শর্টস পরে খেলার জন্য মারধরের পর এবার কিশোরী ফুটবলারদের অ্যাসিড ছোড়ার হুমকি দিচ্ছে অভিযুক্তরা
তাদের একমাত্র 'অপরাধ' ছিল আর দশজন ফুটবল খেলোয়াড়ের মতো তারাও শর্টস (হাফপ্যান্ট) পরে ফুটবল অনুশীলন করতেন। কেবল এ কারণেই তাদেরকে মারধর করা হলো।
ফলে অনূর্ধ্ব-১৭ বিভাগে খেলা এ ফুটবলারেরা নিজেদের জীবনের নিরাপত্তা নিয়ে এখন ভয়ে আছেন।
খুলনার বটিয়াঘাটায় চার কিশোরী ফুটবলারের ওপর হামলার ঘটনায় দুই নারীসহ ছয়জনকে আসামি করে একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। অভিযুক্তদের একজন আমিনুর রহমানকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। তবে এখনো হামলাকারীদের নিয়ে আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন ভুক্তভোগীরা।
ভুক্তভোগীদের একজন ১৭ বছর বয়সী সাদিয়া নাসরিন। পলাতক আসামীরা তার ও সতীর্থ খেলোয়াড়দের ওপর অ্যাসিড ছোড়ার হুমকিসহ নানাভাবে হুমকি দিচ্ছে অভিযোগ করে তিনি থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেছেন।
পলাতক আলাউদ্দিন, সালাউদ্দিন, নূপুর খাতুন, রঞ্জি বেগম ও মনোয়ারা বেগমকে গ্রেপ্তারে অভিযান চলছে বলে জানিয়েছে পুলিশ।
দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-এর সঙ্গে কথা বলার সময় সাদিয়া বলেন, অভিযুক্তরা প্রয়োজনে নিজেরা নিজেদেরকে আহত করে এবং নিজেদের বাড়িঘর ভাঙচুর করে সব খেলোয়াড় ও কোচের বিরুদ্ধে মামলা করবে বলেও হুমকি দিয়েছে।
এদিকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বলছে, ফুটবলারদের নিরাপত্তায় পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
বটিয়াঘাটা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শওকত কবির বলেন, 'আমরা মামলার মূল আসামীকে গ্রেফতার করেছি। এছাড়া ফুটবলার সাদিয়া হুমকি ও নিরাপত্তার কথা বলে থানায় জিডি করেছেন। আমি গতকাল বিকেলে ঘটনাস্থল এবং ঐ এলাকা পরিদর্শন করেছি। নারী ফুটবলারেরা নির্বিঘ্নে প্রশিক্ষণ নেবে। তাদের সম্পূর্ণ নিরাপত্তার দায়িত্বে রয়েছে পুলিশ।'
গত ২৯ জুলাই রাতে এ মামলার আসামিরা কিশোরী ফুটবলারদের ওপর হামলা চালায়।
ঘটনার পরদিন সাদিয়া নাসরিন বাদী হয়ে ছয়জনের নাম উল্লেখ করে থানায় মামলা করেন।
সমালোচনা থেকে সহিংসতা
সাদিয়া নাসরিন বলেন, তিনি প্রায়ই সামাজিক কটূক্তির শিকার হতেন। কিন্তু শুধু ফুটবলের প্রতি ভালোবাসার জন্য তিনি ও তার সতীর্থরা বটিয়াঘাটা উপজেলার তেঁতুলতলা গ্রামের 'সুপার কুইন ফুটবল অ্যাকাডেমি' থেকে প্রশিক্ষণ নেওয়া ছেড়ে দেননি।
সাদিয়া নাসরিনসহ খুলনা জেলার অনূর্ধ্ব-১৭ দলের বেশ কয়েকজন নারী ফুটবলার সেখানে প্রশিক্ষণ নেন।
তাদের পোশাক প্রসঙ্গে প্রায়ই সমালোচনা ও কটূক্তির শিকার হতেন তারা।
আর এ ধরনের সমালোচনাই গত ২৭ জুলাই হিংসাত্মক রূপ নেয়।
আর সব দিনের মতো সেদিনও যথারীতি কিশোরীরা অ্যাকাডেমির মাঠে অনুশীলন করছিলেন।
সেসময় স্থানীয় নূপুর খাতুন ফুটবলারদের অনুমতি ছাড়াই ছবি তোলেন বলে টিবিএসকে বলেন সাদিয়া।
'সে আমার বাড়িতে গিয়ে বাবা-মাকে ওই ছবি দেখিয়ে বিভিন্ন ধরনের আজেবাজে মন্তব্য করে আসে। শনিবার বিকেলে তার কাছে আমি বিষয়টি নিয়ে জিজ্ঞেস করলে, সে অকথ্য ভাষায় আমাকে গালিগালাজ করে।
'আমি এর প্রতিবাদ করলে সে এলোপাথাড়িভাবে আমাকে মেরে আহত করে,' বলেন সাদিয়া।
সাদিয়া তার বাবা-মা, ক্লাবের কোচসহ অন্যান্য খেলোয়াড়দেরকে ঘটনাটি জানান।
