রাশিয়ার ওয়াগনার বাহিনী নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে না!
ভাড়াটে যোদ্ধা সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান- ওয়াগনারের প্রতিষ্ঠাতা ইয়েভগেনি প্রিগোঝিনের মৃত্যুর পর, ক্রেমলিনের অনুগত নিরাপত্তা গোষ্ঠীগুলো – ইউক্রেন ও আফ্রিকায় – ওয়াগনারের যোদ্ধাদের নিয়ন্ত্রণে আনার উদ্যোগ নিয়েছে।
রাশিয়ার নিরাপত্তা বাহিনী ও অলিগার্কদের সাথে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ভাড়াটে যোদ্ধা সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান– হাজার হাজার ওয়াগনার যোদ্ধাকে নিজেদের দলে ভেড়ানোর পদক্ষেপ নিচ্ছে।
এভাবে ইউক্রেন যুদ্ধের জন্য অভিজ্ঞ যোদ্ধাদের পেতে চাইছে ক্রেমলিন, এবং আফ্রিকা মহাদেশের বিভিন্ন অংশে ওয়াগনার যে প্রভাব-প্রতিপত্তি লাভ করেছে, তাও ধরে রাখতে চায়।
গত মাসে মস্কোর বাইরে বিধ্বস্ত হয় প্রিগোঝিনের বিমান। রুশ কর্তৃপক্ষ প্রথমদিকে বলেছিলেন, আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা বিমানটিকে ভূপাতিত করেছে। তবে পশ্চিমা বিশেষজ্ঞরা ধারণা করছেন, বিমানে বোমা পেতে রাখা হয়েছিল। মার্কিন গোয়েন্দা কর্মকর্তারা মনে করেন, প্রিগোঝিনকে হত্যা করা হয়েছে।
তার আগে জুনে রাশিয়ার সামরিক বাহিনীর শীর্ষ নেতৃত্বকে উৎখাতের উদ্দেশ্যে বিদ্রোহ করেন প্রিগোঝিন। তবে এই ঘটনা রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিনের শাসনের বিরুদ্ধে এপর্যন্ত সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দেয়।
প্রিগোঝিনের মৃত্যু/হত্যার মধ্যে দিয়ে সেই হুমকির অবসান হয়েছে। এখন ওয়াগনারের মূল্যবান সামরিক সম্পদ – তাদের দক্ষ ও যুদ্ধাভিজ্ঞ সেনাদের নিয়ন্ত্রণ চাইছে ক্রেমলিন। এদের অনেকেই আবার ইউক্রেনের রণাঙ্গনের সাথে পরিচিত।
প্রিগোঝিন মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকার অন্তত আধ-ডজন দেশে ওয়াগনারের উপস্থিতি তৈরি করেছিলেন। এসব দেশের রাজনৈতিক নেতাদের নিরাপত্তা দিচ্ছে প্রায় ৬ হাজারের কাছাকাছি ওয়াগনার মার্সেনারি। নিরাপত্তার বিনিময়ে তারা মূল্যবান প্রাকৃতিক সম্পদ উত্তোলন ও বিক্রির সুযোগ পাচ্ছে।
আফ্রিকান ও পশ্চিমা দেশগুলোর কর্মকর্তাদের মতে, ক্রেমলিন এসব ইউনিটেরও নিয়ন্ত্রণ নিতে শুরু করেছে।
সাম্প্রতিক মাসগুলোয় ওয়াগনারের ওপর আস্থা হারাতে থাকে ক্রেমলিন। এসময়ে ক্রেমলিনের ঘনিষ্ঠ রাশিয়ার অন্যান্য বেসরকারি মার্সেনারি সংস্থা ইউক্রেনে তাদের যোদ্ধা পাঠিয়েছে – পুতিনের সুনজরে থাকতে।
এসব ভাড়াটে যোদ্ধা সরবরাহকারীর মধ্যে কিছু কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা আবার সাবেক গোয়েন্দা কর্মকর্তারা, আর তাতে অর্থায়ন করছেন পুতিন ঘনিষ্ঠ অলিগার্করা। রাশিয়ার রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানিগুলো এদের নিয়ন্ত্রণ করছে।
