সক্ষমতার মাত্র ২৫% উৎপাদন করছে দেশের সবচেয়ে বেশি স্যালাইন উৎপাদনকারী কোম্পানি
ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়ায় দেশে ইনজেকশনযোগ্য স্যালাইনের চাহিদা বহুগুণ বাড়ার সময়ে দেশের সবচেয়ে বেশি স্যালাইন উৎপাদনকারী কোম্পানি লিব্রা ইনফিউশনস লিমিটেড স্যালাইন উৎপাদন ৭৫% কমিয়ে দিয়েছে।
রাজধানীতে চাহিদার ৫০% স্যালাইন সরবরাহ করতে পারছে কোম্পানিগুলো। আর রাজধানীর বাইরে চাহিদার মাত্র ৩০% স্যালাইন সরবরাহ হচ্ছে। বাজারে স্যালাইনের সংকটের কারণে ৫০০ টাকা দিয়েও স্যালাইন কিনতে বাধ্য হচ্ছেন রোগীরা।
পরিস্থিতি মোকাবেলায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় স্যালাইন আমদানির উদ্যোগ নিয়েছে। স্যালাইন সংকট মেটাতে উৎপাদক কোম্পানিগুলোকে তিন শিফটে উৎপাদন চালানোর নির্দেশ দিয়েছে সরকার।
এমন পরিস্থিতিতে দৈনিক এক লাখ ব্যাগ স্যালাইন উৎপাদনের সক্ষমতা থাকা লিব্রা ইনফিউশনস উৎপাদন করছে মাত্র ২৫ হাজার ব্যাগ। 'অপারেটিং ক্যাপিটাল' না থাকার কারণে বাধ্য হয়ে উৎপাদন কমানোর দাবি করেছে কোম্পানিটি।
লিব্রা ইনফিউশনসের কোম্পানি সেক্রেটারি শফিকুল ইসলাম ভূঁইয়া বলেন, "আমাদের অপারেটিং ক্যাপিটালের ঘাটতি থাকায় সক্ষমতা অনুযায়ী উৎপাদন করতে পারছিনা। ব্যাংক থেকে ঋণ পাচ্ছি না, এ কারণে সক্ষমতার ২৫% স্যালাইন উৎপাদন করছি আমরা। ব্যাংক ঋণ পেলে সক্ষমতার পুরোটা কাজে লাগানো যাবে।"
ডেঙ্গুর প্রকোপের কারণে স্যালাইনের চাহিদা বাড়ার সময় সরবরাহ সংকট দেখা দেওয়ার ঘটনাকে 'জাতীয় সংকট' হিসেবে বিবেচনা করে স্যালাইন উৎপাদক কোম্পানিগুলোর সঙ্গে বৈঠক করেছে বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশন। লিব্রা ইনফিউশনের ৭৫% উৎপাদন কমানোর ঘটনার ব্যাখ্যা চায় কমিশন।
সেখানে লিব্রা ইনফিউশনস অপারেটিং ক্যাপিটাল সংকটের পাশাপাশি স্যালাইন বিক্রি করে না পোষানোর কথা জানায় বলে প্রতিযোগিতা কমিশনের সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা টিবিএসকে জানিয়েছেন।
প্রতিযোগিতা কমিশনের সদস্য মো. হাফিজুর রহমান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "তিন দশকের বেশি সময় ধরে কোম্পানিটি প্রফিট করছে। আর জাতীয় সংকটের মুহূর্তে উৎপাদন কমিয়ে দিয়েছে, যা মোটেই কাম্য নয়।"
পরিস্থিতি মোকাবেলায় প্রতিযোগিতা কমিশন প্রয়োজনে কঠোর হবে বলেও জানান তিনি।
কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, ভারতে প্রতি ব্যাগ স্যালাইনের দাম এখন ৪৩ রুপি। আর বাংলাদেশে প্রতি ব্যাগ স্যালাইনের মূল্য ৯০-১০০ টাকার মধ্যে। তারপরও স্যালাইন বিক্রি করে না পোষানোর ব্যাখ্যা গ্রহণযোগ্য নয়।
স্কয়ার গ্রুপের স্যালাইন উৎপাদন ইউনিটও বন্ধ রয়েছে। দেশের স্যালাইন সংকট দূর করতে ৩.৫০ লাখ ব্যাগ স্যালাইন আমদানি করা হচ্ছে বলে জানা গেছে।
এ খাতের ব্যবসায়ীরা বলছেন, স্বাভাবিক সময় প্রতি মাসে স্যালাইনের চাহিদা ছিল ৪০-৫০ লাখ ব্যাগ। এখন তা বেড়ে ২.৪০-৩ কোটি ব্যাগ হয়েছে। বর্তমানে ছয়টি কোম্পানি উৎপাদনে আছে। এর মধ্যে বেক্সিমকো গ্রুপ সর্বোচ্চ দিনে ৩০,০০০ ব্যাগ স্যালাইন উৎপাদন করছে। কোম্পানিগুলো তিন শিফটে পূর্ণ উৎপাদন সক্ষমতা কাজে লাগালে মাসে ৬৫ লাখ পর্যন্ত যোগান দিতে পারবে।
ওরিয়ন ইনফিউশনের সহকারী ভাইস প্রেসিডেন্ট খায়রুল বাশার জানান, এ প্রতিষ্ঠান ছুটির দিনসহ তিন শিফটেই স্যালাইন উৎপাদন করছে। দৈনিক উৎপাদিত ২৫,০০০ ব্যাগের মধ্যে সরকারি হাসপাতালে ১০,০০০ ব্যাগ সরবরাহ করা হচ্ছে। বাকিটা বাজারে সরবরাহ করা হচ্ছে।
