১৯৭১: আজ তো ঈদ, তাই মাংস!
মেলাঘর। বাংলাদেশের সীমান্ত সংলগ্ন ত্রিপুরা রাজ্যের এই এলাকা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এক বিশেষ নাম। ২০১৪ সালের ডিসেম্বর মাসে ত্রিপুরা রাজ্য সরকারের আমন্ত্রণে আগরতলা যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল। উপলক্ষ বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী বিজয় উৎসব। ওই অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়ার পর ঘুরে দেখার সুযোগ হয় মেলাঘর।
মেলাঘরেই ছিল দুই নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধাদের প্রধান ঘাঁটি। এই সেক্টরের যোদ্ধাদের কাছে এলাকাটি বিশেষ স্মৃতিবিজড়িত। ১৯৭১ সালে লে. কর্নেল খালেদ মোশাররফ ও মেজর হায়দারের (যুদ্ধ শুরুর সময় খালেদ মোশররফের পদবী ছিল মেজর আর হায়দারের ক্যাপ্টেন, পরে তারা পদোন্নতি পান) অধীনে এখানেই ট্রেনিং নিয়েছিল হাজার হাজার তরুণ। এখানেই গেরিলা যুদ্ধের কৌশল রপ্ত করেছেন রুমি, বদি, চুল্লু, আজাদসহ ঢাকার দুর্ষর্ধ সব গেরিলা যোদ্ধা। এখানে মূলত ঢাকা মহানগর, ঢাকা জেলা, কুমিল্লা, নোয়াখালি ও ফরিদপুরের যোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ হত।
১৯৭১ সালে মেলাঘর ছিল ঘন বন, জলা-জঙ্গলে পরিপূর্ণ একটি এলাকা। বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও ইউটিউবে সেক্টর কমান্ডার খালেদ মোশাররফের শপথ বাক্য পাঠ ও যোদ্ধাদের যে সমস্বরে 'জয় বাংলা' ধ্বনি দিতে দেখা যায়, ওই ভিডিও চিত্র মেলাঘরে একটি টিলার উপর স্থাপিত ক্যাম্পে ধারণ করা হয়েছিল।
তখন সেখানে ছিল ঘন শালবন। বিশাল বিশাল গাছ। এখন ওই জায়গাতে আর বন নেই। টিলাটি মাটির সঙ্গে মিশলেও কিছু উঁচু অংশ এখনো দৃশ্যমান।
ওই টিলার ওপরই হাঁটতে হাঁটতে কথা হয়েছিল এই ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ নেওয়া মুক্তিযোদ্ধা অজয় দাশগুপ্তের সঙ্গে। আলাপচারিতায় তার কাছে জানতে চেয়েছিলাম, কেমন ছিল ১৯৭১ সালের ঈদের দিন। কীভাবে ওই ক্যাম্পের যোদ্ধারা কাটিয়েছিলেন যুদ্ধদিনের ঈদ।
মুক্তিযোদ্ধা অজয় দাশগুপ্ত জানান, 'ওই সময় ক্যাম্পের অবস্থা ছিল খুবই কঠিন। ঠিকমতো খাবার পাওয়া যেত না। একটি মাত্র টিউবওয়েল। অন্যান্য সুযোগ সুবিধাও ছিল অপ্রতুল। আমরা খুব সামান্য খাবার পেতাম। একদিন হঠাৎ খাবারের সঙ্গে আমাদের মাংস দেওয়া হল। সবার মধ্যেই কৌতুহল। মাংস কেন? আজ কি কোনো বিশেষ দিন? তখন আমাদের খাবার পরিবেশনকারী জানাল, আজ তো ঈদ! তাই মাংস। এই কথা শুনেই ক্যাম্পে থাকা একটা ছেলে হাউমাউ করে কেঁদে উঠল।'
মেলাঘরের ওই ক্যাম্পে ঢাকার বেশির ভাগ সচ্ছল, সম্ভ্রান্ত ও অগ্রসর তরুণের জমায়েত ছিল। ঈদের কথা জানতেই ঐ তরুণ যোদ্ধার মনে পড়েছিল ঢাকায় অবরুদ্ধ তার বাবা-মায়ের কথা। তারা আজও বেঁচে আছে কি না, তা নিয়ে ছিল সংশয় আর শঙ্কা।