এমন একটি কোম্পানি হচ্ছে রেদুত, প্রতিষ্ঠানটি এখন ইউক্রেনে যুদ্ধ করার অভিজ্ঞতা-সম্পন্ন ওয়াগনার সেনাদের ভর্তি করছে বলে জার্নালকে জানিয়েছেন রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের ঘনিষ্ঠ এক ব্যক্তি। এবিষয়ে মন্তব্যের জন্য রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় ও ক্রেমলিনের সাথে যোগাযোগও করে জার্নাল। কিন্তু, তারা এতে সাড়া দেয়নি।
২০০৮ সালে রাশিয়ার সাবেক জনাকয়েক ছত্রীসেনা (প্যারাট্রুপার) ও সামরিক গোয়েন্দা বাহিনীর কর্মকর্তা রেদুত প্রতিষ্ঠা করেন। মধ্যপ্রাচ্যে যেসব রুশ কোম্পানির কার্যক্রম রয়েছে– তাদের নিরাপত্তা দিচ্ছে রেদুত।
গত ফেব্রুয়ারিতে রেদুতের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয় যুক্তরাষ্ট্র সরকার। মার্কিন কর্তৃপক্ষ জানান, রাশিয়ার সামরিক গোয়েন্দা বাহিনীর সাথে এখনও রেদুতের সম্পর্ক আছে।
জুলাই মাসে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে দেওয়া ওয়াগনারের একজন পক্ষত্যাগকারীর সাক্ষ্যমতে, রেদুতের অর্থায়নকারী হচ্ছেন- পুতিনের ঘনিষ্ঠ একজন অলিগার্ক গেনেডি তিমোচেঙ্কো।
এনিয়ে তিমোচেঙ্কোর মন্তব্যও জানতে চায় জার্নাল, কিন্তু তিনি সাড়া দেননি।
ওই পক্ষত্যাগকারী ব্রিটিশ আইনপ্রণেতাদের জানান, সিরিয়ায় মোতায়েন থাকা রেদুতের সেনারা তাদের গোলাবারুদ পায় মধ্যপ্রাচ্যের দেশটিতে অবস্থানকারী রুশ সেনাবাহিনীর থেকে।
রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের ঘনিষ্ঠ ওই ব্যক্তি জার্নালকে জানান, সাম্প্রতিক সময়ে মন্ত্রণালয়ের সাথে ওয়াগনারের বিরোধের ইতিহাস থাকায়– অনেক ওয়াগনার যোদ্ধা সরাসরি সেনাবাহিনীতে নাম লেখাতে চাচ্ছে না। এজন্য তাদের আকর্ষণ করতে রেদুতকে একটি নিয়োগ প্ল্যাটফর্ম হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে।
মস্কো-ভিত্তিক সেন্টার ফর এনালাইসিস অব স্ট্রাটেজিস অ্যান্ড টেকনোলজিস- এর পরিচালক রুসলান পুখভ বলেন, 'যোদ্ধাদের তাদের দলে ভেড়াতে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় সম্ভাব্য সব উপায় ব্যবহার করছে।'
প্রিগোঝিনের ব্যর্থ বিদ্রোহের পরে ওয়াগনারের কতিপয় জ্যেষ্ঠ কমান্ডার রেদুতে যোগ দেন। ম্যাসেজিং অ্যাপ টেলিগ্রামে ওয়াগনারের সাথে সংশ্লিষ্ট একটি চ্যানেল জানিয়েছে, ওয়াগনারের সাবেক একজন কর্মকর্তা রেদুতের ভর্তি কার্যক্রমের দায়িত্ব পেয়েছেন।
বিদ্রোহের পর গত জুলাইয়ে রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় জানায়, তারা ওয়াগনারের কাছ থেকে শত শত ট্যাংক, রকেট লঞ্চার ও কামান নিয়ে নিয়েছে। পূর্ব ইউক্রেনে ওয়াগনার যোদ্ধাদের অবস্থান ও ঘাঁটিগুলোর নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে রাশিয়ার সামরিক বাহিনী।
ইউক্রেনের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা বলেন, ইউক্রেনে যুদ্ধ করা ওয়াগনার সদস্যদের মধ্যে রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সাথে চুক্তি করার বিষয়ে গভীর সংশয় আছে।
