পেঁয়াজ রপ্তানিতে ভারতের বড় ধরনের শুল্কারোপের আঁচ দেশের বাজারে
হাইলাইটস
- একদিনের ব্যবধানে পাইকারিতে পেঁয়াজের দাম কেজিতে ১৪-২৪ টাকা বেড়ে গেছে
- কিছু কিছু খুচরা বিক্রেতা ইতিমধ্যে কেজিতে ৫ টাকা বেশি দাম রাখছেন
- এক-দুদিনের মধ্যে পেঁয়াজের বাজারে অস্থিরতা তৈরির আশঙ্কা ব্যবসায়ীদের
- পাইকারি বিক্রেতারা প্রতি পাল্লা (৫ কেজি) আমদানি করা পেঁয়াজ ৩১০-৩৩০ টাকায় বিক্রি করছেন, আগে ছিল ২৮০ টাকা
বাংলাদেশের পেঁয়াজের প্রধান সরবরাহকারী ভারত সবজিটির রপ্তানির ওপর বড় ধরনের শুল্ক আরোপ করার পরপরই তার ধাক্কা এসে লেগেছে এদেশের পেঁয়াজের বাজারে। ভারতের রপ্তানি শুল্কারোপের ঘোষণার পর থেকেই দেশের বাজারে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়াতে শুরু করেছে পেঁয়াজের দাম।
ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, মাত্র একদিনের ব্যবধানে পাইকারি বাজারে পেঁয়াজের দাম প্রতি ৫ কেজিতে ৭০ থেকে ১২০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে।
খুচরা বাজারে এখনও এর পুরো প্রভাব না পড়লেও, কোথাও কোথাও কেজিতে ৫ টাকা বাড়তি দামে পেঁয়াজ বিক্রি করতে দেখা গেছে। এক-দুদিনের মধ্যেই পেঁয়াজের বাজারে চরম অস্থিরতা তৈরি হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন ব্যবসায়ীরা।
১৯ আগস্ট ভারতের অর্থ মন্ত্রণালয় আগামী ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত পেঁয়াজের ওপর ৪০ শতাংশ রপ্তানির শুল্ক আরোপ করার ঘোষণা দিয়েছে বলে জানায় রয়টার্স। এই শুল্ক অবিলম্বে কার্যকর হবে।
অভ্যন্তরীণ বাজারে পেঁয়াজের সরবরাহ বাড়াতে এবং মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ করতে পেঁয়াজ রপ্তানির ওপর এই শুল্ক আরোপ করা হয়েছে বলে জানিয়েছে ভারতের অর্থ মন্ত্রণালয়।
দেশের বৃহত্তম কাঁচাবাজার কারওয়ান বাজারের পেঁয়াজের আড়তে ঘুরে দেখা গেছে, বিভিন্ন দামে পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে। একদিন আগেই যে আড়তদার প্রতি পাল্লা বা ৫ কেজি দেশি পেঁয়াজ বিক্রি করেছেন ৩৮০ টাকায়, সেই আড়তদারই একদিনের ব্যবধানে দাম হাঁকাচ্ছেন ৫০০ টাকা।
বেশিরভাগ আড়তদার ৪৫০ টাকায় বিক্রি করছেন। তবে অল্প কয়েকজনকে দেখা গেছে এখনো ৩৮০ টাকা পাল্লা হিসেবে পেঁয়াজ বিক্রি করছেন।
আমদানি করা পেঁয়াজেও একই চিত্র দেখা গেছে। ২৮০ টাকা থেকে বেড়ে প্রতি পাল্লা পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৩১০ থেকে ৩৩০ টাকা পাল্লা হিসেবে।
এদিকে খুচরা বাজারে প্রতি কেজি দেশি পেঁয়াজ ৮৫ টাকায় এবং আমদানি করা পেঁয়াজ ৭০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। তবে কিছু কিছু দোকানিকে দেশি পেঁয়াজের দাম ৯০ টাকা চাইতে দেখা গেছে।
একদিনের ব্যবধানে দাম বৃদ্ধি কারণ জানতে চাইলে আড়তদার মো. মিন্টু দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, ভারতে পেঁয়াজের দাম বেড়েছে। এর প্রভাবেই দেশেও দাম বাড়ছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক আড়তের বিক্রয়কর্মী টিবিএসকে বলেন, '১৯ আগস্ট রাতে মালিক ফোন করে বললেন, পেঁয়াজ যা আছে বিক্রি বন্ধ করে দাও। আশপাশে কারও থেকে যদি কিনতে পারো, যে দামেই পাও কিনে রাখো।'
আশরাফুল আলম নামের এক বিক্রেতা বলেন, 'পাবনা থেকে পেঁয়াজ আনি। সেখানে দামও বাড়িয়েছে, পেঁয়াজও কম ছাড়ছে।'
এদিকে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের (ডিএই) হিসাব অনুযায়ী, দেশে পেঁয়াজের উৎপাদন ৩৫ লাখ টন ছাড়িয়েছে। এর থেকে অন্তত ২৫ শতাংশ পর্যন্ত পোস্ট-হার্ভেস্ট লস হিসাব করে পেঁয়াজের উৎপাদন-পরবর্তী মজুত হিসাব করা হয়। ক্ষেত্রবিশেষে এই লস আরও বেশি হয়ে থাকে। আর কৃষি মন্ত্রণালয় বলছে, পেঁয়াজের চাহিদা প্রায় ২৮ লাখ টন।
তবে আমদানিকারকসহ পেঁয়াজ ব্যবসায়ীরা বলছেন, দেশে সরকার যে হিসাব দেখাচ্ছে, পেঁয়াজের উৎপাদন তার চেয়ে কম। সে কারণেই সংকট আছে।