অজয় দাশগুপ্ত জানান '১৯৭১ সালের ওই ঈদের দিন ওই তরুণ যোদ্ধার সঙ্গে কেঁদেছিল অনেকেই। সবার কাহিনি একই। দেশ-মাতৃকাকে মুক্ত করতে তারা সবাই প্রথমবারের মতো অস্ত্র হাতে নিয়েছেন। চৌদ্দ বংশের কেউ কোনোদিন যুদ্ধ করেননি। এই যুদ্ধ কবে শেষ হবে- জানা নেই। বাবা-মা, পরিবার-পরিজন বেঁচে আছে কি না, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। এমন পরিস্থিতিতে খুশির ঈদ! ওই ঈদ ছিল অন্য রকম।'
১৯৭১ সালে নিশ্চয় মেলাঘরের ওই ক্যাম্পের মতোই অনেকটা একই পরিস্থিতি ছিল বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তবর্তী এলাকায় গড়ে ওঠা অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধা শিবিরে।
১৯৭১ সালে ঈদুল ফিতরের দিনটি ছিল ২০ নভেম্বর। শনিবার। ওই সময় মুক্তিযোদ্ধারা অনেক পরিণত। যুদ্ধ কৌশলে তারা বারবার পরাজিত করছিলেন পাক সেনাদের। ভারত সরকারও অপেক্ষাকৃত বেশি আধুনিক অস্ত্র ও গেলাবারুদ সরবরাহ করছিল রণাঙ্গনে। সবকিছু মিলিয়ে বলা যায়, দুর্দান্ত গতিতেই এগিয়ে চলছিল মুক্তিসংগ্রাম। এমন পরিস্থিতিতে ওই ঈদের দিন অনেক মুক্তিযোদ্ধা অবস্থান করছিলেন বাংলাদেশের ভূ-খণ্ডে। অনেকেই পরিবার পরিজনের সঙ্গে দেখাও করেছেন।
১৯৭১ সালের ওই ঈদে দেশের ভেতরেই ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা জহির উদ্দীন জালাল। যিনি 'বিচ্ছু জালাল' নামেই বেশি পরিচিত। যুদ্ধকালীন সময়ে তার বয়স ছিল মাত্র ১৪ বছর ৯ মাস। বিচ্ছু জালাল জানান, 'আমরা ছিলাম খালেদ ও হায়দার ভাইয়ের অধীনে। আমরা একের পর এক অপারশেন চালাচ্ছিলাম ঢাকা ও এর আশপাশে। ঐ সময় আমাদের অপারেশনগুলোর বেশির ভাগই সফল হচ্ছিল। ঈদের দিন আমরা ছিলাম ঢাকার উপকণ্ঠে, কেরানীগঞ্জ ও সিংগাইরের মাঝামাঝি ইসলামপুর নামে একটা গ্রামে। আমাদের একটা দল ওই গ্রামে আশ্রয় নিয়েছিল।'
'ঈদের দিন গ্রামবাসী, বিশেষ করে গ্রামের চেয়ারম্যান আমাদের পেয়ে খুব খুশি ছিলেন। আমি তখন খুবই বাচ্চা ছেলে, সকালে গ্রামের নাপিতের কাছে চুল কাটালাম। গোসল করে সবাই মিলে নামাজ পড়তে গেলাম। ওই নামাজে আশপাশের গ্রামে অবস্থান নেওয়া আরও ৫-৬টি মুক্তিযোদ্ধাদের দল আমাদের সঙ্গে নামাজ পড়ে। আসলে আমরা সবাই ভেতরে ভেতরে সিদ্ধান্ত নিয়ে একটা গেট টুগেদারের মতো করে ওই গ্রামের মাঠে নামাজ পড়ি। ওই দিন আমি সবার মাঝেই উদ্দীপনা দেখেছিলাম। সবাই প্রায় নিশ্চিত ছিলেন, দেশ খুব কম সময়ের মধ্যেই স্বাধীন হবে। নামাজ শেষে গ্রামের বাগান আর মাঠে ঘুরে ফিরে আমরা গল্প করে সময় কাটাই। সন্ধ্যার পর খাওয়া দাওয়া করে যে যার মতো নিজ নিজ অবস্থানে ফিরে যাই।'- বলছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা বিচ্ছু জালাল।
একাত্তরে অবরুদ্ধ ঢাকার ঈদও ছিল অন্য রকম। ইয়াহিয়া সরকার সবকিছুই ঠিক আছে, সব কিছুই নিয়ন্ত্রণে- এমন বলার চেষ্টা করলেও আসলেই ঢাকার অবস্থা ছিল খুবই ভীতিকর। মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণে বিপর্যস্ত ছিল পাকিস্তানিরা। ভয়ার্ত, অস্বাভাবিক আক্রমণে মরিয়া পাক সেনারা। আর তাদের অধীনে ঢাকা মহানগরী ছিল এক ভূতুড়ে শহর। সন্ধ্যা হলেই নিস্তব্ধতা।