আস্থার ঘাটতি ক্রেমলিনেরও আছে। তাই ওয়াগনারের যেসব যোদ্ধা রাশিয়ার অন্যান্য মার্সেনারি সংস্থায় যোগ দিয়েছেন, তাদের ইউক্রেন ফ্রন্টলাইনে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে মোতায়েন করা হয়েছে। নির্দিষ্ট কোনো একটি ইউনিটে যাতে প্রিগোঝিনের বিদ্রোহকে সমর্থনকারীদের সংখ্যাধিক্য তৈরি না হয়, সেজন্যই এ পদক্ষেপ।
ওই কর্মকর্তা আরও জানান, সংস্থা বদলালেও- কিছু ক্ষেত্রে ওয়াগনারের সাবেক সেনারা তাদের আগের কমান্ডারদের অধীনে লড়াই করার সুযোগ পাচ্ছে।
রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় ও ক্রেমলিনের সাথে সম্পর্ক থাকা আরেকটি মার্সেনারি গোষ্ঠী হচ্ছে- কনভয়। বিদেশের মাটিতে ওয়াগনারের কার্যক্রম অধিগ্রহণে তারা রেদুতের সাথে প্রতিযোগিতা করছে।
রেদুত প্রকাশ্যেই আফ্রিকায় যেতে ইচ্ছুক ওয়াগনার যোদ্ধাদের আয়ত্তে আনার চেষ্টা করছে। রাশিয়ার সামাজিক মাধ্যম ভিকন্টাক্টে তাদের একটি বিজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, 'ওয়াগনার এখন অতীত। আপনি যদি আফ্রিকায় সত্যিকার অর্থে কাজ পেতে চান, তাহলে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় ও রেদুত পিএমসি-র মধ্যে যেকোনো একটি বেছে নিতে হবে।'
প্রিগোঝিনের কিছু যোদ্ধা এরমধ্যেই কনভয় পিএমসি'তে যোগ দিয়েছেন। যদিও তাদের ভর্তি করতে কনভয় সক্রিয়ভাবে চেষ্টা চালাচ্ছে না বলে ওয়ালস্ট্রিট জার্নালকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে জানান এ প্রতিষ্ঠানের ডেপুটি কমান্ডার ভ্যাসিলি ইয়াশ্চিক।
কনভয়কে নেতৃত্ব দিচ্ছেন কনস্টান্টিন পিকালোভ। ইতঃপূর্বে তিনি আফ্রিকায় ওয়াগনারের সামরিক কার্যক্রম পরিচালনা করেছেন, পরে প্রিগোঝিনের পক্ষত্যাগ করেন।
গত ফেব্রুয়ারিতে পিকালোভের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয় ইউরোপীয় ইউনিয়ন। কারণ হিসেবে ব্রাসেলস জানায়, ২০১৮ সালের জুলাইয়ে মধ্য আফ্রিকা প্রজাতন্ত্রে তিনজন রুশ সাংবাদিককে হত্যা করা হয়, এর পরিকল্পনা করেছেন পিকালোভ।
প্রিগোঝিনের মৃত্যুর দিনকয়েক আগে পিকালোভ বলেছিলেন, কনভয় আফ্রিকার আটটি দেশে কার্যক্রম পরিচালনা করবে। তবে দেশগুলোর নাম উল্লেখ করেননি তিনি।
রাশিয়ার অনুসন্ধানী ওয়েবসাইট আইস্টোরিজ'কে তিনি বলেন, 'আফ্রিকান সেনাদের আমরা নতুন অস্ত্র-সরঞ্জাম দেব, এবং সেগুলোর ব্যবহার শেখাব।'
ভ্যাসিলি ইয়াশ্চিক জানান, সাম্প্রতিক সময়ে রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সাথে বিদেশ সফর করেছেন পিকালোভ। সফরের গন্তব্য দেশগুলোর নাম তিনি উল্লেখ করেননি। তবে খুব সম্ভবত রুশ কর্মকর্তাদের লিবিয়া, মালি ও মধ্য আফ্রিকা প্রজাতন্ত্র সফরের সঙ্গী হয়েছিলেন পিকালোভ। এসব দেশে ওয়াগনারের জোরালো উপস্থিতি আছে।
গত ২১ আগস্ট টেলিগ্রামে পোস্ট করা এক বিজ্ঞাপনে কনভয় জানায়, আফ্রিকায় রাশিয়ান রিকনসেন্স ও অ্যাটাক ড্রোন পরিচালনার জন্য তারা স্বেচ্ছাসেবী নিয়োগ করছে।
