অত্যন্ত মিতব্যয়ী জীবনযাপনের ১০টি টিপস
বর্তমান উচ্চ মুল্যস্ফীতির সময়ে আপনি বাজারে গেলে প্রতিদিনই অবাক হবেন জিনিসপত্রের বর্ধনশীল মূল্য দেখে। প্রায় প্রতিদিনই কোন না কোন পণ্যের দাম বাড়ছে। গড় মূল্যস্ফীতি গেল ১২ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। গরুর মাংস, মুরগির মাংস এগুলোর দাম অনেক বেশি বেড়েছে। অল্প আয়ের মানুষ এখন গরুর মাংস কিনতে পারছে না বললেই চলে, খাসীর মাংস তো দুরের কথা। শুধু খাবার জিনিসের দাম বেড়েছে তা নয়– ওষুধ, ইলেকট্রনিক্স, ফার্নিচার প্রতিটি জিনিসের দাম অনেক বেড়েছে, কিন্তু দুঃখের বিষয় হল- আপনার আয় বাড়ছে না।
মূল্যস্ফীতির প্রভাবের কারণে মূলত আয় আরও কমছে। এখন খরচের সাথে আয়ের সামঞ্জস্য করা ছাড়া, আপনার সামনে বিশেষ কোন পথ খোলা নেই। সে কারণে আপনাদের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কিছু টিপস দিতে পারি। আপনি কীভাবে অত্যন্ত মিতব্যয়ী জীবনযাপন করতে পারবেন– তার বিস্তারিত থাকছে আজকের আলোচনায়।
এই পরামর্শগুলো যদি আপনারা মেনে চলেন, তাহলে দেখবেন আয়ের সাথে খরচের একটা সামঞ্জস্য আপনি করতে পারবেন।
এক, আপনার মাসিক বাজেটের মূল্যায়ন করুন। এরপর দেখে নিন, কোথায় কোথায় আপনি কমবেশি করে একটা সামঞ্জস্য আনতে পারেন আয়-ব্যয়ের মধ্যে। এখন আপনার বাজেটে অনেক হিসেবী হতে হবে। নাহলে প্রত্যেক মাসে আপনাকে ঋণ করতে হবে, অথবা আগের যে সঞ্চয় আছে- তা ভাঙ্গতে হবে। খরচের মূল্যায়ন করার সময় এটি লিখে ফেলুন। লেখার পর দেখুন কোন কোন খরচ আপনি কমাতে পারেন। যেখানে সপ্তাহে আপনি তিনদিন মাংস খেতেন, সেটা এখন একদিন করেন। কেউ হয়তো মাসে চারদিন মাংস খেতেন, সেটা দুই দিন করেন। যিনি বেশি গরুর মাংস খান- তিনি মুরগি বাড়িয়ে গরুর মাংস কমিয়ে দিন। এভাবে আপনি আপনার মত করে বিভিন্ন পণ্যের মধ্যে ভারসাম্য আনুন।
দুই, মুদিপণ্য বা আসবাবপত্র, ইলেকট্রনিক্স, পোশাক – যেকোনো কিছু কেনার সময় আপনি একটু ঘুরে, দরদাম করে তারপরে কিনুন। আগে হয়তো কোন দরদাম না করেই কিনে ফেলতেন, হয়তো কোন একটা ফার্নিচার দোকানে ঢুকলে একবারে কিনতে পারতেন, কিন্তু এখন আর তা করবেন না। কারণ, আপনি এখন একটা কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে পড়ে গেছেন বা আমরা সবাই পড়ে গেছি। ফলে যেকোনো কিছু কেনার আগে এখন একটু দর কষাকষি করুন। কাঁচাবাজার আপনি হয়তো মহাখালী বাজার থেকে কিনেন, সেখান থেকে না কিনে যদি কারওয়ানবাজার যান তাহলে আপনি অনেক কমে কিনতে পারবেন। এরকম প্রত্যেকটা জিনিসের ক্ষেত্রে জেনেবুঝে কিনলে- আপনার খরচ কম হবে। আগে যেমন আপনি চিন্তা কম করতেন খরচ করার ক্ষেত্রে, এখন একটু চিন্তা করুন, খরচ বাঁচান।
