হিলটন নাথ নয়, লাশটি মাহে আলমের
বাগেরহাটের মোংলা উপজেলার চিলা গ্রামের জেলে হিলটন নাথ ভেবে কবর দেওয়া মরদেহটি নিখোঁজ ব্যবসায়ী মাহে আলমের বলে জানা গেছে। ফরেনসিক ডিএনএ ল্যাবরেটরি অফ বাংলাদেশ পুলিশের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এ তথ্য।
গত ১ আগস্ট ফরেনসিক ডিএনএ ল্যাবরেটরির ডিএনএ পরীক্ষক মোহাম্মাদ নাজমুল আলম টুটুল স্বাক্ষরিত ওই প্রতিবেদনের বিষয়টি সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আমলি আদালত 'গ' অঞ্চল খুলনাকে অবহিত করা হয়।
জানা গেছে, হিলটন নাথ ভেবে খ্রিস্টীয় রীতিতে সমাহিত করা মাহে আলমের মরদেহ কবর থেকে তুলে ইসলামের রীতি অনুযায়ী দাফনের জন্য আদালতে আবেদন করবে তার (মাহে আলমের) পরিবার। অন্যদিকে, হিলটনকে খুঁজে বের করার দাবি জানিয়েছেন স্থানীয়রা।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অজ্ঞাত মৃতদেহের দাঁত থেকে একজন পুরুষের পূর্ণাঙ্গ ডিএনএ প্রোফাইল পাওয়া যায়। সেই প্রোফাইলের ভিত্তিতে পরীক্ষা-নীরিক্ষার মাধ্যমে এটি সূদৃঢ়ভাবে প্রমাণিত হয়েছে যে, চিলা গ্রামে হিলটন নাথ হিসেবে কবর দেওয়া মরদেহটি মূলত নিখোঁজ ব্যবসায়ী মাহে আলমের।
ব্যবসায়ী মাহে আলম (৫৭) মোংলা পৌর শহরের বাতেন সড়ক এলাকার মৃত মুন্সি মো. হাবিবুল্লার ছেলে। তিনি মাছের ব্যবসা করতেন। অন্যদিকে, হিলটন নাথ মোংলা উপজেলার চিলা গ্রামের মিটু নাথের ছেলে। তিনি পশুর নদী ও সুন্দরবন এলাকায় মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করতেন।
মাহে আলমের পরিবার সূত্রে জানা যায়, গত ১০ এপ্রিল সকাল ৯টায় ব্যবসায়ী মাহে আলম মোংলা বাজারে যাওয়ার উদ্দেশে বের হয়ে আর ফিরে আসেননি। অনেক খোঁজাখুঁজি পরেও তাকে না পেয়ে তার ছোট ছেলে সুমন রানা গত ১৪ এপ্রিল মোংলা থানায় নিখোঁজের সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন।
মোংলার মামারঘাট এলাকায় থাকা পৌরসভার সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজে ১০ এপ্রিল সকালে মাহে আলমকে দেখা যায়। সে সময় তার পরনে নীল-সাদা প্রিন্টের হাফহাতা শার্ট ও হাতে একটি শপিং ব্যাগ ছিল। সেই ফুটেজে ট্রলার মাঝি মোশারফকে মাহে আলমের হাত ধরে বোটে নিয়ে যেতে দেখা যায়।
মোশাররফ তাকে অপহরণ করে সুন্দরবনের করমজলে নিয়ে যায়- এমন অভিযোগ করে সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ ও প্রত্যক্ষদর্শীদের তথ্যউপাত্ত নিয়ে মোংলা থানায় মামলা করতে চাইলে মামলা নিতে অস্বীকৃতি জানায় থানা। এর পরিপ্রেক্ষিতে গত ২৯ এপ্রিল সংবাদ সম্মেলন করে মাহে আলমের পরিবার। পরে ২ মে মাহে আলমের ছোট ছেলে সুমন রানা বাগেরহাটের বিজ্ঞ সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আমলি আদালত-২–এ থানায় নিয়মিত মামলা হিসেবে গ্রহণের আবেদন করেন। আদালত মোংলা থানাকে ১৫৪ ধারায় এজাহারভুক্ত নিয়মিত মামলা হিসেবে রেকর্ডভুক্ত করার জন্য আদেশ দেন। ওই মামলায় ট্রলার চালক মোশাররফকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
যদিও সপ্তাহখানেক আগে জামিনে বের হয়েছেন মোশাররফ।
এদিকে, মাহে আলম নিখোঁজের পর গত ১৩ এপ্রিল রাতে সুন্দরবনের করমজল বন্য প্রাণী প্রজনন কেন্দ্র থেকে অর্ধগলিত একটি লাশ উদ্ধার করা হয়। পরের দিন ১৪ এপ্রিল দাকোপ থানা পুলিশ খুলনা মেডিকেল কলেজে লাশটির ময়নাতদন্ত শেষে নিখোঁজ জেলে হিলটন নাথের পরিবারের সদস্যদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে তাদের কাছে হস্তান্তর করে। খ্রিস্টধর্মীয় রীতি অনুযায়ী হিলটনের পরিবার মোংলা উপজেলার পশ্চিম চিলা গ্রামে ১৫ এপ্রিল ওই মরদেহের শেষকৃত্য সম্পন্ন করে। ওই ঘটনায় দাকোপ থানায় হত্যা ও লাশ গুম করার অভিযোগে অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের আসামি করে মামলা করেন হিলটন নাথের মা বীথিকা নাথ।