কোম্পানিগুলো বলছে, স্যালাইনের দাম সরকার নির্ধারণ করে দেয়। ফলে মূল্যস্ফীতি বা ডলার সংকটের কারণে কোম্পানিগুলো বিভিন্ন ওষুধের দাম যেভাবে বাড়াতে পারছে, স্যালাইনের ক্ষেত্রে তা পারছে না। ফলে এ খাতে বিনিয়োগ ও উৎপাদন বাড়ানোর দিকে কোম্পানিগুলোর আগ্রহ নেই। ২০১৫ সালের পর ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিগুলো স্যালাইন উৎপাদনের জন্য কোন বিনিয়োগ করেনি।
এ বছর ডেঙ্গু আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা অতীতের যেকোন সময়ের রেকর্ড ছাড়িয়েছে। ডেঙ্গু রোগী বেড়ে যাওয়ায় ইনজেকশনযোগ্য স্যালাইনের চাহিদা স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় কয়েকগুণ বেড়েছে। বর্তমানে সরকারি হাসপাতালগুলোতে স্যালাইনের সংকট কিছুটা কাটলেও প্রাইভেট হাসপাতাল ও ফার্মেসিতে স্যালাইনের সংকট অনেক বেশি।
স্যালাইন সংকটের কারণে ডেঙ্গু রোগীর পাশাপাশি সার্জারি, ডায়ালাইসিস সহ অন্যান্য রোগীরাও সমস্যায় পড়ছে। বাধ্য হয়ে রোগীর স্বজনেরা তিন থেকে চারগুণ দামে স্যালাইন কিনছে। দেশে আইভি স্যালাইনের দাম সর্বোচ্চ ৯০-১০০ টাকা হলেও তা কোথাও কোথাও ৫০০ টাকা দরেও কিনতে বাধ্য হচ্ছেন রোগীরা।
গত ১০ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশন স্যালাইন উৎপাদন, চাহিদা, স্যালাইনের সাপ্লাই চেইন বিষয়ে সংশ্লিষ্ট স্টেকহোল্ডারদের সাথে মতবিনিময় সভা করে। সেখানে ডেঙ্গু পরিস্থিতির কারণে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে কেউ যাতে স্যালাইন সংকট পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটাতে না পারে সে বিষয়ে সবাইকে সতর্ক করে কমিশন।
ওই সভায় ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর জানায়, স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডের স্যালাইন প্ল্যান্ট বন্ধ আছে। অন্যান্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো দৈনিক তিন শিফটে স্যালাইন উৎপাদন করছে। ফলে দেশে সর্বোচ্চ দৈনিক ১,৯০,০০০ হাজার ব্যাগ স্যালাইন উৎপাদন হচ্ছে।
হেলথ অ্যান্ড হোপ হাসপাতালের চেয়ারম্যান ডা. এম এইচ লেলিন চৌধুরী দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "এখন চাহিদার তুলনায় স্যালাইনের সংকট অনেক বেশি। আমরা কোম্পানিকে ১০০ ব্যাগ স্যালাইনের চাহিদা দিলে ১০ বা ২০ ব্যাগ স্যালাইন পাই। আগে আমরা একজন লোক পাঠিয়ে মিটফোর্ড মার্কেট থেকে প্রয়োজন অনুযায়ী স্যালাইন নিতে পারতাম। এখন স্যালাইনের খোঁজে তিন-চারজনকে মিটফোর্ড মার্কেটের বিভিন্ন দোকানে পাঠাতে হচ্ছে। স্যালাইনের সর্বোচ্চ দাম ৯০-৯৫ টাকা ছিল, এখন সে স্যালাইন আমরা ২০০ টাকা প্যাকেট কিনছি।"
রাজধানীর ফার্মেসিগুলোতে স্যালাইন কিনতে এসে ফিরে যেতে হচ্ছে রোগীর স্বজনদের। ইস্কাটনের মেডিকেয়ার ফার্মেসির দোকানদার আবদুল ফয়সাল দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "স্যালাইনের সংকট এখন অনেক বেশি। প্রতি সপ্তাহে দুইদিন ২০ ব্যাগ করে স্যালাইন পাই আমরা, কিন্তু এর তুলনায় চাহিদা অনেক বেশি। প্রতিদিনই কয়েকজন করে কাস্টমার স্যালাইন না পেয়ে ফিরে যায়।"
এদিকে মঙ্গলবার রাজধানীতে একটি অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, "হাসপাতালে স্যালাইনের সংকট নেই। বাজারে স্যালাইনের কিছুটা ঘাটতি রয়েছে। এজন্য সাত লাখ ব্যাগ স্যালাইন আমদানি করা হচ্ছে। শিগগিরই ৩ লাখ ৫০ হাজার ব্যাগ স্যালাইন দেশে এসে যাবে।"