গরমে প্রশান্তি মানেই রুহ আফজা! দক্ষিণ এশিয়াজুড়ে এখনও রাজত্ব করছে শতবর্ষী এই পানীয়
প্রচণ্ড গরমের এক বিকেলে পুরনো দিল্লিতে বিশাল এক বরফের চাঁই নিয়ে ছুরি দিয়ে সেটা ভাঙছিলেন আবদুল ওয়াহিদ। আর সেই বরফ রাখা ছিল গাঢ় লাল রঙের এক তরলভর্তি পাত্রের মধ্যে। ওয়াহিদ এই ঠাণ্ডা পানীয়টি গ্লাসে ঢেলে পরিবেশ করছিলেন তার ক্রেতাদের। স্পিকারে বাজতে থাকা হিন্দি ভাষার বিজ্ঞাপনে এই পানীয়কে 'গরমের দিনের প্রশান্তি' বলে গুণগান করা হচ্ছিল।
ফুলের সুবাসমিশ্রিত, মিষ্টি, সতেজ ও প্রাণ জুড়িয়ে দেওয়ার মতো এই পানীয়র নাম 'রুহ আফজা'। উর্দু ভাষায় এর আক্ষরিক অর্থ 'আত্মা পুনরুজ্জীবিত করে যা'। প্রায় এক শতাব্দী ধরে দক্ষিণ এশিয়াজুড়ে গ্রীষ্মকালে সবচেয়ে জনপ্রিয় পানীয় হিসেবে রাজত্ব করে আসছে রুহ আফজা।
ঘন, লাল সিরাপের মতো এই তরলকে 'প্রাচ্যের গ্রীষ্মকালীন পানীয়' হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়েছে। তবে সাধারণত রুহ আফজা পানি বা দুধের সঙ্গে মিশিয়েই খাওয়া হয়, অথবা কোনো ডেজার্টে ব্যবহার করা হয়। যেখানে রুহ আফজার উৎপত্তি, সেই দিল্লির বাসিন্দারা সারা গ্রীষ্মজুড়ে তাদের ফ্রিজে মজুদ করে রাখেন বোতলের পর বোতল রুহ আফজা। এছাড়া, মুসলিমদের পবিত্র রমজান মাসে এই পানীয়র জনপ্রিয়তা আকাশচুম্বী। সারাদিন রোজা রাখার পর সন্ধ্যায় ইফতারের সময় রুহ আফজার শরবত ও খেজুর দিয়ে রোজা ভাঙেন রোজাদারগণ।
দিল্লির এক ফুড ক্রিটিক মারিয়াম রেশাই বলেন, "গ্রীষ্মকালে পাখির ডাক আর রুহ আফজা, দুটোই আমাকে নাড়িয়ে দেয়।" মারিয়াম জানান, তিনি ষাটের দশক থেকে এই পানীয়টির ভক্ত। "আপনি কারো বাড়িতে যান, দেখবেন সবার আগে লম্বা গ্লাসে করে রুহ আফজার শরবত পরিবেশন করা হবে- আর এর স্বাদ আপনাকে মুহূর্তের মধ্যে যেন অন্য এক জগতে নিয়ে যাবে", বলেন মারিয়াম।
তবে শুরুতে রুহ আফজা তৈরি করা হয়েছিল গরমের মধ্যে রোগীদের প্রশান্তি দেয় ও মন চাঙ্গা করে তোলে, এমন একটি শরবত বানানোর পরিকল্পনা থেকে। ১৯০৭ সালে দিল্লির একজন ইউনানী চিকিৎসক, হাকিম হাফিজ আব্দুল মাজিদ প্রচণ্ড গরম থেকে তার রোগীদের আরাম দেওয়ার জন্য একটি ফর্মুলা উদ্ভাবন করেন।
