কেন স্যালাইনের এতো সংকট!
গত দুই মাস ধরে যশোর ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালে মেডিসিন, গাইনি, কলেরা, সার্জারি সহ কোনও ওয়ার্ডের রোগীদের ইনজেকশনযোগ্য স্যালাইন সরবরাহ করা হচ্ছে না। শুধু ডেঙ্গু ওয়ার্ডে স্বাভাবিক স্যালাইন এবং কলেরা ওয়ার্ডে খাবার স্যালাইন সরবরাহ করা হচ্ছে। এর ফলে কয়েকগুণ বেশি দামে বাইরে থেকে স্যালাইন কিনতে হচ্ছে রোগীদের।
শুধু জেনারেল হাসপাতাল নয়, জেলার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোতে ইনজেকশনযোগ্য স্যালাইন সরবরাহের সংকট দেখা দিয়েছে। শহরের দুই-একটি ফার্মেসিতে মিললেও ৯৫ টাকার এসব স্যালাইন ২৫০-৩০০ টাকা দাম নেওয়া হয়। এতে চরম ভোগান্তিতে পড়ছেন রোগী ও তাদের স্বজনেরা।
যশোরের মতো সিলেট, কুমিল্লা, সাভার, খুলনা, বগুড়াসহ দেশের বিভিন্ন জেলার হাসপাতালে ইনজেকশনযোগ্য স্যালাইনের সংকট দেখা দিয়েছে। সরকারি হাসপাতালে সংকট কিছুটা কম হলেও প্রাইভেট হাসপাতাল ও ফার্মেসিতে স্যালাইনের তীব্র সংকট। বাধ্য হয়ে কয়েকগুণ বেশি দামে স্যালাইন কিনতে হচ্ছে রোগীদের।
ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়ায় সারাদেশে ইনজেকশনযোগ্য স্যালাইনের সংকট দেখা দিয়েছে। এতে শুধু ডেঙ্গু রোগী না, সংকটে পড়েছে অন্যান্য রোগীরাও।
যশোর সদরের ফতেপুর উপজেলার ভায়না গ্রামের নজরুল ইসলাম (৬০) গত ২ দিন ধরে যশোর ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালের সার্জারি ওয়ার্ডে ভর্তি রয়েছেন। মঙ্গলবার তার অপারেশন করা হয়।
নজরুল ইসলামের স্ত্রী লাকি খাতুন বলেন, হাসপাতালে ভর্তির পর থেকে প্রতিদিন দুই ধরনের মিলিয়ে আটটি স্যালাইন দিতে হয় তার স্বামীর শরীরে। হাসপাতাল থেকে একটাও স্যালাইন দেওয়া হয়নি। হাসপাতালের সামনের ফার্মেসিগুলো থেকে দ্বিগুণ-তিনগুণ দামে স্যালাইন কিনতে হচ্ছে। তাও পাওয়া যাচ্ছে না।
অন্যদিকে সিলেটে ডেঙ্গুর প্রকোপ কম হলেও সেখানে স্যালাইনের সংকট রয়েছে।
সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্র্রিগেডিয়ার ডা. মাহবুবুর রহমান ভূঁইয়া দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "সিলেটে ডেঙ্গুর প্রকোপ কিছুটা থাকায় আমাদের এখানে স্যালাইনের চাহিদা খুব একটা বাড়েনি। কিন্তু সারাদেশে সংকট দেখা দেওয়ায় সিলেটেও এর প্রভাব পড়েছে। আমরা চাহিদামাফিক স্যালাইন পাচ্ছি না।"
আগের তুলনায় স্যালাইনের সরবরাহ অর্ধেকে নেমে এসেছে জানিয়ে তিনি বলেন, "আমাদের কোনরকমে চালাতে হচ্ছে। শনিবার কিছু স্যালাইন পাওয়ার কথা। তাতে সংকট কিছুটা কমবে।"
সিলেটের রিকাবীবাজার এলাকার সীতা ফার্মেসির স্বত্বাধিকারী লিটন চন্দ বলেন, একমাস ধরেই সিলেটে স্যালাইনের সংকট।
তার নিজের ফার্মেসিতে এখন কোন স্যালাইন নেই জানিয়ে তিনি বলেন, "লিব্রা, অফসোনিন, ওরিয়নসহ কিছু কোম্পানী স্যালাইন সরবরাহ করে থাকে। কিন্তু মাসখানেক ধরে তারা চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ দিতে পারছে না।"
কুমিল্লায় স্যালাইনের সংকট না থাকলেও বেশি দামে বিক্রির অভিযোগ উঠেছে। স্যালাইন বিক্রি হচ্ছে নির্দিষ্ট দাম থেকে দুই-তিনগুণ বেশি দরে। ৮৭ টাকার স্যালাইনের দাম নেয়া হচ্ছে ৪০০ টাকা পর্যন্ত।
