মুর্তজা বশীরের শেষ আত্মপ্রতিকৃতি ও একটি সাক্ষাৎকার
মুর্তজা বশীরের আত্মপ্রতিকৃতি-বিষয়ক চিত্রমালা দেখে বিস্মিত না হয়ে উপায় নেই। ঢাকায় চারুকলায় ছাত্রাবস্থা থেকে শুরু করে মৃত্যুর আগপর্যন্ত তিনি আত্মপ্রতিকৃতি এঁকেছেন। সে ধারা অব্যাহত রেখেছেন জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত। শুধু আঁকার জন্য আঁকা এমন নয়, অনেক গুরুত্বপূর্ণ পেইন্টিংয়ে উপস্থাপন করেছেন নিজেকে। ৭০ বছরের দীর্ঘ এই জীবনে তাঁর মুখাবয়বের একটি ধারাবাহিক চিত্র পাওয়া যায় এই কাজগুলো থেকে। বশীর স্যারের শেষ জীবনে একটানা সাত বছর তাঁকে কাছ থেকে গভীরভাবে দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার। আমার আগ্রহ ছিল তাঁর আঁকা একটি আত্মপ্রতিকৃতি সংগ্রহ করার। দু-একবার বলেছি। স্যারের সহজ জবাব, 'আমার সেলফপোর্ট্রটে কাউকে দেই না।' একবার নতুন পেন্সিল পরীক্ষা করতে গিয়ে একটি সেলফপোর্ট্রেট আঁকার চেষ্টা করেন। পরে সেটা তাঁর পছন্দ হয়নি, স্বাক্ষরও করেননি। ২০১৭ সালে শিল্পী অলকেশ ঘোষ বশীর স্যারের একটি পোর্ট্রেট করে আমাকে দেন। সেটা দেখে স্যার খুব প্রশংসা করেন। বললেন, অলকেশ আমার চোখটা খুব ভালো লক্ষ্য করেছে। স্যারের বড় মেয়ে মুনীরা বশীর যুই আপা একদিন ফোন করে বললেন, 'আসাদ ভাই, বাবা পোর্ট্রটো খুব পছন্দ করেছেন। সেটা আমাকে দিতে বলেছেন। তার বদলে আপনাকে একটা সেলফপোট্রেট এঁকে দিবে। আপনি তো বাবার সেলফপোর্ট্রটে চেয়েছিলেন।' আমি সেদিনই কাজটা দিয়ে এসেছি। আর স্বপ্ন দেখছি মুর্তজা বশীরের আত্মপ্রতিকৃতি পাওয়ার। কিন্তু সে সময় আর আসে না। যুই আপা বশীর স্যারকে বলছেন, বাবা, আসাদ ভাইয়ের ওয়াদা পূরণ করেন। স্যার তখন খুবই অসুস্থ ছিলেন। এক সকালে স্যার আমাকে ডেকে নিয়ে বললেন, 'তোমার সেলফপোর্ট্রটে হয়ে গেছে, আর সামান্য একটু কাজ করব।' এই বলে তাঁর শোয়ার ঘরে স্টিলের আলমারির আয়নায় দাঁড়িয়ে পেন্সিল দিয়ে ঘষে ঘষে কাজটি সম্পূর্ণ করেন। সেখানে আমি তাক করে রাখলাম ক্যামেরা। এভাবেই মুর্তজা বশীর জীবনের শেষ আত্মপ্রতিকৃতিটি এঁকেছিলেন। সে কাজটি এখন মুর্তজা বশীর ট্রাস্টের সংগ্রহে। কাজটি শেষ হওয়ার পর আত্মপ্রতিকৃতি নিয়ে আলাপ হয়েছিল, সেখানেও ভিডিও ক্যামেরা অন ছিল। রেকর্ডের আগেও কিছু কথা হয়েছিল। পৃথিবীতে কি আর কেউ এত সেলফপোর্ট্রটে করেছে? উত্তরে স্যার বলেছিলেন, 'হ্যাঁ, করেছে। রেমব্রান্ট করেছে, পিকাসো করেছে।' ১২ মে ২০১৭ সালে ধারণকৃত ভিডিও রেকর্ডে আত্মপ্রতিকৃতি নিয়ে সাক্ষাৎকারটি পাঠকের কাছে এখানে তুলে ধরছি:
প্রশ্ন: আপনি এত সেলফপোর্ট্রেট করতে গেলেন কেন?
