হৃদপিণ্ডের সুস্বাস্থ্যে মাছের তেলের সাপ্লিমেন্টের উপকারিতা অতিরঞ্জিত: গবেষণা
সাপ্লিমেন্ট আকারে বিক্রি করা মাছের তেলের ক্যাপসুল হৃদযন্ত্রের জন্য বেশ উপকারী- এমন একটা ধারণা বেশ প্রচলিত। কিন্তু বেশিরভাগ গবেষণাতেই এর স্বপক্ষে উল্লেখযোগ্য কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তবুও মাছের তেলের সাপ্লিমেন্ট তৈরিকারী ও বিক্রেতারা হৃদযন্ত্রের জন্য উপকারী বলে তা গ্রাহকদের কাছে অহরহ বিক্রি করছে।
গত বুধবার জার্নাল অফ দ্য আমেরিকান মেডিক্যাল এ্যাসোসিয়েশন প্রকাশিত এক গবেষণায় এমন তথ্য উঠে এসেছে।
মাছের তেলের সাপ্লিমেন্ট তৈরি ও বিক্রি বর্তমানে একটি মাল্টি-বিলিয়ন ডলারের শিল্প। অনেকেই প্রতিদিন মাছের তেল ক্যাপসুল হিসেবে গ্রহণ করে থাকেন। তাদের ধারণা, এতে থাকা ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড সার্বিক সুস্বাস্থ্য, বিশেষ করে হৃদপিণ্ডের জন্য উপকারী।
তবে এটা সত্য যে, যারা প্রতিনিয়ত সামুদ্রিক খাবার খায়, তাদের হৃদপিণ্ডের রোগে মৃত্যুর ঝুঁকি কম। তবে মাছের তেল সাপ্লিমেন্ট হিসেবে গ্রহণের ফলেও একই সুবিধা যে পাওয়া যাবে, গবেষণায় এমন কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
সম্প্রতি প্রকাশিত গবেষণায় মাছের তেলের প্রায় ২ হাজার সাপ্লিমেন্ট বিশ্লেষণ করা হয়েছে। এক্ষেত্রে এই প্রত্যেকটির কোম্পানির পক্ষ থেকেই সার্বিক সুস্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে সাপ্লিমেন্টগুলো উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে বলে দাবি করা হয়।
মাছের তেলে দুই ধরণের ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড থাকে। একটি ইপিএ আর অন্যটি ডিএইচএ। এগুলো সাধারণত ফ্যাটি ফিশ, যেমন স্যালমনে পাওয়া যায়।
ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড মূলত হৃদপিণ্ড সম্পর্কিত রোগের ঝুঁকি কমিয়ে থাকে। তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, এর পক্ষ যত গবেষণা রয়েছে, সেগুলো খাদ্যের উপাদান হিসেবে ওমেগা গ্রহণের ওপর ভিত্তি করে করা। সাপ্লিমেন্ট আকারে গ্রহণের ক্ষেত্রে এই গবেষণার ফলাফলগুলো প্রযোজ্য নয়।
অন্যদিকে সম্প্রতি দুটি বড় পরিসরে করা ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে দেখা যায়, বাজারে থাকা মাছের তেলের সাপ্লিমেন্টগুলো হৃদযন্ত্রের জন্য উপকারী, এমন কোনো প্রমাণ নেই।
এ বিষয়ে টেক্সাস সাউথওয়েস্টার্ন মেডিক্যাল সেন্টারের কার্ডিওলজির অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর অ্যান মারি নাভার বলেন, "মাছের তেল বিক্রেতাদের ব্যবহার করা শব্দের অস্পষ্টতা সাপ্লিমেন্টের ভূমিকা সম্পর্কে ভুল তথ্য দিতে পারে।" তিনি প্রকাশিত গবেষণাটির সিনিয়র লেখক হিসেবে ছিলেন।
