নেপালি গবেষকরা আবারও একই জায়গায় তুষারচিতা ও চিতাবাঘের দেখা পেলেন
নেপালের গবেষকেরা ফের একই স্থানে একটি তুষারচিতা ও একটি চিতাবাঘের দেখা পেয়েছেন। মূলত দেশটির পূর্ব হিমালয়ের গৌরীশঙ্কর পর্বতের কোলে গবেষকদের স্থাপনকৃত ক্যামেরায় এই দৃশ্য ধরা পড়েছে।
ছবিগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, গত ৪ জানুয়ারি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৪,২৬০ মিটার (১৩,৯৭৬ ফুট) উচ্চতায় লাপচি উপত্যকায় রাস্তা দিয়ে একটি তুষারচিতা হেঁটে যাচ্ছে। তার ঠিক সাত দিন পর একটি চিতাবাঘকে ঐ একই রাস্তা দিয়ে হেঁটে যেতে দেখা যায়।
গৌরীশঙ্কর কনজারভেশন এরিয়ার তত্ত্বাবধানে রয়েছে 'ন্যাশনাল ট্রাস্ট ফর ন্যাচার কনজারভেশন' নামের একটি আধা-সরকারি সংস্থা। এর কর্মকর্তা মধু চেত্রী বলেন, "গৌরীশঙ্কর এলাকায় প্রথমবারের মতো একটি তুষারচিতা ও চিতাবাঘ একই স্থানে ক্যামেরায় ধরা পড়েছে।"
সংরক্ষণবাদীরা ঐতিহ্যগতভাবে প্রায় বিপন্ন বাঘকে নেপালের দক্ষিণ সমভূমি অঞ্চলের সর্বোচ্চ শিকারী বলে মনে করেন। আর প্রায় বিপন্ন চিতাবাঘকে দেখা যায় পাহাড়ি অঞ্চলে ঘুরে বেড়াতে। আর পাহাড়ী অঞ্চলে অনেকটা উত্তরে দেখা মিলে তুষারচিতা।
তবে গবেষকদের মতে, বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির সাথে সাথে সম্প্রতি প্রাণীটির নির্দিষ্ট অঞ্চলে বসবাসের ধরণেও সম্ভবত বেশ দ্রুত পরিবর্তন আসছে।
মধু চেত্রী জানান, ছবিগুলো তোলার জন্য লাপচি উপত্যকায় গত বছরের নভেম্বর থেকে শুরু করে ২০২৩ সালে মে মাস পর্যন্ত ক্যামেরা স্থাপন করা হয়েছিল। মোট ১৪১.৬৩ বর্গ কিলোমিটার এলাকা আয়ত্তের জন্য সেখানে ২৬ টি ক্যামেরা স্থাপন করা হয়েছিল।
ক্যামেরাগুলো দিয়ে ঐ সময়ে তুষারচিতা ও চিতাবাঘের মোট ৫৫,২১৯ টি ছবি তোলা হয়। বর্তমানে চেত্রী ও অন্যান্য গবেষকেরা ঐ ছবিগুলো বিশ্লেষণ করেছেন।
মধু চেত্রী গণমাধ্যম মোঙ্গাবেতে বলেন, "সংরক্ষণ এলাকাটি কোমোলাংমা ন্যাশনাল ন্যাচারাল রিজার্ভের দক্ষিণে অবস্থিত, যা তিব্বতের বৃহত্তম প্রাকৃতিক সংরক্ষণ এলাকা। বৈচিত্র্যময় ভৌতগত ও জলবায়ুগত বৈশিষ্ট্যের কারণে এটি উদ্ভিদ ও প্রাণীর বৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ।"
এর আগে ২০১৬ সালে জুলাই মাসে গবেষকেরা চীনের তিব্বত মালভূমিতে প্রথমবারের মতো তুষারচিতা ও চিতাবাঘকে একই অঞ্চলে অবস্থানের ভিডিও ক্লিপ সংগ্রহ করে। একইভাবে ২০১৩ সালে ইতালির একদল গবেষক মাউন্ট এভারেস্টের ন্যাশনাল পার্কে প্রাণীদের মলের নমুনা বিশ্লেষণ করে দেখা যায় যে, একই এলাকায় তুষারচিতা এবং চিতাবাঘ বসবাস করছে।
গবেষণায় দেখা যায় যে, চিতাবাঘগুলো কম উচ্চতায় থেকে ছোট কিন্তু সংখ্যায় বেশি প্রজাতির প্রাণী শিকার করে থাকে। আর তুষারচিতা অপেক্ষাকৃত বেশি উচ্চতায় থেকে আকারে বড় কিন্তু সংখ্যায় কম প্রজাতিকে শিকার করে।