'তারা আমাকে নিয়ে সন্ধ্যা ৭টার দিকে নূপুর খাতুনের বাড়িতে যায়। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে ওই বাড়ির আলাউদ্দিন, সালাউদ্দিন, নূর আলম, রঞ্জি বেগম ও মনোয়ারা বেগম আমাদের ওপর হামলা করে। এতে আমি ছাড়াও আমার বান্ধবী মঙ্গলী বাগচী, হাজেরা খাতুন ও জুই মণ্ডল আহত হন। হামলাকারীরা লোহার রড দিয়ে আমাদের ওপর হামলা চালায় এবং চাইনিজ কুড়াল নিয়ে এসে হত্যার হুমকি দেয়,' হামলার ঘটনার প্রসঙ্গে সাদিয়া বলেন।
চার কিশোরীর মধ্যে সবচেয়ে বেশি আহত হন মঙ্গলী বাগচী।
তিনি বলেন, 'আমি অজ্ঞান হয়ে পড়ি। জ্ঞান ফিরলে দেখি চেয়ারের সঙ্গে আমার হাত বাঁধা।'
'হামলাকারীরা বলে, আমাদের কোনো লজ্জা-শরম নেই এবং মেয়ে হয়ে হাফপ্যান্ট পরে ফুটবল খেললে গ্রাম থেকে বের করে দেবে,' বলেন মঙ্গলী। হামলাকারীরা তাকে সাম্প্রদায়িক কটূক্তি করেছিল বলেও জানান তিনি।
পরে স্থানীয় ক্লাবের সদস্যরা তাকে উদ্ধার করে বটিয়াঘাটা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যান।
বটিয়াঘাটা উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা মিজানুর রহমান বলেন, মঙ্গলী বাগচীর মাথায় ক্ষত হয়েছিল। তবে তিনি জানান, হামলার শিকার চার কিশোরী ফুটবলার এখন আশঙ্কামুক্ত রয়েছেন।
খেলা ছাড়বেন না কিশোরীরা
সাদিয়া নাসরিন বলেন, 'দীর্ঘদিন ধরে আমরা সামাজিকভাবে কটূক্তির শিকার হয়ে আসছি। তবে ফুটবলের প্রতি ভালবাসার জন্য খেলা বা অনুশীলন ছাড়িনি।'
টিবিএস-এর সঙ্গে আলাপকালে কান্নারত মঙ্গলী বাগচী বলেন, 'অতীতে ফুটবল খেলা নিয়ে অনেক কটূক্তির শিকার হয়েছি। এবার আহত করা হলো। হত্যার হুমকিও দেওয়া হলো। তবে আমি খেলা ছেড়ে দেব না। যতই বাধা আসুক, ফুটবলের সঙ্গে থাকব।'
পোশাকের জেরে কটূক্তি-হামলা
ফুটবলারদের অভিভাবকেরাও জানেন তাদের সন্তানদের কী অবস্থার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। কিন্তু তারাও প্রায়ই এসব পরিস্থিতিতে অসহায় থাকেন।
মঙ্গলী বাগচীর মা সুচিত্রা বাগচী বলেন, 'কেবল ফুটবল খেলা নিয়ে আমাদের মেয়েদের নানা কটূক্তির শিকার হতে হয়। তাই অতীতে মেয়েদের নানাভাবে বুঝিয়েছি ফুটবল বাদ দিতে। মঙ্গলী খেলতে আগ্রহী বলে তাকে অ্যাকাডেমিতে ভর্তি করিয়ে দিয়েছিলাম।'
তিনি বলেন, 'আমাদের মেয়েদের ওপর অমানবিক নির্যাতন করা হলো। মেয়েদেরকে বলেছি ফুটবল ছেড়ে দিতে, কিন্তু তারা তো নাছোড়বান্দা — ফুটবল খেলবেই।'
ফুটবলার সাদিয়া নাসরিন বলেন, গ্রামের সব মানুষ তাদের বিরোধিতা করেন না। বরং বেশিরভাগ মানুষ তাদের ফুটবলচর্চাকে উৎসাহিত করেন। কিন্তু এবার বিরোধিতা মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে।
তেঁতুলতলা সুপার কুইন ফুটবল অ্যাকাডেমির সভাপতি দিলীপ বৈরাগী বলেন, 'বঙ্গমাতা গোল্ডকাপে বারবার জেলা চ্যাম্পিয়ন হয়ে বিভাগীয় পর্যায়েও খুব ভালো ফল করছিল তেঁতুলতলা স্কুলের শিক্ষার্থীরা। কিন্তু উপযুক্ত প্রশিক্ষণ ও অন্যান্য সুবিধা ঠিকমতো না পাওয়ায় অনেকেই পরে ঝরে যেতে থাকে।
'এলাকার মেয়েদের ফুটবল নিয়ে ভালো কিছু করার তাগিদে চলতি বছরের শুরুর দিকে তেঁতুলতলা প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে অ্যাকাডেমির কার্যক্রম শুরু হয়। পরে আর্থিক সংকটে এটি বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল। তখন বটিয়াঘাটা উপজেলা চেয়ারম্যান আশরাফুল আলম খাঁন এগিয়ে এসে তাদের পাশে দাঁড়ান। তিনিই ক্লাবের সকল খরচ বহন করেন। স্থানীয় রাজনৈতিক ও প্রশাসিকভাবে এ মেয়েদের সব রকমের সহায়তা করা হয়।'
অ্যাকাডেমির প্রশিক্ষক মোস্তাক হোসেন বলেন, বটিয়াঘাটা উপজেলা ছাড়াও পাশের উপজেলা থেকে নারী খেলোয়াড়েরা এখানে এসে প্রশিক্ষণ নেন।