করেন জিয়াং। একসময় নদী পার করে সংগঠিত হয় চু সেনাদল। আর তখন তাদের ওপর হামলা করে সং সেনারা। কিন্তু, বিজয়লক্ষ্মী তখন হাতছাড়া, সং সেনারা পরাজিত হয়, ডিউক জিয়াং এই যুদ্ধে নিহত হন।
সামরিক ইতিহাসে নির্বুদ্ধিতার নিদর্শন হিসেবে এই ঘটনা স্মরণীয় হয়ে আছে – যা ইতিহাসের গতিপথকেই বদলে দিয়েছিল।
ফিরে আসি বর্তমানে। জানা যাচ্ছে, গত কয়েক সপ্তাহ ধরে মার্কিন গুপ্তচর সংস্থা সিআইএ'র পরিচালক উইলিয়াম বার্নস তার রুশ সমকক্ষদের জানাচ্ছেন যে, গত ২৩ জুন ওয়াগনার প্রধান ইয়েভগেনি প্রিগোঝিনের বিদ্রোহে যুক্তরাষ্ট্রের কোনো হাত ছিল না।
পলিটিকোর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, 'যুক্তরাষ্ট্রের সম্পৃক্ততা না থাকার বিষয়ে রাশিয়ার যেন কোনো সন্দেহ না থাকে, সেজন্যই যুদ্ধের এই গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে স্বপ্রণোদিত হয়ে এ বার্তা দিচ্ছে ওয়াশিংটন।'
দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমসের আরেকটি প্রতিবেদন জানায়, প্রিগোঝিনের বিদ্রোহের সুযোগ নিয়ে ইউক্রেনকে রাশিয়ার ওপর হামলা না করার পরামর্শও দেয় যুক্তরাষ্ট্র।
কিন্তু কেন? রুশ বাহিনী যখন বিদ্রোহের ঘটনায় বিভ্রান্ত, সেই ধাক্কা কাটিয়ে ওঠার আগেই প্রচণ্ড হামলা করাই কি উচিত হতো না ইউক্রেনের?
এটা সং রাজ্যের ডিউকের মতোই বোকামি কিনা – এই জিজ্ঞাসাই তাতে প্রবল হয়। নাকি আরও কোনো গূঢ় পরিকল্পনা রয়েছে।
বিদ্রোহ চলাকালে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার মধ্যে গোপন আলোচনার বিষয়ে নিশ্চিত করেছে এনবিসি ও দ্য গার্ডিয়ান। হয়তো সে আলোচনার অগ্রগতিকে ধূলিসাৎ করতে চায়নি ওয়াশিংটন।
এবিষয়ে মার্কিন ঐতিহাসিক ও সমর কৌশলবিদ অ্যাডওয়ার্ড লুটওয়াক আরও স্পষ্ট বলেছেন:
'পুতিন একটি আপোষ, মীমাংসায় আগ্রহী ক্রেমলিনের থেকে অবধারিত এমন ইঙ্গিত দেওয়া হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের সাথে বিবাদ মেটাতে তিনিই চূড়ান্ত পক্ষ।'
'গত সপ্তাহে সিআইএ প্রধান উইলিয়াম জে বার্নস শশব্যস্ত হয়ে রুশ গুপ্তচর প্রধান সের্গেই ইভানোভিচ নারিশকিনকে ফোন করেন। বার্নস তাকে আশ্বস্ত করে বলেন, প্রিগোঝিনের মস্কোমুখী যাত্রার পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের হাত ছিল না। এতে প্রমাণ হয়, ডেমোক্রেট দলের বামপন্থী অংশের চাওয়া যাই হোক না কেন, এই যুদ্ধের মাধ্যমে রাশিয়া অস্থিতিশীল হোক তা চায় না বাইডেন প্রশাসন।
'কারণ আমেরিকা স্পষ্টভাবেই জানে, রাশিয়ার শক্তি, সামর্থ্যের কারণেই মঙ্গোলিয়া, কাজাখস্তান, কিরগিজ প্রজাতন্ত্র, উজবেকিস্তান ও তাজিকিস্তানের মতো মধ্য এশিয়ার দেশগুলোর বিশাল অংশকে নিজ অধিকারে আনতে পারছে না চীন। তাছাড়া, সমুদ্র ও স্থলভাগে চীনের অনুপ্রবেশ ঠেকাতে লড়তে ইচ্ছুক দুটি দেশ – ভারত ও ভিয়েতনামে – এখনও যাচ্ছে রুশ অস্ত্র।
এই বাস্তবতায়, রাশিয়ার সাথে চলমান আলোচনা নিয়ে এক ধরনের মতৈক্য দেখা যাচ্ছে (ডেমোক্রেট ও রিপাবলিকানদের মধ্যে), এর প্রভাব এতটাই যে রক্ষণশীল থিঙ্ক ট্যাঙ্ক গেটস্টোন ইনস্টিটিউট এর সমালোচনা করে বলেছে:
'ইউক্রেনের অস্তিত্ব রক্ষার এই লড়াইয়ে সহায়তা দিতে তিনি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ – প্রকাশ্যে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এমন বার্তা দিলেও – নেপথ্যে চলছে অন্যকিছু। বাইডেন ও তার প্রশাসনের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা আগামী বছরের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগেই ভালোয় ভালোয় এই যুদ্ধের ইতি টানতেই বেশি আগ্রহী।'
'তারই ফলস্বরূপ, ইউক্রেনের ন্যাটো সদস্যপদ লাভে প্রকাশ্যে সমর্থন দিয়ে ক্রেমলিনকে নাখোশ করেনি ওয়াশিংটন। বরং, বাইডেন প্রশাসনের মূল লক্ষ্য চলতি বছরেই লড়াই বন্ধের সম্ভাব্য উপায় খুঁজে বের করা।'
'গত এপ্রিলে নিউইয়র্কে রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি বিশেষজ্ঞ ও সাবেক জাতীয় নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের এক গোপন বৈঠক হয়। এই ঘটনা সংঘাত অবসানে বাইডেনের তীব্র আকাঙ্খাকে তুলে ধরেছে। ওই বৈঠকের উদ্দেশ্যই ছিল, যুদ্ধের অবসানে ভবিষ্যৎ আলোচনার প্রাথমিক ভিত্তি-স্থাপন।'
'গোপন বৈঠকে চলমান সংঘাতের সবচেয়ে বিরোধপূর্ণ কিছু বিষয়– যেমন রুশ অধিকৃত ক্রিমিয়া উপদ্বীপের ভাগ্য নিয়েও আলোচনা হয়েছে।'
কৌশল ও কার্যপদ্ধতি
যুদ্ধক্ষেত্রের বর্তমান কার্যত অবস্থাও এই আলোচনার পেছনে ভূমিকা রাখছে। ইউক্রেনীয় বাহিনী নিঃশেষিত বলা যায়। সম্মুখসারির প্রতিরোধে ভেঙ্গে এগুতে তাদের আরও যুদ্ধবিমান, রণসরঞ্জাম দরকার। সঙ্গে চাই নতুন সেনাও, যে পরিস্থিতি সম্পর্কে ওয়াশিংটন ভালোভাবেই অবগত।