এমনই দিনে পবিত্র ঈদুল ফিতরের একটি দিনের বর্ণনা দিয়েছেন শহীদ জননী জাহানারা ইমাম। তিনি তার 'একাত্তরের দিনগুলি'তে লিখেছেন, 'আজ ঈদ। ঈদের কোনো আয়োজন নেই আমাদের বাসায়। কারও জামা কাপড় কেনা হয়নি। দরজা-জানালার কাপড় কাচা হয়নি, ঘরের ঝুল ঝাড়া হয়নি। বসার ঘরের টেবিলে রাখা হয়নি আতর দান। শরীফ, জামি ঈদের নামাজও পড়তে যায়নি। কিন্তু আমি ভোরে উঠে ঈদের সেমাই, জর্দা রেঁধেছি। যদি রুমির কোনো সহযোদ্ধা আসে এই বাড়িতে? তাদের খাওয়ানোর জন্য আমি রেঁধেছি পোলাও, কোর্মা, কোপ্তা কাবাব। তারা কেউ এলে আমি চুপিচুপি নিজের হাতে বেড়ে খাওয়াব। তাদের জামায় লাগিয়ে দেবার জন্য এক শিশি আতরও আমি কিনে লুকিয়ে রেখেছি।' (পৃষ্ঠা:২৪৪)
ঢাকার মতো ১৯৭১ সালে ঈদ এসেছিল কলকাতাতেও। সেখানে প্রায় এক কোটি শরণার্থী তখন নিরন্ন, রোগে জর্জরিত। বর্ষার প্যাঁচপ্যাচে কাদায় প্রতিনিয়ত মৃত্যুর হাতছানি। অন্যদিকে কলকাতার থিয়েটার রোডে (বর্তমান শেক্সপিয়ার সরণি) মুজিবনগর সরকারের কার্যালয়েও ঈদ উদযাপিত হয়েছিল ভিন্নভাবে। ওই দিন সরকারের পক্ষ থেকে ছুটি ঘোষণা করা হয়। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রে ভাষণ দেন। মুজিবনগর সরকারের কার্যালয়ের সামনের ছোট্ট মাঠে অনুষ্ঠিত হয় ঈদের জামাত।
ঈদ উপলক্ষে ওই দিন পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পক্ষ থেকে প্রবাসী সরকারের কার্যালয়ে বিভিন্ন উপহার পাঠানো হয়েছিল। যেগুলোর মধ্যে ছিল মিষ্টান্ন, শুকনো খাবার। যতদূর জানা যায়, ওই কার্যালয়ে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পাঠানো সামান্য উপহার গ্রহণ ছাড়া ঈদ উপলক্ষে আর কোনো আয়োজন ছিল না। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ঈদ উদযাপনে আড়ম্বর বা অতিরিক্ত খাবারের আয়োজনের পক্ষে ছিলেন না। তবে ওই রাতে কুষ্টিয়ায় একটা ক্যাম্প পরিদর্শনে যান তিনি। যোদ্ধাদের সঙ্গে কোলাকুলি করেন। তাদের হাতেই তুলে দেন পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তরফ থেকে পাঠানো সামান্য মিষ্টান্ন ও শুকনো খাবার।
রাতে অনেকটা সময় মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে কাটিয়ে ভোরে আবার কলকাতায় ফিরে আসেন তাজউদ্দীন। শেষ হয় ঈদের দিন। পরের দিন থেকেই আবার যুদ্ধ কৌশল আর নানা বিষয় নিয়ে ব্যস্ততা বাড়ে। হাতে সময় নেই, সময় নষ্ট করবার। রণাঙ্গনে দুরন্ত গতিতে এগিয়ে চলেছেন যোদ্ধারা। ১১টি সেক্টরেই প্রশিক্ষিত যোদ্ধারা যুক্ত হচ্ছিলেন। ভারতীদের কাছ থেকে পাওয়া যাচ্ছিল প্রত্যাশিত সহযোগিতা। ইন্দিরা গান্ধি বিশ্বজনমত তৈরিতে চষে বেড়াচ্ছেন ইউরোপ থেকে আমেরিকা। সবকিছু মিলিয়ে পূর্বের নানা সমন্বয়হীনতা পাশ কাটিয়ে দুরন্ত গতিতে পাল্টাচ্ছিল যুদ্ধের গতি প্রকৃতি।
এ সময় প্রয়োজন ছিল আরও অস্ত্রশস্ত্র আর ভারতীয় সরকারের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি। যার জন্য প্রস্তুতি আর আলোচনাও চলছিল। ১৯৭১ সালের ঈদের দিন একটু স্মৃতিকাতরতা, একটু দম নিলেও পরের দিন থেকেই আবারও শুরু হয়েছিল যুদ্ধ জয়ের অভিযান। ফ্রন্টে ফ্রন্টে জোরদার হয় আক্রমণ।
- লেখক: সহকারী অধ্যাপক, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