নাজমা আক্তার নামে কুমিল্লা নগরীর এক বাসিন্দা জানান, "আমার ৮ বছর বয়সী মেয়ের জ্বর ও শরীর দুর্বল হয়ে আসায় স্যালাইনের দরকার হয়। আশেপাশের সব ফার্মেসিতে যাই। সব ফার্মেসিতেই স্যালাইন বেশি দামে বিক্রি করছে। পরে বাধ্যগত তিনগুণ দামে স্যালাইন কিনি।"
সাভারের উপজেলার সরকারি হাসপাতালে স্যালাইনের সংকট না থাকলেও, বেসরকারী পর্যায়ের হাসপাতাল, ক্লিনিক ও চিকিৎসা সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর সাথে কথা বলে জানা গেছে, বড় প্রতিষ্ঠানগুলো বিভিন্ন উপায়ে স্যালাইন সংগ্রহ করে রোগীদের চিকিৎসা চালিয়ে গেলেও তুলনামূলক ছোট প্রতিষ্ঠানগুলো রোগীদের সেবা দিতে রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছে।
সাভারের বিভিন্ন এলাকার পল্লী চিকিৎসকরা বলছেন, স্যালাইন সংকটের কারণে জরুরি ক্ষেত্রে শ্বাসকষ্টের রোগীদের নেবুলাইজার সাপোর্ট দিতেও হিমশিম খাচ্ছেন তারা।
আশুলিয়া ফার্মেসী ডেভেলপমেন্ট এসোসিয়েশনের সভাপতি জহিরুল ইসলাম লিটন বলেন, "আমাদের সংগঠনের ৩ হাজার সদস্য রয়েছেন যারা সবাই ফার্মেসী ব্যবসার সাথে জড়িত। কিন্তু শেষ দেড়-দুই মাস যাবত কেউই স্যালাইন পাচ্ছে না। ডিএনএস তো বাজারে নেই, নরমাল স্যালাইনও নেই।"
"আমি নিজে গত মাসে আক্রান্ত হয়ে ৬ দিন একটি হাসপাতালে ভর্তি ছিলাম। হাসপাতালে স্যালাইন না থাকায় বাধ্য হয়ে অনেক কষ্টে বাহির থেকে একটি ডিএনএস স্যালাইন নিজের জন্য আমাকে ব্যবস্থা করতে হয়েছিলো", যোগ করেন তিনি।
খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ফার্মেসি বিভাগ জানায়, গত শনিবার তাদের স্বাভাবিক স্যালাইনের মজুদ শেষ হয়ে যায়। সেদিন তারা এসেনশিয়াল ড্রাগস কোম্পানির কাছে জরুরি ভিত্তিতে স্বাভাবিক স্যালাইন সরবরাহের অনুরোধ জানান। এরও আগে, গত ১৫ জুন রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানটি হাসপাতালটিকে ৫০০ মিলি ডিএনএসের ১,৫০০ ইউনিট সরবরাহ করেছিল।
খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের উপ-পরিচালক ডা. নিয়াজ মুস্তাফি চৌধুরী বলেন, বর্তমানে কোনো হাসপাতালেই স্বাভাবিক স্যালাইন নেই।
তিনি বলেন, "আমরা সরকারি ওষুধ কোম্পানির কাছে লিখিতভাবে ও ফোনের মাধ্যমে বারবার যোগাযোগ করেছি। স্যালাইন পেলেই রোগীদের কাছে পৌঁছে দেওয়া হবে।"
বগুড়া শহরের প্রায় সব ফার্মেসিতে স্যালাইনের সংকট রয়েছে। হাসপাতাল এলাকাগুলোয় অনেক অসাধু ওষুধ বিক্রেতা সুযোগ বুঝে আরও বেশি টাকায় স্যালাইন বিক্রি করছে।
স্যালাইন সংকট মোকাবেলায় ৭ লাখ ব্যাগ স্যালাইন আমদানির প্রক্রিয়া চলছে বলে জানিয়েছেন ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের পরিচালক আশরাফ হোসেন। তিনি বলেন, "৬টি স্যালাইন কোম্পানি ছুটির দিনসহ তিন শিফটে স্যালাইন উৎপাদন করছে। কোম্পানিগুলো যেভাবে উৎপাদন করছে তাতে বাজার ম্যানিপুলেট না করলে স্যালাইনের সংকট হওয়ার কথা না। আমাদের হেড অফিসের আটটি টিম বাজার মনিটর করছে। কোন ভোক্তা যদি অতিরিক্ত দামে স্যালাইন কেনার ক্যাশ মেমো আমাদের দেয় তাহলে আমরা সেই ফার্মেসির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিবো।"
[প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন টিবিএসের যশোর প্রতিনিধি মনোয়ার আহমেদ, সিলেটের দেবাশীষ দেবু, সাভারের নোমান মাহমুদ, খুলনার আওয়াল শেখ এবং বগুড়ার খোরশেদ আলম]