গত মে মাসের শেষ দিকেও পেঁয়াজের বাজারে ব্যপক অস্থিরতা তৈরি হয়। তখন প্রতি কেজি দেশি পেঁয়াজের দাম ধাপে ধাপে ১০৫ টাকায় ওঠে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বারবার অনুরোধ করার পরও কৃষি মন্ত্রণালয় আমদানির অনুমতি না দেওয়ার কারণে পেঁয়াজের দাম ১০০ টাকা ছাড়ায়। এরপর ৫ জুন সরকার পেঁয়াজ আমদানির অনুমতি দেওয়া শুরু করে। ভারতীয় পেঁয়াজ আমদানি শুরু হওয়ার পর ধীরে ধীরে দাম কমতে থাকে।
প্রতি কেজি দেশি পেঁয়াজের দাম ৭৫ টাকা পর্যন্ত কমেও আবার ৮৫ টাকায় নিয়মিত হয়। আর আমদানি করা পেঁয়াজের দাম ৫০-৫৫ টাকা থেকে বেড়ে ৭০ টাকায় উঠেছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উদ্ভিদ সঙ্গনিরোধ উইং-এর তথ্য বলছে, আমদানির অনুমতি দেওয়ার পর থেকে ২০ আগস্ট পর্যন্ত মোট ৩.৬৫ লাখ টন পেঁয়াজ দেশে এসেছে। কিন্তু সরকার ১৩.০৪ লাখ টনের বেশি আমদানির অনুমতি দিয়েছে। অর্থাৎ অনুমতি দেওয়া পেঁয়াজের মাত্র ২৭.৬৪ শতাংশ দেশে এসেছে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, দেশে পেঁয়াজের সংকট রয়েছে, এমন তথ্য সরকারের হাতে আছে। তার পরিপ্রেক্ষিতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় একাধিকবার কৃষি মন্ত্রণালয়কে তাগাদাপত্র দিয়েছে।
কিন্তু অনুমতি নেওয়ার বেলায় ব্যবসায়ীদের মধ্যে যতটা আগ্রহ দেখা গেছে, পেঁয়াজ আমদানিতে তাদের ততটা আগ্রহ নেই।
শ্যামবাজারের পেঁয়াজ আমদানিকারক হাজী মো. মাজেদ টিবিএসকে বলেন, 'আমদানি করে যদি দেখি লোকসান হচ্ছে, তখন তো কেউ সেটা আনবে না। যখন লাভ হবে, তখন সবাই আমদানি করবে।'
তিনি বলেন, 'ভারত পেঁয়াজের রপ্তানির ওপর শুল্ক আরোপের ঘোষণা দেওয়ায় এখন আমদানির খরচ বাড়বে। এর আগে আমরা প্রতি টন পেঁয়াজ ৩০০ ডলারের আশপাশে কিনেছি। এখন সেখানে খরচ বাড়বে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত।'
আমদানিকারকরা জানান, শ্যামবাজারেও একদিনের ব্যবধানে পেঁয়াজের দাম ৭ থেকে ১০ টাকা পর্যন্ত বেড়ে দেশি পেঁয়াজ ৭০-৭২ টাকা কেজি এবং আমদানি করা পেঁয়াজ ৬০-৬২ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে।
ইকোনোমিক টাইমস অভ ইন্ডিয়ার এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, দেশটিতে পেঁয়াজের দাম আগামী মাসেই দ্বিগুণ হয়ে ৫৫ থেকে ৬০ রুপিতে ওঠার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। এই অস্থিরতা ঠেকাতে সরকারের মজুত থেকে ইতিমধ্যে বাজারে ৩ লাখ টন পেঁয়াজ ছাড়া হয়েছে।
এদিকে ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ বর্তমানে ১ কোটি কার্ডধারী পরিবারের কাছে ভর্তুকি মূল্যে চাল, তেল ও মশুর ডাল বিক্রি করছে। বাজারে দাম বেশি হওয়ায় এর সঙ্গে পেঁয়াজও যোগ করতে চাচ্ছে। সে কারণে সম্প্রতি ২০ হাজার টন পেঁয়াজ কেনার একটি আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করেছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা টিবিএসকে বলেন, 'আগামী দুই-তিন মাস পেঁয়াজ আমাদেরকে ব্যপকভাবে ভোগাতে পারে। কৃষি মন্ত্রণালয়কে মে মাসের শুরুতেই বলা হয়েছিল আমদানির অনুমতি দেওয়ার জন্য। কিন্তু তারা সেটা দেয়নি। উল্টো বলেছে, দেশে পেঁয়াজের অভাব নেই।
'তা-ই যদি হয়, তাহলে একদিনের ঘোষণাতেই পাইকারি বাজারে পেঁয়াজের দাম কেন এত বেড়ে গেল?'
তিনি বলেন, ভারত এরপর নূনতম রপ্তানি মূল্য বেঁধে দেবে, এবং পরের ধাপে গিয়ে রপ্তানি নিষেধাজ্ঞাও দিতে পারে।
রোববার এক অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে কৃষিমন্ত্রী মো. আব্দুর রাজ্জাক বলেন, দেশের কৃষকদের কাছে এখনও তুলনামূলকভাবে বড় পেঁয়াজের মজুদ আছে।
'কাজেই দেশে পেঁয়াজের দামে তেমন প্রভাব পড়বে না। শুল্ক আরোপের ঘোষণায় এখন দাম কিছুটা বাড়লেও কয়েকদিন পর কমে আসবে,' বলেন তিনি।
তুরস্ক, মিশর ও চীন থেকে পেঁয়াজ আমদানির চেষ্টা করা হবে বলেও জানান মন্ত্রী।