ইনড্রাইভ: নতুন এক রাইড শেয়ারিং অ্যাপের রহস্যময় কর্মকাণ্ড
গত কয়েক মাস ধরে টিয়া রংয়ের একটি অ্যাপ ইউটিউব ও ফেসবুকে নিজের আগমন বেশ ফলাও করে জানান দিচ্ছে।
এইতো গত সোমবারে রাস্তায় প্রচলিত অ্যাপগুলোর মাধ্যমে অনেক চেষ্টাতেও কোনো রাইড পাচ্ছিলাম না। তখন মনে হলো, ইনড্রাইভ দিয়ে একবার চেষ্টা চালানো যাক।
ড্রাইভারের কাছে অনেক কিছু জানা গেল রাইডশেয়ারিংয়ের নতুন এ অ্যাপ্লিকেশনটি নিয়ে। আমাকে অবাক করে দিয়ে ভদ্রলোক জানালেন, এ অ্যাপটি চালকদের কাছ থেকে কোনো কমিশন কাটে না। তিনি বেশ কয়েক মাস এটি ব্যবহার করছেন।
ডিসকাউন্ট, প্রমো কোডের মাধ্যমে ছাড় দেওয়া, প্রথম কয়েকটা যাত্রা একদম বিনামূল্যে — মার্কেটিংয়ের কৌশলে এগুলো বেশ পরিচিত। কিন্তু মাসের পর মাস ধরে ফ্রি? এতো একেবারে আনকোরা ব্যাপার।
অ্যাপটির কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করাটা বড় হুজ্জত হয়ে দাঁড়াল। অ্যাপের ভেতরে তাদের অফিসের কোনো ঠিকানা নেই, ওয়েবসাইটও নেই। ২০১৯ সালের ৫ এপ্রিল খোলা ফেসবুক পেজেও কোনো ঠিকানা দেওয়া নেই।
ফেসবুকে তাদের পোস্টে কেউ মন্তব্যের ঘরে ঠিকানা জানতে চাইলে তারা জানাচ্ছে, তাদের গ্রাহকসেবার কোনো অফিস নেই, গ্রাহকেরা যেকোনো প্রয়োজনে যেন সোশ্যাল মিডিয়া অথবা অ্যাপটির চ্যাটবক্সের মাধ্যমে যোগাযোগ করেন।
কিন্তু অনলাইনে গ্রাহকসেবাও খুব ভালো নয়। কাস্টমার সাপোর্ট চ্যাটবক্সে পাঠানো বার্তার প্রথম উত্তর পেতে আমার সময় লেগেছিল পাক্কা ১০ মিনিট। এর পরেরটির জন্য আরও ১০ মিনিট।
প্লেস্টোরে কেবল একটিই ইনড্রাইভ অ্যাপ রয়েছে। অর্থাৎ, বিশ্বের ৪৮টি দেশের ৬৫৫টি শহরে সেবা দেওয়া ইনড্রাইভই বাংলাদেশে সেবা দিচ্ছে।
সারাবিশ্বে কোম্পানিটির দ্রুত প্রবৃদ্ধি ঘটছে। ফোর্বস এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, আগের বছরের তুলনায় ২০২২ সালে ৮৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি দেখেছে অ্যাপটি।
২০১৩ সালে রাশিয়ায় তৈরি করা হয় ইনড্রাইভ অ্যাপটি। কিন্তু ২০১৮ সাল হতে যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া থেকে এটি পরিচালনা করা হচ্ছে। তখন থেকেই আন্তর্জাতিক বাজারের দিকে এটির নজর বলে ফোর্বস জানিয়েছে।
তবে বাংলাদেশে অন্য অ্যাপ্লিকেশনগুলোর মতো জনপ্রিয়তা এখনো পায়নি ইনড্রাইভ।
'উবার থেকে আমি অনেক কল পাই। কিন্তু ইনড্রাইভ থেকে আসা ফোনের সংখ্যা অনেক কম। আর যেগুলো আসে সেগুলোর দূরত্বও বেশি হয়,' বলেন ইনড্রাইভ রাইডার রেজওয়ান রুমি।
'তারা আমাদেরকে অফিসের কোনো ঠিকানা দেয়নি। প্রায় দুই থেকে তিন মাস আগে একদিন তারা বনানীর একটি অস্থায়ী অফিসে ডেকে নিয়ে প্রায় ১৫ জন চালকের হাতে কিছু টি-শার্ট ও হেলমেট তুলে দেয়,' বলেন আরেক ইনড্রাইভ চালক হারুন অর রশিদ।
