দাম বাড়লেও বাড়েনি মজুরি, মূল্যস্ফীতিতে কিভাবে চলছে জীবন?
খাদ্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ভারী বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য। নিজেদের অর্জিত মজুরির একটি বড় অংশ তাদের ব্যয় করতে হচ্ছে খাদ্যদ্রব্য ও প্রয়োজনীয় সামগ্রী কিনতেই; অথচ মূল্যস্ফীতির তুলনায় তাদের আয় বৃদ্ধির হার সেভাবে বাড়েনি।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর(বিবিএস) সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, আগস্টে দেশে গড় খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিল ১২.৫৪%, যা গত ১২ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। অথচ ওই মাসে শ্রমিক মজুরি বৃদ্ধির গড় হার ৭.৫৮%।
অন্যদিকে, এশিয়ার অন্যান্য দেশগুলো, অর্থাৎ ভারত থেকে শুরু করে ইন্দোনেশিয়া বা চীনে গত বছর উল্লেখযোগ্য হারে মজুরি বৃদ্ধি হয়। করোনা-পরবর্তী অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের সময়ও বিভিন্ন কোম্পানি এবং কারখানা ক্রমবর্ধমান মুদ্রাস্ফীতি মোকাবেলায় সহায়তা করার জন্য কর্মীদের বেতন বাড়িয়েছে। এক বছর পর এসব দেশের শ্রমিকদের মজুরি বেশ ভালো অবস্থানে আছে; অন্তত মূল্যস্ফীতির হারের সাথে সামঞ্জস্যতা আছে তাদের মজুরির।
উইলিস টাওয়ারস ওয়াটসন সমীক্ষায় দেখা গেছে, গত বছর ৯.২% গড় মজুরি বৃদ্ধি নিয়ে ২৭টি এশিয়া-প্যাসিফিক মার্কেটের মধ্যে ভারত সর্বোচ্চ অবস্থানে আছে, যেখানে চীনে শ্রমিকদের আয় বেড়েছে ৬%।
উইলিস টাওয়ারস ওয়াটসন'র আরেকটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, ২০২২ সালের শেষে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গড় মজুরি বৃদ্ধির হার ছিল ৪.২%। সেসময় মার্কিন মুদ্রাস্ফীতি ৬% এর বেশি ছিল। মার্কিন মুদ্রাস্ফীতি এখন ৩% এ নেমে যাওয়ায়, আমেরিকান কর্মচারীদের মজুরি বৃদ্ধির হার পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির হারের চেয়ে বেশি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
কিন্তু বাংলাদেশের শ্রমিকরা অন্যান্য অর্থনীতির শ্রমিকদের মতো সৌভাগ্যবান নয়। তাদের মজুরি বৃদ্ধি খাদ্য মূল্যস্ফীতির তুলনায় ৫ শতাংশ পয়েন্ট কম। আগস্টে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১৩ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ অবস্থানে পৌঁছেছে।
কর্মীদের ওপর প্রয়োজনীয় চাহিদা মেটানোর বোঝা গত বছরের এপ্রিলের তুলনায় আজ আরও বেশি। গত বছরের এপ্রিলে কর্মীদের মজুরি বৃদ্ধির হার ছিল ৬.২৮%, যা সেসময়ের খাদ্য মূল্যস্ফীতির (৬.২৮%) চেয়ে কিছুটা বেশি ছিল। আগস্টে খাদ্য মূল্যস্ফীতি গত বছরের এপ্রিলের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে; কিন্তু মজুরি বেড়েছে মাত্র ১ শতাংশ পয়েন্টের একটু বেশি।
এরকম পরিস্থিতিতে দেশের শ্রমজীবীসহ নিম্ন আয়ের মানুষ প্রয়োজনের তুলনায় কম খাদ্য গ্রহণ করে এবং চাহিদা ছেঁটে জীবনযাপনের ব্যয় সংকুলান করছে। এতে ব্যাপক জনগোষ্ঠীর দীর্ঘমেয়াদি পুষ্টিহীনতা ও শিক্ষায় ঘাটতি দেখা দেওয়ার আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।
তারা বলছেন, খাদ্যমূল্য বেড়ে যাওয়ায় শ্রমজীবীসহ নিম্ন আয়ের মানুষ জীবনযাপনে অনেক কিছুই বাদ দিতে বাধ্য হচ্ছেন। অনেকে নিম্ন মানের খাবার খাচ্ছেন, অনেকে সন্তানের শিক্ষা বাবদ খরচ কমাচ্ছেন, অনেকে প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবা নিচ্ছেন না, বাসা পরিবর্তন করে কম ভাড়ার বাড়িতে উঠছেন অনেকে। এতে বাংলাদেশ টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য (এসডিজি) এর গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য 'পুষ্টিকর খাদ্য' নিশ্চিত করার সূচক অর্জনেও পিছিয়ে পড়ছে।
বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও গবেষণা সংস্থা পাওয়ার অ্যান্ড পারটিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) এক্সিকিউটিভ চেয়ারম্যান ড. হোসেন জিল্লুর রহমান টিবিএসকে বলেন, "মূল্যস্ফীতির সাথে তাল মিলিয়ে মজুরি বৃদ্ধি না হওয়ার নেতিবাচক প্রভাব গবেষণা ও নিত্যদিনের জীবন- দুই ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে।"
"এসডিজির অন্যতম লক্ষ্য দেশকে ধীরে ধীরে পুষ্টিমানের খাদ্যে এগিয়ে নেওয়া। কিন্তু সেটা সম্পূর্ণ বিপরীত দিকে হাঁটছে। কারণ নিম্ন আয়ের মানুষ খাদ্য তালিকা ছোট করছে। উচ্চ পুষ্টিমানের খাদ্য গ্রহণ কমিয়েছে," বলেন তিনি।
তিনি বলেন, "আরেকটা বড় সমস্যা হচ্ছে, মানুষ খাদ্য ছাড়া অন্যান্য খরচ সংকুচিত করছে বেশি। বিশেষ করে শিক্ষা খরচ। এতে দীর্ঘ মেয়াদে নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশংকা রয়েছে।"
তিনি বলেন, "এ প্রবণতা অনেকদিন ধরেই চলে আসছিল। কিন্তু সম্প্রতি তা অন্য পর্যায়ে পৌঁছেছে। এটা অত্যন্ত দুঃখজনক যে বাংলাদেশ কিছু সূচকে বেশ এগোলেও অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সূচক মানব সম্পদে পিছিয়ে যাচ্ছে।"
এই উচ্চমূল্যষ্ফীতি শুধু নিম্ন আয়ের মানুষের ওপরই নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে না। চাহিদা কমে যাওয়ায় সামগ্রিক অর্থনীতিতেও এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। কৃষি, শিল্প পণ্য ও বিভিন্ন সেবার চাহিদা কমে যাওয়ায় অর্থনৈতিক বৃদ্ধি কমে যাওয়ার পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
গত কয়েক মাস ধরে দেশের বাজারে দরিদ্রদের আমিষের চাহিদা পূরণকারী খাদ্যের বেশিভাগেরই দাম বেড়েছে। বিশেষ করে পাঙ্গাস ও তেলাপিয়া মাছ, পোল্ট্রি মুরগি ও ডিম, দুধ, ডাল এর সবগুলোরই দাম বেড়েছে। এসময় ভোজ্যতেল, চিনি, আলু, পেঁয়াজ, লবনের দামও বেশ বেড়েছে। ফলে একই পরিমাণ টাকায় আগের তুলনায় কম পণ্য পাওয়া যাচ্ছে।
২০২১ সালের ডিসেম্বরের পরিসংখ্যান অনুসারে, দক্ষিণ এশিয়ার সাতটি দেশ - পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, ভারত, মিয়ানমার, কম্বোডিয়া এবং ইন্দোনেশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশে শ্রমিকের মজুরি সবচেয়ে কম।
বাংলাদেশ নিম্নতম মজুরি বোর্ডকে ৬৩টি পেশার শ্রমিকদের জন্য প্রতি পাঁচ বছরে ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ করার নির্দেশনা দেওয়া আছে। এরমধ্যে ১৭টি খাত কৃষির, ৩০টি শিল্প এবং ১৬টি পরিষেবা খাত। এ বোর্ডের চেয়ারম্যান লিয়াকত আলী মোল্লা গত মাসে বলেছেন, পোশাক শ্রমিকদের নতুন মজুরি নভেম্বরে নির্ধারণ করা হবে। সর্বশেষ ন্যূনতম মজুরি ৮,০০০ টাকা কার্যকর করা হয় ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে।
দেশের শ্রমজীবীদের বড় অংশই অনানুষ্ঠানিক খাতের। কৃষি, মৎস, নির্মাণ, পরিবহন, রেস্তোরাঁ খাতে ব্যাপক সংখ্যক মানুষ কাজ করছেন। যাদের নির্দিষ্ট বেতন কাঠামো নেই।
এছাড়া আনুষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকদেরও সম্প্রতি মজুরি বৃদ্ধি ঘটেনি। সরকার যেসব খাতে ন্যুনতম মজুরি নির্ধারণ করে গত কয়েক মাসে তার কোনোটিইতে নতুন মজুরি কাঠামো ঘোষণা করা হয়নি। শুধুমাত্র চা শিল্পে বেতন বাড়ানো ছাড়া নতুন মজুরি কাঠামো ঘোষণা করা হয়েছে।
