আম্পানে সারা দেশে পৌনে ২ লাখ হেক্টর জমির ফসল নষ্ট: কৃষিমন্ত্রী
ঘূর্ণিঝড়ে আম্পানে সারা দেশের ১ লাখ ৭৬ হাজার ৭ হেক্টর জমির বিভিন্ন ফসল নষ্ট হয়েছে বলে জানিয়েছেন কৃষিমন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাক। তবে বোরো ধানের বেশির ভাগ ঘরে আসায় খাদ্য উৎপাদনে তেমন প্রভাব পড়বে না বলে দাবি করেছেন তিনি।
মন্ত্রী বলেন, 'ইতোমধ্যে হাওড়ে শতভাগ, উপকূলীয় অঞ্চলের ১৭ জেলায় শতকরা ৯৬ ভাগসহ সারা দেশে গড়ে ৭২ শতাংশ বোরো ধান কর্তন করা হয়েছে। ফলে, ক্ষতির পরিমাণ সামান্য যাতে আমাদের খাদ্য উৎপাদনে তেমন প্রভাব পড়বে না।'
বৃহস্পতিবার বিকালে ঘূর্ণিঝড় আম্পান পরবর্তী অনলাইন প্রেস ব্রিফিংয়ে কৃষিমন্ত্রী সাংবাদিকদের এসব তথ্য জানান।
মন্ত্রী বলেন, 'সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে সাতক্ষীরার আম বাগানের। সাতক্ষীরার মোট ৪ হাজার হেক্টর আম চাষের মধ্যে মাত্র ১ হাজার হেক্টর থেকে আম তুলতে পেরেছিল চাষিরা।'
সাতক্ষীরা সদর উপজেলার লিয়াকত হোসেন ১৪ বিঘা জমিতে আম চাষ করেছিলেন। সুপার সাইক্লোন আম্পানে তার বাগানের ৯০ শতাংশ আম ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বাগানের বেশিরভাগ আম ঝড়ো বাতাসে পড়ে গেছে, বেশ কিছু গাছ নষ্ট হয়েছে বলে জানান তিনি।
সাতক্ষীরা সদর উপজেলার ১২৩৫ হেক্টর জমিতে আম চাষ করা হয়েছে। যার ৮৩ শতাংশ জমির আম ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে পুরো সাতক্ষীরা জেলায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে সেখানে আমিরাবাদ হয়েছিল ৪১১০ হেক্টর জমিতে। এরমধ্যে প্রায় ১২০০ হেক্টর জমির আম তুলে ফেলা হয়েছে। বাকি জমির ৭০ শতাংশ আম-ই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
কাঁচা এসব আম ঝড়ে পড়ায় বিপদে পড়া কৃষকদের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছেন কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক। এসব আম স্থানীয় পর্যায়ে বিপণনের ব্যবস্থা করার পাশাপাশি দেশের বড় দুটি অ্যাগ্রো বিজনেস প্রতিষ্ঠান এসিআই ও প্রাণ আরএফএলের কাছে তা বিক্রির ব্যবস্থা করা হবে বলেও জানিয়েছেন তিনি।
কৃষিমন্ত্রী মো. আব্দুর রাজ্জাক অনলাইনে এক সংবাদ সম্মেলনে জানান, সারাদেশে ৭৩৮৪ হেক্টর জমির ১০ শতাংশ আম নষ্ট হয়েছে। রাজশাহী বাঘা চারঘাট একটি জায়গায় তুলনামূলক বেশি ক্ষতি হয়েছে। তবে সাতক্ষীরায় এই হার ৬০-৭০ শতাংশ।
তিনি বলেন,সাতক্ষীরাতে যে আমগুলো পড়ে গেছে সেগুলো পরিপক্ক। আগাম আসা সাতক্ষীরার এই আমগুলো ২-৩ দিন ঘরে রাখলেই পেঁকে যাবে। তবে আমরা প্রাণ এসিআই এর মত কোম্পানি গুলোর সাথে আলাপ করেছি। যাতে তারা আচারের জন্য এই আম গুলো কিনে নেয়।
সরকারের পক্ষ থেকে দেয়া হলে কিনে নিতে আপত্তি নেই বলে জানিয়েছে কোম্পানিগুলোও।