হাকিম মাজিদ তার রুহ আফজার জন্য বিভিন্ন ভেষজ গাছ, ফল, ফুল, এমনকি শাকসবজিও ব্যবহার করছিলেন। গোলাপের পাপড়ি, পুদিনা, 'খাস' নামের এক ধরনের সুগন্ধি ঘাষ ইত্যাদি যোগ করেছিলেন তিনি এই সিরাপ তৈরিতে। এগুলোকে নিংড়ে সেখান থেকে যে ঘনীভূত পদার্থ পাওয়া গেল, তাকেই পানি বা অন্য কোনো তরলের সাথে মিশিয়ে রুহ আফজা পান করা হতো। তবে শোনা যায়, মোটামুটি ২১টি বিভিন্ন রকমের গাছগাছড়া, ফুলফলের উপাদান ব্যবহার করেছিলেন আবদুল মাজিদ রুহ আফজা তৈরি করার জন্য।
কিছুদিনের মধ্যেই আব্দুল মাজিদের তৈরি এই সিরাপ ক্রেতারা এতই পছন্দ করলো যে তার ছোট্ট দোকানের তাক ভর্তি হয়ে গেল লাল রঙের এই সিরাপে। আব্দুল মাজিদের সেই ছোট্ট দোকানই আজ হামদর্দ ল্যাবরেটরিজ হিসেবে পরিচিত।
১৯২২ সালে আব্দুল মাজিদ মারা যান। এরপর তার স্ত্রী রাবিয়া বেগম দাওয়াখানার ভার তুলে নেন নিজের হাতে। তিনি হামদর্দকে একটি ওয়াকফ হিসেবে ঘোষণা করেন। এটি একটি ইসলামিক দাতব্য প্রতিষ্ঠানে রূপ নেয়। আরও কয়েক বছর পরে বড় ছেলে আবদুল হামিদ হামদর্দের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন।
পরিবারের ছোট ছেলে মোহাম্মদ সাইদ ইস্টার্ন মেডিসিন বিষয়ে পড়াশোনা করেন। দেশভাগের পরে ১৯৪৮ সালে সাইদ পাকিস্তান চলে যান। তখনো ভারতে হামদর্দ কোম্পানির দায়িত্বে বড় ভাই হামিদ। পাকিস্তানে হামদর্দ প্রতিষ্ঠা করেন সাইদ।
দুটি ব্যবসাই স্বতন্ত্রভাবে পরিচালিত হলেও, দুটির পণ্য 'প্রায় একই' বলে মন্তব্য করেন মাজিদের প্রপৌত্র এবং হামদর্দ ইন্ডিয়া'র খাদ্য বিভাগের সিইও হামিদ আহমেদ।
বর্তমানে হামদর্দ ইন্ডিয়ার বার্ষিক টার্নওভার ৭০ মিলিয়ন ডলার। ২০২০ সালে কোম্পানিটি জানিয়েছিল, শুধুমাত্র রুহ আফজা বিক্রি করেই তারা ৩৭ মিলিয়ন ডলারের বেশি আয় করেছিল।
১৯৪৮ সালে একটি দাতব্য সংস্থা প্রতিষ্ঠা করা হয় এবং হামিদ আহমেদ জানান, 'এখনও পর্যন্ত আমাদের লাভের ৮৫ শতাংশ দাতব্য সংস্থায় যায়।' হামদর্দ পাকিস্তান-এর ক্ষেত্রেও একই নিয়ম প্রযোজ্য।
আহমেদ জানান, বর্তমানে রুহ আফজার মধ্যে ২০টি উপাদান যোগ করা হয়। চিনি এবং ১০টি ভেষজের পাতন এই রেসিপির মূল অংশ যা তারা গোপন রেখেছে; তবে ধনিয়া, সুগন্ধি স্ক্রুপাইন, চিকোরি, স্টোন ফ্লাওয়ার এবং ফলের রস এর মধ্যে রয়েছে বলে জানা যায়। পানীয়টি খাবারের রঙ থেকে তার আকর্ষণীয় লাল রঙ পায়। আর ফুড কালারিং এর মাধ্যমে এই পানীয়র টকটকে লাল রঙ নিয়ে আসা হয়।
বর্তমানে রুহ আফজা হামদর্দের সবচেয়ে জনপ্রিয় একটি পণ্য এবং ভারতে তাদের মোট ব্যবসার ৬০ শতাংশই এই পানীয়কে ঘিরে, বলেন আহমেদ। তার ভাষ্যমতে, "প্রতিবছর ভারতে ৯০০ মিলিয়ন গ্লাস রুহ আফজা পান করেন ভোক্তারা।"
