মিম বানিয়ে টু-পাইস: বিনোদনের খোরাক মিম এখন অনেকের পকেট খরচের উৎস
আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে তামিম ইকবাল পদত্যাগের ঘোষণা দেওয়ার পর বিসিবি প্রধান নাজমুল হাসান পাপন বলেছিলেন: 'নিজে থেকে করেছে, এরপর কাঁদছে কেন!' এ উক্তিকে কেন্দ্র করে নেটিজেনরা একের পর এক মিম তৈরি করতে শুরু করেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এ মিমগুলো ঘুরেফিরে কম-বেশি সবার সামনেই গিয়েছে। ইন্টারনেট ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের বহুল ব্যবহারের কারণে এ ধরনের বিভিন্ন মিম আজকাল একজন থেকে হাজারজনের কাছে নিমেষেই পৌঁছে যাচ্ছে।
ইন্টারনেট জগতের মিম হচ্ছে বিভিন্ন কনটেন্ট (বিষয়বস্তু) ও কনটেক্সটকে (কোনো একটি প্রসঙ্গ) হাস্যরসাত্মকভাবে উপস্থাপন করা। ছোটবেলার মজার ১০১টি জোক বইয়ের মতোই মিমের মাধ্যমেও কোনো ঘটনাকে হাসি-ঠাট্টার মাধ্যমে উপস্থাপন করা হয় — তবে সাধারণ কৌতুকে কেবল লেখা থাকলেও ছবি, ভিডিও, লেখা সবকিছু দিয়েই ইন্টারনেট মিম তৈরি হতে পারে।
মিমের জনপ্রিয়তা কেবল উঠতির দিকে
তরুণদের মধ্যে মিম তৈরি ও চালাচালি করার প্রবণতা বেশি দেখা যায়। অবশ্য মিমের মূলভোক্তা তরুণেরাই। তাই ইন্টারনেটের বিভিন্ন মিম পেজ-গ্রুপের সদস্যও বেশিরভাগ তারাই। এসব গ্রুপে যারা মিম বানান, তাদের মধ্যেও যেন চলে এক ধরনের নীরব প্রতিযোগিতা।
একটি নির্দিষ্ট প্রসঙ্গের ওপর একাধিক মিম তৈরি হতে পারে। এসব মিমের মধ্যে কোনটি তুলনামূলক ভালো হয়েছে, তা অনেকসময় ঠিক করে দেয় মিমটিতে কতগুলো লাইক-কমেন্ট পড়েছে বা কতবার শেয়ার হয়েছে সে সংখ্যা। বেশি মানুষ মিম দেখে মজা পেলে এবং নিজেদের সঙ্গে যোগসূত্র খুঁজলে সেখানেই যেন একজন মিমারের (যারা মিম তৈরি করেন) সার্থকতা।
মিম এখন কেবল আর হাসি-ঠাট্টার বিষয় নয়। যোগাযোগ থেকে শুরু করে চলমান বিষয়াবলি, প্রচারণা, মার্কেটিং ও প্রতিবাদের ভাষা হিসেবেও মিম কনটেন্টের ব্যবহার বাড়ছে। যারা নিত্যকার ঘটনার খবর রাখেন না, তারা মিমের বদৌলতে আশপাশে কী ঘটছে তা জানতে পারছেন। কেউ অবশ্য আবার মিম দেখে চট করে সেটার প্রসঙ্গ কী তা বুঝতে পারেন না। তবে এরকম পরিস্থিতিতে ঘটনা প্রসঙ্গে ওয়াকিবহাল হতে অন্য নেটিজেনদের কমেন্টের ওপর দিব্যি ভরসা করা যায়।
একসময় নিছক বিনোদন ও হাসির খোরাক জোগানো মিম বর্তমানে প্রচারণা ও বিজ্ঞাপন দুনিয়ার বড় হাতিয়ার হয়ে উঠেছে। ফলে বিভিন্ন ব্র্যান্ড, প্রতিষ্ঠান নিজেদের প্রচারণার জন্য মিম পেজগুলোর সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হচ্ছে। সাম্প্রতিককালে জনপ্রিয় হয়ে ওঠা এ মিমসংস্কৃতি ইতোমধ্যে বিজ্ঞাপন দুনিয়ায় এর ছাপ ফেলতে শুরু করেছে।
তাইতো শৌখিন মিমার থেকে কেউ কেউ বনে গেছেন প্রায় পেশাদার মিমার। একের পর এক মিম বানিয়ে তারা এখন আয় করছেন হাজার-হাজার টাকা অথবা পাচ্ছেন আকর্ষণীয় সব পুরস্কার। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এরকম একাধিক পেজ ও গ্রুপ রয়েছে, যেগুলোতে মিমারগণ নিয়মিত মিম প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে জয়ী হতে পারেন। এমনই একটি পেজ হচ্ছে 'র্যান্টেজেস'।