এরই মধ্যে নিখোঁজ ব্যবসায়ী মাহে আলমের পরিবার ছবি দেখে লাশটি মাহে আলমের বলে দাবি করে। যার পরিপ্রেক্ষিতে দাকোপ থানা আদালতে ডিএনএ পরীক্ষার আবেদন জানানো হয়। খুলনার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত 'গ' অঞ্চল খুলনার আদেশে গত ৯ মে ঢাকার সিআইডি ল্যাবে হিলটন নাথের মা বীথিকা নাথ ও মাহে আলমের ছোট ছেলে সুমন রানা নমুনা দেন।
এ বিষয়ে হিলটন নাথের ভাই সাগর নাথ বলেন, "৭ এপ্রিল আমি ও আমার ভাই হিলটন নাথসহ চারজন পশুর নদীতে মাছ ধরছিলাম। রাতে সহকারী বন সংরক্ষক (এসিএফ) মোঃ মাহবুব হোসেনের নেতৃত্বে বনরক্ষীরা আমাদের তিনজনকে বন বিভাগের চাঁদপাই রেঞ্জ কার্যালয়ে নিয়ে আটকে রাখেন। তবে তিনজনের মধ্যে আমার ভাই ছিল না।"
"ভাই হিলটন নাথের কথা জানতে চাইলে এসিএফ মোঃ মাহবুব হোসেন বলেন, পরে আনা হবে। আমাদের প্রচুর মারধর করে বনরক্ষীরা। পরের দিন সকালে আমাদের তিনজনকে আদালতে প্রেরণ করলেও আমার ভাই হিলটন নাথকে আদালতে প্রেরণ করেনি। পরবর্তীতে জানতে পারি আমার ভাইয়ের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে এবং পারিবারিকভাবে তার শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়েছে," যোগ করেন তিনি।
যদিও সাগর নাথের এসব অভিযোগে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন সহকারী বন সংরক্ষক (এসিএফ) মোঃ মাহবুব হোসেন।
সাগর নাথ আরও বলেন, "দুপুরের দিকে শুনলাম মাটি দেওয়া মরদেহ আমার ভাই হিলটন নাথের নয়। এই মরদেহ ব্যবসায়ী মাহে আলমের। তাহলে আমার ভাই কোথায়? আমরা যে কোনো মূল্যে আমার ভাইয়ের মৃতদেহ অথবা জীবিত অবস্থায় তাকে ফেরত চাই।"
এদিকে ব্যবসায়ী মাহে আলমের ছোট ছেলে সুমন রানা বলেন, "আমার বাবাকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে। তার মরদেহ হিলটনের বলে চালিয়ে দেওয়া হয়েছে। এটি অনেক বড় অপরাধ। ডিএনএ পরীক্ষার মাধ্যমে বিষয়টি এখন প্রমাণিত যে, কবর দেওয়া মরদেহটি হিলটন নাথের নয়। মরদেহটি আমার বাবা ব্যবসায়ী মাহে আলমের।"
সুমন রানা আরও বলেন, "আদালত এবং প্রশাসনের মাধ্যমে মরদেহ উত্তোলন করে দ্রুত ইসলামী রীতি অনুযায়ী মরদেহর দাফন সম্পন্ন করতে চাই।"
বাবা মাহে আলমকে যারা পরিকল্পিতভাবে খুন করে মরদেহ গুম করেছে, তাদের আইনের আওতায় এনে দ্রুত বিচারের দাবি জানান বাবা হারা এই সন্তান।
অন্যদিকে, হিলটন নাথের মা বীথিকা নাথের করা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পুলিশ ব্যুরো ইনভেস্টিগেশন খুলনার মিজানুর রহমান বলেন, আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মাহে আলমের ছেলে সুমন রানাকে তার বাবার মরদেহ বুঝিয়ে দেওয়া হবে।
আর মাহে আলমকে পরিকল্পিতভাবে খুন এবং লাশ গুম করার অভিযোগ থাকলে তার পরিবারের পক্ষ থেকে পৃথক মামলা করতে হবে বলে জানান তিনি।
এদিকে, তৎকালীন চাঁদপাই রেঞ্জের সহকারি বন সংরক্ষক (এসিএফ) মো. মাহবুব হোসেন তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, "৭ এপ্রিল রাতে আমি অভিযানে ছিলাম না। আমার স্টাফরা অভিযানে ছিল। ওইদিন তিনজনকেই আটক করা হয়। তাদেরকে পরবর্তীতে আদলতে সোপর্দ করা হয়। তাদের কাউকে মারধর বা অন্যকেউ নিখোঁজের ঘটনা ঘটেনি। যাদের আটক করা হয়েছিল তাদের সাথে আর কেউ আছে কিনা, তাও জানতে চাওয়া হয়েছিল। তারা বলেছেন, আমাদের সাথে আর কেউ নেই।"
খুলনার পুলিশ সুপার মোহাম্মদ সাঈদুর রহমান বলেন, "মরেদেহের পরিচয় সম্পর্কে আমরা নিশ্চিত হয়েছি। দাকোপ থানায় হিলটনকে হত্যা ও গুমের যে মামলা রয়েছে, তা নিয়ে পুলিশ আরও গভীরভাবে কাজ করবে।"
একইসঙ্গে, মাহে আলমকে হত্যা ও গুমের মামলা বাগেরহাট আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী চলবে বলে জানান তিনি।