গ্রীষ্মকালকে সামনে রেখে তাদের রুহ আফজা উৎপাদন শুরু হয় জানুয়ারি মাসে। এপ্রিল এবং মে মাসে যখন প্রচণ্ড গরম পড়ে তখন এটির চাহিদা বেড়ে যায়।
"গরমের এই মৌসুমে যখন চাহিদা সবচেয়ে বেশি থাকে, তখন প্রতিদিন ফ্যাক্টরি থেকে ২০-২৫ ট্রাক করে রুহ আফজা যায়।" জুন মাস পর্যন্ত তাদের রুহ আফজা উৎপাদনের কাজ চলে। এরপরে রক্ষণাবেক্ষণের জন্য উৎপাদন বন্ধ রাখা হয়।
আহমেদ জানান, গতবছর ৪০ মিলিয়ন বোতল রুহ আফজা উৎপাদন করেছেন তারা।
রুহ আফজার সবচেয়ে বড় পরীক্ষা ছিল '৪৭-এর দেশভাগের পরেও টিকে থাকা। দিল্লী থেকে শুরু হলেও রুহ আফজা পরবর্তী সময়ে পাকিস্তান ও বাংলাদেশেও ব্যবসা শুরু করে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হলে রুহ আফজা বাংলাদেশে আলাদা করে ব্যবসা আরম্ভ করে।
তবে বাংলাদেশে গরমের সময়ে ততটা না হলেও, রমজান মাসে রুহ আফজার চাহিদা অনেক বেড়ে যায়। অনেকেরই প্রতিদিনকার ইফতারের মেন্যুতে থাকে রুহ আফজা দিয়ে তৈরি শরবত। রুহ আফজা আর পানি বা দুধ মিশিয়ে ফ্রিজে অনেকক্ষণ রেখে খেলে এক মুহুর্তেই শরীর-মন চাঙ্গা হয়ে ওঠে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশে রুহ আফজার ভক্তরা।
ক্লাসিক রুহ আফজা যা ২৫ আউন্সের বোতলে করে বিক্রি হয়, তা এখনও বয়স্কদের মধ্যে বেশ জনপ্রিয়। তবে তরুণ ক্রেতাদের কথা ভেবে হামদর্দ রুহ আফজাকে নতুনভাবে পরিবেশনের কথা ভাবছে। এরই মধ্যে তারা রেডি-টু-ড্রিংক ভার্সন এবং জুসের সাথে মেশানো রুহ আফজা ফিউশন ড্রিংক নিয়ে এসেছে। এছাড়াও, সুগার ফ্রি রুহ আফজা এবং রুহ আফজা মিল্কশেকও রয়েছে।
চলার পথে যারা রুহ আফজার স্বাদ নিতে চান, তাদের জন্যও স্যাশেতে পাওয়া যাচ্ছে রুহ আফজা। হামিদ আহমেদ বলেন, "আমাদের রুহ আফজার স্যাশেও রয়েছে। আপনি যখন খুশি তখনই একটা পানির বোতল খুলে শুধু একটা স্যাশে ঢেলে দিয়ে ঝাঁকিয়ে নিলেই তৈরি হয়ে যাবে এই শরবত।"
রুহ আফজা তৈরির সবচেয়ে প্রচলিত উপায় হচ্ছে দুধ বা পানির মধ্যে দুই চামচ রুহ আফজা মিশিয়ে খাওয়া- যদিও এর মধ্যে কোনটা ভাল তা নিয়ে রুহ আফজাপ্রেমীদের মধ্যে বিতর্ক রয়েছে। তবে হামিদ আহমেদ জানান, তিনি নিজে আরেকটু ভিন্নভাবে এই পানীয়টি পান করতে পছন্দ করেন।