রাশিয়ার নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর অভ্যন্তরীণ বিষয়ে খোঁজখবর রাখতে ম্যাসেজিং অ্যাপ টেলিগ্রামের একটি চ্যানেল– চেকা-ওজিপিইউ এর ওপর চোখ রাখেন পশ্চিমা কর্মকর্তারা। এই চ্যানেলে প্রদত্ত একটি তথ্যমতে, প্রভাবশালী রুশ আইনপ্রণেতা ও সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী দিমিত্রি রগোঝিন কনভয়ের হয়ে লবিং করছেন। তার উদ্দেশ্য, আফ্রিকায় ওয়াগনারের ভূমিকা যেন কনভয়কে দেওয়া হয়। আগস্টের শুরুতে পুতিনের একজন শীর্ষ উপদেষ্টা- অ্যান্টন ভাইনোর সাথে বৈঠকে কনভয়ের হয়ে তদ্বির করেন রগোঝিন।
অতীতে কনভয় গ্রুপের যোদ্ধাদের রিজার্ভ হিসেবে তলব করেছে রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়। গতবছর পুতিনের ঘনিষ্ঠ একজন সহযোগী ও অলিগার্ক- আর্কাডি রটেনবার্গ এবং রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক ভিটিবি'র থেকে শত শত মিলিয়ন রুবল পেয়েছে কনভয়।
এ তথ্য জানা গেছে, রাশিয়ার একটি অনুসন্ধানী সংস্থা - ডোসিয়ের সেন্টারের তথ্যসূত্রে। এর প্রতিষ্ঠাতা হচ্ছেন ক্রেমলিনের সমালোচক মিখাইল খোদর্কোভস্কি।
আফ্রিকায় ওয়াগনারের কার্যক্রম প্রথম শুরু হয় লিবিয়ায়। প্রিগোঝিনের মৃত্যুর একদিন আগে লিবিয়া সফর করেছেন, রাশিয়ার উপ-প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইউনূস-বেক ইয়েভকুরভ। তিনি স্থানীয় যুদ্ধপতি খলিফা হাফতারের সাথে বৈঠক করেন বলে জানান লিবিয় কর্মকর্তারা। ওই বৈঠকে একজন নিরাপত্তা ঠিকাদারও অংশ নেন।
ইয়েভকুরভ হাফতারকে বলেন, লিবিয়ায় থাকা ওয়াগনার ইউনিটগুলোর নিয়ন্ত্রণ নেবে আরেকটি বেসরকারি সামরিক কোম্পানি। তারাই সেনাদের বেতনভাতা দেবে, কিন্তু এ সংস্থাকে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করবেন রাশিয়ার সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা- জিআরইউ এর কর্মকর্তারা। জিআরইউ কর্মকর্তাদের এজন্য লিবিয়ায় পাঠানো হবে।
লিবিয় কর্মকর্তারা জানান, পিকালোভ এই সফরে অংশ নিয়েছিলেন। লিবিয়ায় ওয়াগনারের জায়গা নিতে তার প্রতিষ্ঠান কনভয়কেই পছন্দের শীর্ষে রেখেছে ক্রেমলিন।
এদিকে মধ্য আফ্রিকা প্রজাতন্ত্রে ওয়াগনারের জায়গায় আরেকটি ভাড়াটে যোদ্ধা গোষ্ঠীকে আনত চায় রাশিয়া। একথা জানান, আফ্রিকান দেশটির প্রেসিডেন্টের একজন নিরাপত্তা উপদেষ্টা ফিদেল গোয়াঞ্জিকা।
দেশটির রাজধানী বাঙ্গুই-তে রুশ সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তাদের উপস্থিতির কথা জানিয়েছেন, ইউরোপীয় নিরাপত্তা কর্মকর্তারা। তারা বলেছেন, ওয়াগনার ইউনিটগুলোর আরেকটি ভাড়াটে যোদ্ধা গোষ্ঠীতে যুক্ত হওয়ার কার্যক্রম তত্ত্বাবধান করতেই এ উপস্থিতি। তবে এটি রাশিয়ার কোন সংস্থা- সে সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারেনি ওয়ালস্ট্রিট জার্নাল।