বশীর: বেসিক্যালি আমি খুব লোনলি, খুব নিঃসঙ্গ মানুষ। তার কারণ হলো, আমার জন্মের আগে আমার মা পড়ে গেছিলেন। ফলে আমার হাত বেরিয়ে গেছিল। জন্মের দুই দিন আগে। আমার মা বসতে পারত না, শুতে পারত না। ১৯৩২ সালের কথা। তখন সাইন্স এতটা ডেভলপ হয়নি। তখন ইউনিভার্সিটির (ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়) ডাক্তার ছিল ডাক্তার বোস। সে বলল প্রসূতিকে বাঁচাতে হলে সন্তানকে মেরে ফেলতে হবে। নইলে বাইরে থেকে জার্ম (প্রবেশ করবে)। কিন্তু আমার মা মারেনি। আমি জন্মগ্রহণ করার পর আমার মা বমি করল, রক্তবমি। তার দাঁতে পাইরিয়া ছিল। সামনের দাঁত সব ফেলে দিয়েছিল। আলসার ছিল।
আমার মা সব সময় বলত, তুই জন্মের আগেও জ্বালিয়েছিস, এখনো জ্বালাস। ফলে আমার মধ্যে ছোটবেলা থেকেই ছিল, আমাকে কেউ চায় না। বাড়িতে আমরা চার ভাই থাকি। দুই ভাইয়ের বউ থাকে। ডাইনিং টেবিলে বসলাম, মনে করো পুডিং (বানিয়েছে)। ভাবিদের জন্য ভাবিরা রাখছে। আমি দেখলাম, বাড়িতে ছয়জন, (টেবিলে) আছে চারটা (পুডিং)। তার মানে আমারটা নাই। একটা বাজে অবস্থা। ভাবি বলছে, বকুল খাও। আমি (বলছি)—না, আমি খাব না। আমার মনে হচ্ছে আমারটা নাই। অন্যরা কিন্তু নিয়ে খেয়ে ফেলছে। আমি খেতে পারছি না। এটা একটা সাইকিক ঘটনা। বড় হয়ে যখন বন্ধুবান্ধবের (সঙ্গে মিশেছি), আমার বন্ধুবান্ধবের সংখ্যাও কম ছিল, খুব লিমিটেড। আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু যাদের মনে করছি, পরবর্তীকালে তাদের ব্যবহারে... (কষ্ট পেয়েছি)। আমি তাদের নাম বলব না।
যখন আমি একা হয়ে যাই। আমার মনে অনেক কষ্ট। তখন আমি আয়নার সামনে দাঁড়াই। আয়নাতে যে লোকটাকে দেখি, সে আমি কিন্তু আমি না। আমার প্রতিবিম্ব। তাকে আমার সবচেয়ে নির্ভরশীল মনে হয়। এ আমাকে ছেড়ে যাবে না। তখন, তুমি দেখবা আমার বেশির ভাগ সেলফপোর্ট্রটে খুব স্যাড। খালি একটা একটু স্মাইলিং আছে। বেশির ভাগ হলো গম্ভীর। আমার যখন চোখে ক্যাটার্যাকট করল, আমি খুলে যখন দেখলাম চোখে ব্যান্ডেজ বাঁধা; যন্ত্রণা হচ্ছে। আমি ওইটাও আঁকছি। আমি ইউনাইটেড হসপিটালে টয়লেটে গেলাম। আয়নায় দেখি খোঁচা খোঁচা দাড়ি। বুকে ইনজেকশন দেয়ার ক্যানুলা লাগানো। আমার মেয়েকে বললাম, যুই আমার খাতা এনে দিস তো; আমি আমার সেলফপোর্ট্রেট করব। আমি প্রায় ১২০-১২৫টার মতো সেলফপোর্ট্রটে করছি। বেশির ভাগ ড্রইং। অয়েলে খুব কম করছি। প্যাস্টেলে কিছু করছি। সেলফপোর্ট্রেট করার পেছনে কারণ হলো, আমি যে বললাম—আমি বেসিক্যালি খুব নিঃসঙ্গ। এই যে (আয়নায়) যাকে আমি দেখি, সে আমার খুব আপনজন। সে আমার সঙ্গে বিট্রে করবে না। কারণ, বন্ধুবান্ধব আমার সঙ্গে বিট্রে করছে। তুমি তোমার একটা ঘনিষ্ঠ বন্ধুকে তোমার একটা ব্যক্তিগত ব্যাপার বলছ, কিন্তু সে ওইটা প্রকাশ কইরা দিছে। তারপর তুমি ইমোশনাল সিচুয়েশনের মধ্যে পইড়া গেছ। এই কারণেই আমার সেলফপোর্ট্রেট আঁকা। আর সময়টাকে ধইরা রাখা।
প্রশ্ন: এই সেলফপোর্ট্রেটগুলো নিয়ে কোনো এক্সিবিশিন করেছেন?
বশীর: করছি না! সবগুলো না, কিছু সিলেকটেড কাজ দিয়ে করছি। একবার করছি '৯৩তে। আমার সেলফপোর্ট্রেট আর আমার কবিতা দিয়ে। নির্ঝরের যোজন গ্যালারিতে। ২০০৫-০৬-এ আমার এক্সিবিশন হলো বেঙ্গলে। ওখানে আমার ১০টা না ১২টা সেলফপোর্ট্রেট ছিল।
প্রশ্ন: সবগুলো সেলফপোর্ট্রেট আপনার কাছেই আছে?
বশীর: সবই আছে আমার কাছে। একটা-দুইটা হয়তো বিক্রি করছি। হয় কোনো পত্রিকার জন্য, আমি প্রথম আলোর জন্য আঁইকা দিছিলাম। ওইটা আর ফেরত দেয় নাই। নাসির আলী মামুনের কাছে কিছু আছে।