প্রাণ-আরএফএলের পরিচালক (বিপণন) কামরুজ্জামান কামাল দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড কে বলেন, আমরা মূলত কাঁচাপাকা দুই ধরনের আম কিনি। আমরা কয়েক দিন ধরেই কাঁচা আম কেন শুরু করেছি। সরকার যদি আমাদেরকে এসব আম কিনতে বলে তাহলে আমরা সে বিষয়টি বিবেচনা করে দেখব। আমের মান ঠিক থাকলে আমাদের কিনতে অসুবিধা নেই।
তবে শুধু আম বিক্রির ব্যবস্থা করলে কৃষকরা ক্ষতিপূরণ পাবেন না বলে জানিয়েছেন কৃষি অর্থনীতিবিদরা।
ড. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, আমসহ সব ফসলের যে ক্ষতি হয়েছে সামগ্রিকভাবে সেটা খুব বড় ক্ষতি নয়। তবে স্থানীয়ভাবে একজন কৃষকের কথা চিন্তা করলে তার জন্য অনেক বড় ক্ষতি। এজন্য ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের তালিকা করে শুধু তাদের জন্য একটা আলাদা প্ল্যান করতে হবে।
এই প্ল্যানের আওতায় নগদ সহায়তা, খাদ্য সহায়তা দিতে হবে। একই সাথে যাতে তারা পরবর্তী সময় আবার চাষাবাদ শুরু করতে পারে সেজন্য তাদেরকে বীজ, সার থেকে শুরু করে বিভিন্ন প্রণোদনা দিতে হবে।
সারা দেশের মোট ৪৬ টি জেলার উপর দিয়ে বয়ে গেছে ঘূর্ণিঝড় আম্পান। তবে এরমধ্যে ১৭টি জেলা উল্লেখযোগ্যভাবে আক্রান্ত হয়েছে। সারাদেশে আক্রান্ত কৃষি জমির পরিমাণ ১ লাখ ৭৬ হাজার হেক্টর।
বিভিন্ন জেলার কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ঘূর্ণিঝড় আম্ফানে বিভিন্ন জেলায়, সবজি, আম বাদাম, আউশের বীজতলা, মরিচ, পানের বরজ, , কলা, তিল সহ নানা কৃষিপণ্যের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।
সাতক্ষীরাতে শুধু আমের পাশাপাশি সবজিরও ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। পুরো জেলায় ২০৭২ হেক্টর জমির সবজি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সারাদেশে ৪১ হাজার ৯৬৭ হেক্টর সবজির আবাদি জমির ২৫ শতাংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
সাতক্ষীরা জেলার কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ মোঃ নুরুল ইসলাম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড কে বলেন, সাতক্ষীরাতে সবজি এবং আমের সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে। এর পাশাপাশি পান ও তিলের আবার কিছুটা ক্ষতির মুখে পড়েছে।
জানা গেছে পটুয়াখালীর ১৪৬ হেক্টর ও বাগেরহাটের আউশের বীজতলা নষ্ট হয়েছে। এছাড়া পটুয়াখালীর ৮৬ হেক্টর জমির বোরো ধান, ১০৪৪ হেক্টর জমির মরিচ, ১৪৬০ অ্যাক্টর জমির শাক সবজি, ১৪৯ হেক্টর জমির সবজি আক্রান্ত হয়েছে বলে জানা গেছে।
সারাদেশে মোট ৭২ শতাংশ ধান কাটা হয়ে গেছে। তবে সর্বোচ্চ আক্রান্ত এলাকা খুলনায় ৯৭ শতাংশ, সাতক্ষীরায় 90 শতাংশের বেশি ধান কাটা হয়েছে। বাকি ধানগুলো আক্রান্ত হলেও কয়েকদিন পরে এই ধান গুলো কাটা যাবে। ভোলাতে ও কিছু পরিমাণ ধান কাটার বাকি রয়েছে, যা পরে কাটা যাবে।