তিন, পরিবহন খরচের ব্যাপারে সতর্ক থাকুন। যাদের গাড়ি আছে তাঁদের যে সবসময় নিজের গাড়ি চালিয়ে সব জায়গায় যেতে হবে এমনটি নয়। দরকার হলে গণপরিবহন ব্যবহার করবেন। হয়তো যে দূরত্বে আপনি আগে রিকশায় যেতেন, সেখানে এখন হেঁটে হেঁটে যেতে পারেন। আবার আমরা অনেকক্ষণ অল্প প্রয়োজনে অনেক জায়গায় ভ্রমণ করি, এগুলো কমিয়ে দিন। বরং, একসাথে অনেকগুলো কাজ ঠিক করে তারপরে বের হন, তাহলে একসাথে বেশকিছু কাজ করে ফিরতে পারবেন। ঢাকা শহরের পরিবহন খরচ অনেক বেশি। আর যারা গাড়ি চালান তাদের জ্বালানি খরচও বেশি। ফলে এই দিকগুলো একটু সমন্বয় করুন। চিন্তা করুন- দেখবেন পথ বেরিয়ে গেছে।
চার, খাবারের ব্যাপারে একটু ক্রিয়েটিভ বা সৃজনশীল হোন। ক্রিয়েটিভ বলতে কি বুঝাচ্ছি, আপনি হয়ত মাসে কয়েকবারই কফি শপে যান, ফ্যামিলি মেম্বারদের নিয়ে ভালো রেস্টুরেন্টে খান। তারপর আপনার বাচ্চাদের জন্য বাইরে থেকে অর্ডার করে খাবার নিয়ে আসেন; এই প্রত্যেকটা জিনিস এখন একটু মূল্যায়ন করূন। বাইরের খাবার কমিয়ে দিন। কফি শপে না গিয়ে– সেই কফি বাসায় বানিয়ে খান। আবার যে দোকানে দাম অনেক বেশি, সেটাকে এড়িয়ে একটু কম দামি দোকানে যান, খরচ কমে যাবে। এমন বিভিন্নভাবে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করুন।
পাঁচ, পুরনো কাপড়চোপড় এবং ফার্নিচারের প্রতি যত্নশীল হোন। অনেকের ফার্নিচার কিছু দিন পর পর পাল্টানোর অভ্যাস আছে। অনেকে কাপড় কিনতে পছন্দ করেন, শপিং করতে পছন্দ করেন। এখন যেহেতু সময় খারাপ, একটু চিন্তা করে দেখুন– আপনার যে ফার্নিচার আছে সেটা না বদলালেও চলে কি-না। যদি একেবারে ভেঙ্গে যায়, মেরামত করুন। বাসায় খুঁজে দেখুন- অনেক কাপড় আছে, ফলে নতুন কাপড় এখন না কিনলেও হয় কি-না। পুরোনো হলেও কাপড় ভালো হলে- একটা জামা বা প্যান্ট তো অনেক দিন টেকে। সুতরাং, বারবার কেন চেঞ্জ করতে হবে? পরিষ্কার হলেই তো হলো। তাছাড়া যদি ফার্নিচার কিনতেই হয়, পুরনো ফার্নিচার কিনতে পাওয়া যায়, সুন্দর সুন্দর ফার্নিচার, সেদিকেও মনোযোগ দিতে পারেন। সেই ফার্নিচার কিনে আপনি পলিশ করে নিলে একেবারে নতুনের মতো হয়ে যাবে।
ছয়, বাসায় যে পুরনো কাপড়চোপড়, আসবাবপত্র, বাসনপত্র ইত্যাদি আছে যা আপনারা ব্যবহার করেন না, সেগুলোকে দান করে দিন বা মানুষকে দিয়ে দিন। দেখবেন এটাতে আপনার উপকার হবে এবং সামষ্টিকভাবে যদি দেখেন, সমাজের সব মানুষ যদি এই কাজটা করে– তাতেও দেখবেন আপনার টাকাপয়সা সাশ্রয় হবে।
সাত, টাকা খরচ না করে কিভাবে আনন্দ করা যায়- সেটা খুঁজুন। যেমন আপনার খারাপ লাগছে আপনি চলে যেতে পারেন কোন রিসোর্টে, সেখানে অনেক খরচ। আপনি চলে যেতে পারেন- কক্সবাজার বা অন্য কোথাও, সেখানেও অনেক খরচ। আনন্দ পাওয়ার জন্য টাকা খরচ করার বিকল্প আমরা অন্য কোন পথ দেখি না। খারাপ লাগছে, সবাই মিলে রেস্টুরেন্টে খেতে গেলে ভালো লাগবে, কিন্তু অনেক টাকা খরচের বিষয় আছে।