অ্যান মারি নাভার আরও বলেন, "এটা সত্য যে, ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড নানা ধরণের কার্যকারিতার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। তবে উন্নত-মানের ট্রায়ালে ধারাবাহিকভাবে এমন কোনো ফলাফল আসেনি, যেখানে মাছের তেল সাপ্লিমেন্ট আকারে বেশি পরিমাণে গ্রহণ করলে তা কর্মক্ষমতা বাড়ায় কিংবা রোগ প্রতিরোধ করে।"
একজন চিকিৎসক হিসেবে নাভার প্রায়ই লক্ষ্য করতেন যে, রোগীরা হৃদপিণ্ডের জন্য উপকারী হবে মনে করে নিয়মিত মাছের তেলের সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ করছেন। তিনি রোগীদের জানাতেন যে, এটির সরাসরি কোন উপকারিতা নেই। এক্ষেত্রে তখন রোগীরা অবাক হয়ে যেতেন।
তাই নাভার ও তার সহকর্মীরা মাছের তেলের সাপ্লিমেন্ট নিয়ে একটি গবেষণা শুরু করেন। এই সময় তারা জানতে পারেন যে, শুধু হৃদপিণ্ডই নয়, বরং মস্তিষ্ক, চোখ ইত্যাদি দেহের নানা অঙ্গ-প্রতঙ্গের উপকারিতার কথা বলে সাপ্লিমেন্টগুলো বিক্রি করা হয়েছে।
ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রোগীদের হৃদপিণ্ড সম্পর্কিত রোগের বেশ ঝুঁকি থাকে। তাই ডায়াবেটিস রয়েছে এমন ১৫ হাজার রোগীকে সাপ্লিমেন্টের কার্যকারিতা যাচাইয়ের জন্য একটি র্যান্ডমাইড ট্রায়ালের অংশ করা হয়। সেক্ষেত্রে দেখা যায় যে, হৃদপিন্ড সংক্রান্ত অধিক ঝুকির ক্ষেত্রে ওমেগা-৩ সাপ্লিমেন্ট গ্রহণকারী আর গ্রহণ না করা ব্যাক্তিদের মধ্যে তেমন কোনো পার্থক্য নেই।
আরেকটি র্যান্ডমাইজড ট্রায়ালে মোট ২৫ হাজার জন ব্যক্তিকে পর্যালোচনা করা হয়। সেক্ষেত্রে দেখা যায় যে, সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ করার পরেও ব্যক্তিদের মধ্যে হৃদযন্ত্র সংক্রান্ত জটিলতা কিংবা ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার প্রবণতার কোনো পরিবর্তন আসেনি।
ক্লিভল্যান্ড ক্লিনিকের প্রিভেন্টিভ কার্ডিওলজিস্ট লুক ল্যাফিন প্রকাশিত গবেষণাটির সাথে যুক্ত ছিলেন না। তিনি বলেন, "মাছের তেলের সাপ্লিমেন্ট বিক্রেতারা বিভিন্ন ধরণের স্বাস্থ্য সুবিধার যেসব কথা উল্লেখ করেন, তা গবেষণা সমর্থন করে না। আমাদের কাছে যদি এটি সত্যিকার অর্থেই উপকারী মনে হতো, তবে আমরা অবশ্যই রোগীদের তা গ্রহণের জন্য বলতাম।"
লুক ল্যাফিন বরং রোগীদের সাপ্লিমেন্টের পরিবর্তে প্রতিদিনের খাদ্যাভ্যাসের মাধ্যমে ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিডের চাহিদা পূরণের পরামর্শ দেন। স্যালমন, ম্যাকারেল, ফ্লাক্সসিড ইত্যাদি মাছে প্রচুর পরিমাণে ওমেগা-৩ থাকে। হৃদপিণ্ডের সুস্বাস্থ্যের জন্য খাদ্যাভ্যাসে এগুলো যুক্ত করা যেতে পারে।
পরিশেষে লুক ল্যাফিন বলেন, "একজন কার্ডিওলজিস্ট হিসেবে আমরা রোগীদের যথাযথ মেডিসিন গ্রহণের জন্য বলি। এমন কোনো কিছু গ্রহণের জন্য বলি না, যেগুলো তার দেহে কোনো কাজে আসবে না।"