এরপরে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে কাঁচা মরিচের আবাদ। আক্রান্ত জেলা গুলোর ৩৩০৬ হেক্টর জমির মোট ৩০ শতাংশ আক্রান্ত হয়েছে, যাতে বেশ বড় ধরনের ক্ষতির ধারণা করা হচ্ছে।
পটুয়াখালীতে শতভাগ মুগ ডাল তোলা হলেও রাজশাহী ও চুয়াডাঙ্গা অঞ্চলে কিছুটা ক্ষতি হয়েছে। এর বাইরে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে পানে। মোট আবাদী জমির প্রায় ১৫ শতাংশ নষ্ট হয়েছে বলে জানা গেছে।
এছাড়া আক্রান্ত এলাকাগুলোর চীনা বাদামে ও তিলে ২০ শতাংশ হারে, ভুট্টা ও পাটে ৫ শতাংশ হারে, লিচুতে ৫ শতাংশ এবং ১০ শতাংশ কলার আবাদি জমির ক্ষতি হয়েছে।
যেকোনো ঘূর্ণিঝড়ে কৃষিতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয় উল্লেখ করে মন্ত্রী বলেন, 'এবার ঘূর্ণিঝড়ের খবর পেয়ে আমাদের মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তারা ১৫ মে থেকে সচেতন ছিলেন। আমাদের আগাম প্রস্তুতি থাকার কারণে তুলনামূলক কম ক্ষতি হয়েছে।'
কোন ফসলের কতটুকু ক্ষতি হয়েছে: মন্ত্রীর দেয়া তথ্যানুসারে দেশের ১ লাখ ৭৬ হাজার ৭ হেক্টর জমিতে বিভিন্ন ফসলের ক্ষতির মধ্যে- বোরো ধান ৪৭ হাজার ২ হেক্টর (শতকরা ১০ ভাগ), ভুট্টা ৩ হাজার ২৮৪ হেক্টর (৫ ভাগ), পাট ৩৪ হাজার ১৩৯ হেক্টর (৫ ভাগ), পান ২ হাজার ৩৩৩ হেক্টর (১৫ ভাগ), সবজি ৪১ হাজার ৯৬৭ হেক্টর (২৫ ভাগ), চিনাবাদাম ১ হাজার ৫৭৫ হেক্টর (২০ ভাগ), তিল ১১ হাজার ৫০২ হেক্টর (২০ ভাগ), আম ৭ হাজার ৩৮৪ হেক্টর (১০ ভাগ), লিচু ৪৭৩ হেক্টর (৫ ভাগ), কলা ৬ হাজার ৬০৪ হেক্টর (১০ ভাগ), পেঁপেঁ ১ হাজার ২৯৭ হেক্টর (৫০ ভাগ), মরিচ ৩ হাজার ৩০৬ হেক্টর (৩০ ভাগ), সয়াবিন ৬৪০ হেক্টর (৫০ ভাগ), মুগডাল ৭ হাজার ৯৯৭ হেক্টর (৫০ ভাগ) এবং আউশ ৬ হাজার ৫২৮ হেক্টর জমির ফসল আক্রান্ত ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
এক প্রশ্নের জবাবে কৃষিমন্ত্রী বলেন, 'এটি প্রাথমিক তথ্য। চূড়ান্ত ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ আগামী ২-৩ দিনের মধ্যে দিতে পারব।'
আম্পানের প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত চাষিদের বিনামূল্যে সার, বীজ ও নগদ সহায়তাসহ বিভিন্ন প্রণোদনা দেয়া হবে বলে জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, 'ঘূর্ণিঝড় আম্পানের প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত শাকসবজি ও মসলা চাষিদের তালিকা প্রণয়ন করে তাদের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে আমন মৌসুমে বিনামূল্যে সার, বীজ ও নগদ সহায়তাসহ বিভিন্ন প্রণোদনা প্রদান করা হবে।'
এছাড়াও, ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক, ফল ও পান চাষিদের মাত্র ৪ শতাংশ সুদে কৃষি ঋণের আওতায় অন্তর্ভুক্ত করা হবে বলেও জানান তিনি।