মিমের বদৌলতে আয়
২০০৮ সালে রুম্মান কালাম নামক একজন শৌখিন মিমার ফেসবুকে র্যান্টেজেস পেজটি খোলেন। দীর্ঘ দেড় দশকে বর্তমানে পেজটির অনুসারীর সংখ্যা আড়াই লাখের বেশি। 'র্যান্টেজেস গোটপোস্টিং' নামক তাদের একটি ফেসবুক গ্রুপও আছে।
বাংলাদেশের মিমজগতে বেশ পরিচিত নাম হয়ে উঠেছেন রুম্মান কালাম। তার র্যান্টেজেস প্ল্যাটফর্ম দেশীয় মিমারদের একটি কমিউনিটি গড়ে তুলতে সাহায্য করেছে। পেজটি বিভিন্ন ব্র্যান্ড-প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়ে ইতোমধ্যে ১০টি ক্যাম্পেইন করেছে। সম্প্রতি একটি ওয়েব সিরিজের প্রচারণার অংশ হিসেবে র্যান্টেজেস থেকে মিম প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। যেখানে সেরা মিম কনটেন্ট বানিয়ে অনেকেই পুরস্কার হিসেবে পেয়েছেন নগদ অর্থ।
রুম্মান কালাম জানান, 'শুরুতে মিম কেবল বিনোদনের জন্যই বানানো হতো। মিম যে বিজ্ঞাপনের একটি বড় মাধ্যম হতে পারে, তা শুরুর দিকে ব্র্যান্ড, প্রতিষ্ঠান বা অন্যরা ভাবতেই পারেনি। মিমের বড় শক্তি হচ্ছে যোগাযোগের অন্য মাধ্যমগুলোর তুলনায় এটি স্বল্পসময়ে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে।'
তিনি জানান, প্রতিটি ক্যাম্পেইনের জন্য ব্র্যান্ডগুলো তাদেরকে ৩০ থেকে ৫০ হাজার টাকা দেয়। 'অ্যাডমিন, মডারেটর, ও মিমার মিলিয়ে বর্তমানে আমাদের ১৬ জনের একটি দল রয়েছে। ক্যাম্পেইন থেকে পাওয়া অর্থ এদের মধ্যে সমানভাবে ভাগ করে দেওয়া হয়,' বলেন রুম্মান।
ক্যাম্পেইন চলাকালীন সপ্তাহে চুক্তি অনুযায়ী প্রতিটি কনটেন্টে ব্র্যান্ডগুলোর লোগো, ছবি বা বার্তাকে মিমের মাধ্যমে উপস্থাপন করা হয়। পেজে বা গ্রুপের মিমারদের এসব ক্যাম্পেইনে নির্দিষ্ট কনটেক্সট বজায় রেখে মিম বানাতে উৎসাহিত করা হয়।
র্যান্টেজেস পেজ থেকে গত চারমাসে ৪টি মিম প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়েছে। এসব প্রতিযোগিতায় বিজয়ী হওয়া ব্যক্তিদের সর্বনিম্ন দু'হাজার টাকা করে পুরস্কার হিসেবে দেওয়া হয়েছিল। প্রায় প্রতিটি ক্যাম্পেইনে বিভিন্ন ধাপ নির্ধারণ করে বিজয়ী মিমারদের পুরস্কার হিসেবে হাজারের ওপর টাকা দেওয়া হয়।
সম্প্রতি র্যান্টেজেস-এর একটি মিম প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে মেকানিকাল কিবোর্ড জিতেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী রাকিব রাজ মৃধা। এরপর থেকে তিনি নিয়মিত মিম বানিয়ে যাচ্ছেন। র্যান্টেজেস-এ মিম বানিয়ে প্রতিমাসে আয় করেন আশিক সাদ। দেশের বেশ কয়েকটি বড় ব্র্যান্ডের সঙ্গে কাজ করে মিম বানিয়ে তিনি সর্বোচ্চ ১৫ হাজার টাকা পর্যন্ত আয় করেছেন।
চুক্তিবদ্ধভাবে পেশাদার আঙ্গিকে মিম বানানোর আরেকটি ফেসবুক পেজ হচ্ছে 'বেঙ্গল বিটস'। মিমের মাধ্যমে বিভিন্ন ব্র্যান্ড বা প্রতিষ্ঠানের প্রচারণার কাজটি তারা প্রায় পাঁচ বছর ধরে করছে। ইতোমধ্যে পেজটি থেকে ১০টি ক্যাম্পেইন অনুষ্ঠিত হয়েছে।