অন্যান্য রাইড-শেয়ারিং কোম্পানির চালকদেরকে তাদের নিজ নিজ অফিসে শারীরিকভাবে গিয়ে তাদের গ্যারান্টারের কাগজপত্রসহ যথাযথ নথিপত্রে সাক্ষর করতে হয়। ইনড্রাইভ-এ সাইন আপ করার জন্য তিনি তার কাগজপত্র কোথায় জমা দিয়েছেন জানতে চাইলে হারুন বলেন, 'অ্যাপটিতে সাইন আপ করতে আমার এনআইডি বা কোনো নথিপত্র জমা দেওয়ার দরকার হয়নি। এর জন্য কেবল আমার বাইকের নিবন্ধন এবং ড্রাইভিং লাইসেন্সের তথ্য দরকার ছিল।'
এছাড়া, কোম্পানিটির ব্যবসায়ের মডেলটিও অস্পষ্ট। আমরা তাদের কমিশন নীতি নিয়ে আনুষ্ঠানিক কোনো তথ্য পাইনি। তবে ওইল্যাব-এর একটি ব্লগপোস্ট অনুযায়ী, ইনড্রাইভ কোনো শহরে সেবা চালুর পর প্রথম ছয় মাসের জন্য কমিশনবিহীন পরিষেবা দেয়। তারপর এটি ভাড়ার ৫ থেকে ১০ শতাংশ চার্জ হিসেবে রাখে।
তবে বাংলাদেশে প্রায় এক বছরের মতো অ্যাপটি কমিশন ছাড়াই চলছে। চালকদেরও বলা হয়নি কখন থেকে তাদের ভাড়ার কিছু অংশ কেটে নেওয়া শুরু হবে।
রেজওয়ান বলেন, 'আমি গত অক্টোবর থেকে ইনড্রাইভ ব্যবহার করছি, তারা এখন পর্যন্ত কোনো চার্জ নেয়নি, আর কতদিন এভাবে চলবে তাও তারা আমাদের জানায়নি।'
তবে ড্রাইভারদের থেকে কমিশন নেওয়া শুরু করলেও, যেহেতু তাদের কোনো অনুমোদন নেই, তাই তারা সে লভ্যাংশ কীভাবে নিজেদের মুদ্রায় গ্রহণ করবে তাও অস্পষ্ট।
অ্যাপ সম্পর্কে আরও জানতে আমি বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটির (বিআরটিএ) সঙ্গে যোগাযোগ করি। ২০১৫ সাল থেকে বিআরটিএ ১৫টি রাইড শেয়ারিং প্ল্যাটফর্মের অনুমোদন দিয়েছে। কিন্তু ইনড্রাইভ এ তালিকায় নেই।
বিআরটিএ'র ডিজিটাল নম্বর প্লেট ও রাইড শেয়ারিং উইংয়ের সহকারী পরিচালক (প্রকৌশল) মো. ফারুক আহমেদ বলেন, 'ইনড্রাইভের বিআরটিএ থেকে কোনো লাইসেন্স নেই, তারা অবৈধভাবে কাজ করছে।'
'আমরা ইনড্রাইভ সম্পর্কে জানতাম না। তাদের কার্যক্রম শুরু করার আগে তাদের অবশ্যই বিআরটিএ'র অনুমোদন নিতে হবে। এখন যেহেতু আমরা অবহিত হয়েছি, আমরা অবশ্যই তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেব,' বলেন বিআরটিএ'র সড়ক নিরাপত্তা বিভাগের পরিচালক মো. মাহবুব-ই-রব্বানী।
আরও গভীরে অনুসন্ধানের পর জানা গেল, এটাই প্রথম নয়, এর আগেও লাইসেন্স ছাড়া পরিষেবা চালু করার নজির রয়েছে ইনড্রাইভের। নাইজেরিয়ার একটি শহর লাগোসে অতীতে এ কাজ করেছে তারা।
আফ্রিকার একটি গণমাধ্যম পোর্টালের খবর অনুযায়ী, ২০২২ সালের ৩০ মে লাগোস ইনড্রাইভকে 'অনিবন্ধিত' অপারেটর হিসেবে ঘোষণা করেছে।
অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে ইনড্রাইভের একজন কর্মীর সন্ধান পাওয়া গেল। অ্যাপটির চালক নিয়োগ বিশেষজ্ঞ শাফাইয়াত হোসেনকে নিবন্ধনের বিষয়ে প্রশ্ন করলে তিনি কোনো উত্তর দিতে রাজি হননি।
শাফাইয়াত জানান, ইনড্রাইভ বন্দরনগরীতে তাদের কার্যক্রম সম্প্রসারিত করছে, তাই তিনি ওই মুহূর্তে চট্টগ্রামে আছেন। তবে তিনি সাক্ষাৎকার দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। কিন্তু শেষ মুহূর্তে এসে তা বাতিল করে বলেন, 'মিডিয়ার সঙ্গে কথা বলার আগে আমাকে আমাদের জনসংযোগ দলের কাছ থেকে অনুমতি নিতে হবে।'