গবেষক বিক্রম শ্রেষ্ঠ তুষারচিতা নিয়ে দীর্ঘ সময় গবেষণা করেছেন। ২০১১ থেকে ২০১৩ সালের মধ্যে তিনি ৪,৫০০ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত নেপালের মুস্তাং অঞ্চলে চিতাবাঘ নিয়ে একটি সার্ভে পরিচালনা করেছিলেন। সেখানেও তিনি একই অঞ্চলে তুষারচিতা ও চিতাবাঘের বসবাসের প্রমাণ পেয়েছেন। তবে পরবর্তীতে গবেষণা ফলাফলটি 'পিয়ার রিভিউ' হয়নি।
বেশ কয়েকটি গবেষণায় দেখা যায়, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে তুষারচিতা ও চিতাবাঘ উভয় প্রজাতিই উপযুক্ত বাসস্থানের সন্ধানে অঞ্চলটির উত্তরের দিকে সরে আসছে; যেটি সাধারণত তুষারচিতার আবাসস্থল।
উভয় প্রজাতির চিতাবাঘের বাসস্থানে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব নিয়ে কাজ করে যাওয়া কেদার বারাল বলেন, "তুষারচিতা ও চিতাবাঘের একই স্থানে বসবাসের ঘটনা সামনে হয়তো আরও বেশি পরিমাণে দেখা যাবে। কেননা জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে চিতাবাঘের বাসস্থান অনুপযোগী হচ্ছে এবং বেশি উচ্চতার জায়গাগুলো বসবাসের জন্য উপযুক্ত হচ্ছে।"
মধু চেত্রী বলেন, "গবেষকরা দেখিয়েছেন যে, হিমালয়ে বর্তমানে চিতাবাঘের অধিক্রমণের কারণে ওপরের বনবৃক্ষ লাইন ইতোমধ্যে উচ্চহারে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। ফলে শেষ পর্যন্ত তা তুষারচিতার আবাসস্থলের সংকট তৈরি করতে পারে।"
হিমালয়ে তুষারচিতার প্রজাতি রক্ষার্থে কাজ করে যাওয়া রিনজিন ফুঞ্জোক লামা মনে করেন, এর আগেও তুষারচিতা সম্ভবত চিতাবাঘের সাথে একই আবাস্থলে থেকেছে। তবে গত কয়েক বছরে স্থাপন করা ক্যামেরা থেকে দেখা যায় যে, দুটি প্রজাতির আবাসস্থল একে অপরের সাথে ব্যাপকভাবে মিশে যাচ্ছে এবং চিতাবাঘ সত্যিকার অর্থেই উত্তর দিকের অঞ্চলে চলে যেতে পারে।
রিনজিন ফুঞ্জোক লামা বলেন, "যেহেতু ট্রি লাইন অনেকটা ঊর্ধ্বমুখী, সেক্ষেত্রে চিতাবাঘ খুব সহজেই গাছে চড়তে পারে এবং খুব সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে। কিন্তু মেরু চিতাবাঘ আকারে ছোট হওয়ায় সেটা করতে পারে না।"
তবে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ভিন্ন প্রজাতির চিতা একই স্থানে বসবাস করলে একে অপরের ওপর ঠিক কেমন প্রভাব রাখবে, সেটি পর্যালোচনার জন্য আরও দীর্ঘ সময়ের ধরে তথ্য সংগ্রহ করে পর্যবেক্ষণ করতে হবে। কিন্তু ইঙ্গিতগুলো যে নেতিবাচক; সেটা অনেকটা নিশ্চিত।
বিক্রম শ্রেষ্ঠ বলেন, "২০১১ থেকে ২০১৩ সালের মধ্যে ক্যামেরায় মুস্তাংয়ের একই স্থানে তুষারচিতা ও চিতাবাঘকে দেখা গিয়েছে। কিন্তু ২০১৬ সালে ক্যামেরায় শুধু চিতাবাঘকেই দেখা গিয়েছে।"
বিক্রম শ্রেষ্ঠ আরও বলেন, "এক্ষেত্রে যুক্তিসঙ্গত কারণ হতে পারে যে, চিতাবাঘ হয়তো তুষারচিতার আবাসস্থলে জায়গা করে নিয়েছে। কিন্তু আসলেই এমনটি ঘটেছে কি-না সেটি নিশ্চিতে আরও বিস্তৃত গবেষণার প্রয়োজন।"