তিনি বলেন, "সোডা এবং একটু লেবুর রসের সাথে রুহ আফজা মিশিয়ে খাওয়াই আমার কাছে সবচেয়ে আদর্শ পানীয় মনে হয়।"
ফুড ক্রিটিক মারিয়াম রেশাই বলেন, আপনি চাইলে এর মধ্যে সবজা বা ব্যাসিল সিডও মেশাতে পারেন। ব্যাসিল সিড চিয়া সিডের মতোই, কিন্তু এটা দ্রুত পানি শুষে নেয় এবং ফুলে ওঠে। এটি ফাইবার ও খনিজে সমৃদ্ধ। দক্ষিণ এশিয়ার অনেক পানীয় এবং ডেজার্ট ঘন করতে এই উপকরণ ব্যবহৃত হয়।
অভিজ্ঞ রাঁধুনীরা অবশ্য ককটেল থেকে শুরু করে ফালুদা পর্যন্ত, হরেক রকম রেসিপিতে রুহ আফজা ব্যবহার করেন। বিশেষ করে রাইস নুডলস এবং আইসক্রিম ও ফলের সহযোগে বানানো ফালুদায় প্রায়ই রুহ আফজার ব্যবহার দেখা যায়।
পুরনো দিল্লিতে 'শরবত-এ-মোহাব্বত' নামের একটি সুস্বাদু পানীয়তেও রুহ আফজা ব্যবহার করা হয়। সাম্প্রতিক সময়ে এই শরবত ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে। তরমুজ কুচি, বরফ, দুধ এবং রুহ আফজা মিশিয়ে এই শরবত বানানো হয়।
কিন্তু সারাদিন ধরে এই শরবত বানালেও, অন্তত একজন বিক্রেতা স্বীকার করেছেন যে, তার কাছে রুহ আফজা তেমন ভালো লাগে না। আর তিনি একা নন, রুহ আফজা অপছন্দ করেন এমন অনেকেই আছেন।
কেউ কেউ মনে করেন, রুহ আফজা খুবই মিষ্টি এবং এত চিনিযুক্ত শরবত পান করা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতকর। আবার ফুড ক্রিটিক মারিয়াম রেশাইও তার ডায়াবেটিসের কারণে ১০ বছর আগে রুহ আফজা খাওয়া বাদ দিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু তিনি বলেন, এরপর থেকে গ্রীষ্মকালের আমেজই আর আগের মতো নেই তার কাছে।
আবার পুরনো দিল্লির কেউ কেউ জানান, তারা রুহ আফজার চেয়ে লেমোনেড বেশি পছন্দ করেন। তাছাড়া, বাজারে নানা ব্র্যান্ডের কোমল পানীয় এবং কার্বোনেটেড জুসে সয়লাভ হয়ে যাওয়ায় রুহ আফজার প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়েছে।
কিন্তু তবুও মারিয়াম মনে করেন, রুহ আফজা হারিয়ে যাবে না। "প্রত্যেক পণ্যেরই চাহিদা বাড়ে, আবার কমে। কিন্তু এতগুলো বছর পরেও সব ঝড়-ঝঞ্ঝা সহ্য করে টিকে আছে রুহ আফজা।
পুরনো দিল্লির ঐতিহাসিক জামা মসজিদের বাইরে বাজারে রুহ আফজা বিক্রেতা ওয়াহিদ নিজেই দেখেছেন রুহ আফজার ব্যবসার উত্থান-পতন। তিন প্রজন্ম ধরে তার পরিবার এই দোকান চালাচ্ছে, যেখানে গত ১৫ বছর ধরে তিনি রুহ আফজা বিক্রি করছেন। তিনি বলেন, "যারা একবার রুহ আফজা খায়, তারা বারবার এর কাছেই ফিরে আসে।"