ভাবতে হবে আমি টাকা খরচ করবো না, কিন্তু মজা করবো। বাচ্চাদের সবাইকে নিয়ে যদি পার্কে যান, দেখবেন ভালো লাগছে। সকালে উঠে একটু হাঁটতে বের হন, মুক্ত বাতাসে একটু হাঁটুন। পূর্বাচল বা এরকম দূরে কোথাও চলে যান চা, কফি খান– আপনার খরচের লাগাম টেনে ধরতে পারবেন। আপনার আনন্দ হবে, কিন্তু খরচ কম হবে। সুতরাং, এমন দিকে মনোযোগ দিন যেখানে আনন্দ পাবেন, কিন্তু খরচ হবে না বা অল্প হবে।
আট, বিভিন্ন পাড়ামহল্লায় লাইব্রেরি আছে, এগুলোর সুবিধা নিন। বইয়ের দাম কিন্তু কম না। বই কিনতে আমি সবাইকে খুবই উৎসাহিত করি। কিন্তু, খারাপ সময়ে বই না কিনে যদি কোন লাইব্রেরিতে পড়ে বা ধার নিয়ে আপনার প্রয়োজন মেটাতে পারেন, তাহলে সেটা আপনি করতে পারেন। যারা জিমে যেতে অভ্যস্ত, তারা খরচ কমানোর জন্য যদি সরকারি জিমে যান বা পার্কে গিয়ে ফ্রি হ্যান্ড এক্সারসাইজ করুন, হাঁটুন দেখবেন আপনি ঠিকই সুফল পাচ্ছেন। জিমে প্রতি মাসে যে টাকা দেয়া লাগে- তা আর দিতে হবে না।
নয়, শুধু সেসব জিনিস কিনুন যা আপনার খুবই দরকার, না কিনলেই নয়। কোন জিনিস কেনার আগে নিজেকে কয়েকটি প্রশ্ন করুন। এই জিনিস আপনি কেন কিনবেন? এই জিনিস কি আপনার কিনতেই হবে? এই জিনিস না কিনে কি পারা যায় না? যদি দেখেন যে এই জিনিস কিনতেই হবে, না কিনে আপনার কোন উপায় নেই, কোন বিকল্প নেই, তাহলে হয়তো আপনার সেটা কিনতে হবে। কিন্তু, অনেক জিনিস আছে যা না কিনলেও চলে। এই খরচগুলো আপনি এড়িয়ে চলুন। একান্ত চাহিদার উপরে মনোযোগ দিন, বাড়তি চাহিদার ওপরে মনোযোগ কমিয়ে দিন। তাতে আপনার খরচ সাশ্রয় হবে।
দশ, বাসার যেসব মেরামত, সংস্কারের কাজগুলো নিজেই করার চেষ্টা করুন। বাথরুমের ট্যাপ নষ্ট হয়েছে, লাইট বদলাতে হবে, চুলায় বা পানির ট্যাপে সমস্যা হয়েছে, কমোডে কোন সমস্যা হয়েছে- এগুলো খুব মারাত্মক কোন সমস্যা নয়। কিন্তু, সমাধান করার জন্য অনেক টাকা খরচ করতে হয়। এ কাজগুলো শিখে নিতে চেষ্টা করুন এবং নিজে করুন। দেখবেন, এখানেও প্রতি মাসে অনেক টাকা বেঁচে যাবে।
আপনি যদি এই কয়েকটা দিকে ফোকাস করতে পারেন– তাহলে দেখবেন আপনার জীবনের মান বেশি কমছে না বরং একটা সুন্দর স্বাচ্ছন্দ্যময় জীবন পাচ্ছেন। সুতরাং, মিতব্যয়ের মধ্যে সুখী থাকার মতো জীবনযাপন করুন এবং বর্তমান আর্থিক সংকটের এই বিপদ থেকে নিজেকে বাঁচান। তাছাড়া, কোনভাবে আপনার আয় বাড়ানো যায় কিনা– তার চেষ্টাও করুন ।
লেখক: অর্থনীতি বিশ্লেষক, ফাইন্যান্স ও বিজনেস স্ট্র্যাটেজিস্ট; ইউটিউবার ও সিইও, ফিনপাওয়ার লিডারশীপ ইন্টারন্যাশনাল।
বিশেষ দ্রষ্টব্য: নিবন্ধের বিশ্লেষণটি লেখকের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও পর্যবেক্ষণের প্রতিফল। অবধারিতভাবে তা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের অবস্থান বা সম্পাদকীয় নীতির প্রতিফলন নয়।