দেশের সবচেয়ে বেশি শ্রমিক কাজ করেন তৈরি পোশাক শিল্পে। এই শিল্পের নতুন মজুরি কাঠামো গঠনের কাজ চলছে। জানা গেছে, উচ্চ মূল্যস্ফীতির প্রেক্ষিতে পোশাক শিল্পের শ্রমিক সংগঠনগুলো ন্যুনতম মজুরি ২৩ হাজার টাকা করার প্রস্তাব করেছে, যা বর্তমানে ৮২০০ টাকা।
ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশের(টিসিবি) তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালের এপ্রিলের তুলনায় গত ১০ সেপ্টেম্বরে ফার্মের ডিমের দাম বেড়েছে ৫৬.৭%। ব্রয়লার মুরগীর দাম বেড়েছে ৪.৪%।
এছাড়া আলুর দাম ১৫০%, লবণের দাম ২০%, চিনির দাম ৭১%, রুই মাছের দাম ৩৩.৩%, পেঁয়াজের দাম ১৪২.৯% বেড়েছে। আর মোটা চালের দাম বেড়েছে ৫.৪%।
এই উচ্চ মূল্যস্ফীতির প্রেক্ষিতে সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বেতন মূল বেতনের ৫% বাড়িয়েছে সরকার। নিম্নস্তরের কর্মচারিদের বেতন বেড়েছে ন্যুনতম ১০০০ টাকা। যা গত জুলাই থেকে কার্যকর হয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. সায়মা হক বিদিশা টিবিএসকে বলেন, "আমাদের গবেষণায় দেখেছি নিম্ন আয়ের মানুষ খাবারে বেশি খরচ করে। মজুরির তুলনায় মূল্যস্ফীতি বেশি হলে এই শ্রেণির মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাপন প্রভাবিত হয়। গত কয়েকবছর ধরে মজুরির তুলনায় মূল্যস্ফীতি বেশি হচ্ছে। এতে মানুষ যেকোনো উপায়ে খাপ খাওয়াচ্ছে।"
তিনি বলেন, "দেখা যাচ্ছে অনেকে কিছু খাবারের কনজাম্পশন কমিয়ে দিচ্ছে। অনেকে সন্তানের টিউশনি বাদ দিয়ে দিচ্ছে। আবার অনেকে খরচ কমাতে সন্তানের স্কুল পরিবর্তন করছে।"
"অনেকে দুধ, ডিম, মাছ, মাংস খাওয়া কমিয়েছেন। কেউ কেউ এ ধরনের পুষ্টিগুণ সম্পন্ন খাবারের পরিবর্তে নিম্ন পুষ্টিগুণের খাবার গ্রহণ করছে। এভাবে শিক্ষা, স্বাস্থ্যে মানুষ খাপ খাওয়াচ্ছে। ফলস্বরুপ পুষ্টি, খাদ্যের গুণগত মান, উৎপাদনশীলতায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। যা সামগ্রিকভাবে হিউম্যান ক্যাপিটাল ডেভেলপমেন্টে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে," বলেন তিনি।
নিউট্রিশন অ্যান্ড ফুড সায়েন্স ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক খালেদা ইসলাম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "পরিবারের খাবার কেনার সক্ষমতা কমে গেলে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে পড়েন মা ও শিশু। দামের কারণে খাবার কম কিনলে কম খায় মা ও শিশু। এতে তারা অপুষ্টিতে পড়বে। এছাড়া বয়স্করাও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।"
তিনি বলেন, "চাহিদা অনুযায়ী খাবার না পেলে মানুষ অপুষ্টির শিকার হয়। অল্প কিছুদিনের জন্য অপুষ্টির শিকার হলে আর্থিক অবস্থার উন্নতি হলে তা রিকভার করা যায়। কিন্তু দীর্ঘদিন অপুষ্টিতে ভুগলে সেটি আর পূরণ করা যায়না। দীর্ঘদিনের অপুষ্টিতে শিশুদের স্টান্টিং (ঠিকভাবে বেড়ে না ওঠার হার) বেড়ে যায়, আইকিউ লেভেল কমে যায়। ৫ বছর পর্যন্ত শিশুর মস্তিষ্কে ডেভলভমেন্ট হয়। এই সময় অপুষ্টির কারণে যদি শিশুর আইকিউ লেভেল কমে যায়, তাহলে আর সারাজীবনেও সে শিশু স্বাভাবিক শিশুদের মতো প্রতিযোগীতায় টিকতে পারেনা, পড়াশুনা থেকে সবকিছুতে সে পিছিয়ে পড়ে। পুষ্টিহীনতার কারণে শিশুসহ সব ধরনের মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়।"
বলা হয় পুষ্টিতে ১ ডলার খরচ করলে ৬০ ডলার ফেরত পাওয়া যায়। আর বিনিয়োগ না করলেও ক্ষতিটাও ৬০ ডলার মতই হয়। শ্রমজীবী মানুষ যদি অপুষ্টিতে ভোগে তাহলে তার প্রভাব পড়ে তার কাজে, উৎপাদনশীলতায়।