তবে এর পরে তিনি আর ফোন ধরেননি, ইনড্রাইভের জনসংযোগ দল থেকেও কেউ যোগাযোগ করেননি।
দেশের কোথা থেকে অ্যাপটি কাজ করে, এ নিয়ে আরও গভীর অনুসন্ধানের পর দেখা যায়, আদতে কোস্পেস-এর বনানী টাওয়ারে এটির ৫০ বর্গফুটের একটি ছোট ওয়ার্কস্টেশন রয়েছে।
'ইনড্রাইভ এক বছর ধরে আমাদের এখানে আছে। আমি শুনেছি যে তারা তাদের কাগজপত্র নিয়ে কাজ করছে। তবে, আমরা স্পষ্টভাবে বলতে চাই যে, আমাদের কোনো ক্লায়েন্টের যদি কোনো ব্যবসায়িক বা আর্থিক সমস্যা থাকে, তার সঙ্গে আমাদের কোনো সম্পর্ক নেই। আমরা শুধু জায়গা ভাড়া দিই,' বলেন কোস্পেস-এর অপারেশন ম্যানেজার সোহানুর রহমান সোহান।
'যদি কোনো সংস্থা ওয়ার্কস্টেশনের জন্য জায়গা ভাড়া নেয়, সেক্ষেত্রে তারা ঠিকানাটিকে তাদের ব্যবসায়িক ঠিকানা হিসেবে ব্যবহার করতে পারে না। কিন্তু যদি কেউ অফিসের জায়গা ভাড়া নেয়, তবে তারা তাদের ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে আমাদের ঠিকানা ব্যবহার করতে পারে এবং এখানে তাদের ক্লায়েন্টদের সঙ্গে কাজ করতে পারে,' সোহান আরও বলেন।
এ পর্যন্ত যেমন সাড়া
হারুন বলেন, 'আমি এ অ্যাপটি ব্যবহার করছি কারণ তারা কমিশন নেয় না। তারা কমিশন চার্জ করা শুরু করলে আমি অবশ্যই অ্যাপটি আনইনস্টল করে দেব।'
'আমি চার–পাঁচ কিলোমিটার দূর থেকে কল পাই — যাত্রী পেতে এত দূরে যাওয়ার কোন মানে নেই। এছাড়া, তারা অনেক ড্রাইভারকে একই কল পাঠায় এবং ড্রাইভাররা যার যার ভাড়া জানান। একটি রাইড নিশ্চিত করতে অনেক সময় লাগে। তারা কাছের তিন–চারজন চালকের কাছে রাইডের অনুরোধ পাঠাতে পারে। কিন্তু আমার ধারণা, তারা একবারে ১০ জনেরও বেশি ড্রাইভারের কাছে পাঠায়,' বিরক্ত হারুন বিষয়টি ব্যাখ্যা করলেন।
তিনি ফোন করে অভিযোগ করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু চালকদের কাছেও কাস্টমার কেয়ারের নম্বর নেই। হারুন বলেন, 'যখন আমরা কোনো সমস্যার সম্মুখীন হই, আমাদের কাছে কল করার জন্য কাস্টমার কেয়ার নম্বর থাকে না; সবাই চ্যাটবক্স বা ইমেলের মাধ্যমে অভিযোগ জানাতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন না।'
ব্যবহারকারীরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচারের কারণেই মূলত অ্যাপটি সম্পর্কে জানতে পেরেছেন। ইনড্রাইভ বিজ্ঞাপন দিচ্ছে এবং জনপ্রিয় সোশ্যাল মিডিয়া ইনফ্লুয়েন্সারদের সঙ্গে কোলাবোরেশন করছে। এমনকি ইনড্রাইভের প্রতিযোগী প্ল্যাটফর্মগুলোও এটি সম্পর্কে সোশ্যাল মিডিয়া থেকে জানতে পেরেছিল।
ওভাই সলিউশন লিমিটেড-এর নির্বাহী পরিচালক এবং সিওও রাহিদ চৌধুরী বলেন, 'আমরা ফেসবুক এবং ইউটিউবের মাধ্যমে এটি সম্পর্কে জানতে পেরেছি। আমরা জানি যে ইনড্রাইভ বিশ্ববাজারে সেবা দিচ্ছে। কিন্তু বাংলাদেশে তাদের কোনো বৈধ উপস্থিতি সম্পর্কে আমরা জানতাম না, কারণ তাদের দেশে চালু হওয়ার কোনো খবর কোথাও দেখিনি।'