বেঙ্গল বিটস-এর মিম মার্কেটিংয়ের বিভিন্ন প্যাকেজ রয়েছে। এখানে ১০টি মিম বানানোর জন্য ব্র্যান্ড-প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে ন্যূনতম ৭০ থেকে ৮০ হাজার টাকা নেওয়া হয়। শৌখিন মিমারেরা বেঙ্গল বিটস-এর ফেসবুক গ্রুপে মিম প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে বিজয়ী হলে তাদেরকে ব্র্যান্ডের পক্ষ থেকে টি-শার্ট, হুডি ও বিভিন্ন উপহার দেওয়া হয়।
বেঙ্গল বিটস-এর ব্র্যান্ড সমন্বয়ের দায়িত্বে থাকা এফতার আহসান বলেন, 'বিভিন্ন এজেন্সি ও আমাদের নিজেদের মাধ্যমে আমরা ব্র্যান্ডগুলোর সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হই। আমাদের খণ্ডকালীন ও পূর্ণকালীন কর্মী রয়েছেন যাদের মাসিক বেতন ১০ হাজার থেকে ৫০ হাজার টাকা।'
ব্র্যান্ড মার্কেটিংয়ের জন্য থিম তারাই নির্ধারণ করে দেন। ব্র্যান্ডের বার্তাগুলো দিয়েই মিম তৈরি করা হয়। 'মিম বানানোর জন্য কাউকে খুব বেশি দক্ষ হতে হয় না। তবে তার মধ্যে লোক হাসানোর মতো সূক্ষ্ম বিচক্ষণতা থাকা চাই। কারণ মিম জিনিসটাই হচ্ছে হিউমারাস বিষয়,' বলেন এফতার আহসান।
আসলেই কি মিম তৈরিতে বেশি দক্ষতা লাগে না? পপ কালচার নিয়ে ধারণা, দিন-দুনিয়ার খবর না রাখলে আকর্ষণীয় মিম বানানো খুব একটা সহজ নয়। ইদানীং ফেসবুকে প্রায় সাহিত্য বিষয়ক মিম প্রতিযোগিতার ইভেন্ট দেখা যায়, যেখানে মিমারদের মিম বানাতে হলে বইপত্র, সাহিত্য নিয়েও বিস্তর ধারণা থাকতে হয়।
ভবিষ্যৎ আছে কি?
রুম্মান বলেন, 'মিম দিয়ে যোগাযোগ থেকে শুরু করে প্রচারণা, প্রতিবাদ ও মার্কেটিং সবকিছুই করা সম্ভব হচ্ছে। এটি এখন আর এক বিষয়ের ওপর আটকে নেই। হয়তো সামনে মিমের ব্যবহার আরও বাড়বে। তবে পেশা হিসেবে এটি দাঁড়াতে পারবে কি না তা এখনো ভাববার বিষয়। কারণ যারা মিম বানিয়ে আয় করছেন, তারা পাশাপাশি অন্য কাজও করেন — মিমকে তারা বাড়তি আয় হিসেবে দেখেন। এখনো পুরোদস্তুর পেশা হিসেবে এটি গড়ে ওঠেনি।'
এফতার আহসানের ভাষ্যমতে, 'একেক সময় একেকটি বিষয়ের আধিক্য দেখা যায়। বর্তমানে মিমের মাধ্যমে এক ধরনের প্রভাবসৃষ্টি লক্ষ্য করা যাচ্ছে, যা অন্য কোনোভাবে হয়তো এত সহজে সম্ভব হতো না।'
তিনি জানান, ব্র্যান্ড ও প্রতিষ্ঠানগুলোকে মিমের প্রভাব বোঝাতে আগে তাদের হিমশিম খেতে হতো। 'এখন তারাই আমাদের কাছে আসে বিভিন্ন ক্যাম্পেইনের জন্য। কারণ তারা দেখেছে এ ধরনের প্রচারণা তাদের ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে কতটা কার্যকরী ছাপ ফেলছে,' বলেন এফতার।
তবে এফতার আহসান মিমকে পূর্ণকালীন পেশা হিসেবে দেখার ব্যাপারে আশাবাদী। 'এখন অনেকেই মিম বানান প্রতিযোগিতায় জিততে ও পুরস্কার পাওয়ার আশায়। অল্প বয়স থেকেই এ সেক্টরে উপার্জন করার ক্ষেত্র তৈরি হচ্ছে। হয়তো একসময় পূর্ণ পেশা হিসেবেও মানুষ এটা নিয়ে ভাবতে পারবে,' বলেন এফতার।