মুখোশপরা বন্দুকধারীর অতর্কিত হামলা, ধাওয়া: যেভাবে খুন হন হরদীপ সিং
হরদীপ সিং নিজ্জারের সেদিন একটু তাড়া ছিল, গুরুদুয়ারা থেকে আগেভাগে বের হতে চেয়েছিলেন তিনি। সেদিন ছিল বাবা দিবস এবং তার স্ত্রী ও দুই পুত্র তার জন্য অপেক্ষা করছিলেন।
কানাডার ব্রিটিশ কলাম্বিয়ার সারি শহরে গুরু নানক শিখ গুরুদুয়ারায় যাওয়ার পথে নিজ্জার তার ২১ বছর বয়সী ছেলেকে ফোন করলেন। ছেলে বলরাজ সিং নিজ্জার তার বাবাকে বললেন, বাড়িতে তার জন্য পিজ্জা এবং তার প্রিয় ডেজার্ট সেভাইয়া বানানো হয়েছে।
"রাতের খাবার প্রস্তুত রাখো, আমি বাড়িতে আসছি", ছেলেকে বলেছিলেন নিজ্জার।
কিন্তু তিনি জানতেন না, গুরুদুয়ারার বাইরে তার জন্য মৃত্যুদূতের মতো অপেক্ষা করে আছে মুখোশধারী তিন ব্যক্তি এবং তাদের কাছে ছিল অস্ত্র।
এর ১০ মিনিট পর নিজ্জারের বাড়িতে আবারও ফোন বেজে ওঠে। ফোনে তাদের এক পারিবারিক বন্ধু বলেন, "তোমরা কি শুনেছো? গুরুদুয়ারায় কিছু একটা হয়েছে। তোমার বাবাকে গুলি করা হয়েছে।"
গত ১৮ জুন এই গুরুদুয়ারার সভাপতি হরদীপ সিং নিজ্জারকে গুলি করে হত্যা করা হয়। কিন্তু এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত কাউকে গ্রেপ্তার করা হয়নি।
কিন্তু শুরু থেকেই নিজ্জারের পরিবার, বন্ধুবান্ধব এবং স্থানীয় শিখ সম্প্রদায়ের সবাই নিশ্চিত ছিলেন যে এ ঘটনার পেছনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সরকারেরই হাত রয়েছে।
হরদীপ সিং নিজ্জার ছিলেন 'খালিস্তান' আন্দোলনের একজন স্পষ্টবাদী নেতা। এ আন্দোলনের উদ্দেশ্য হলো ভারতের পাঞ্জাব রাজ্যে একটি আলাদা শিখরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা। কিন্তু ভারতে এ আন্দোলনটি নিষিদ্ধ।
হরদীপ সিং নিজ্জার হত্যার ঘটনার ঠিক তিন মাস পরে, গত সোমবার (১৮ সেপ্টেম্বর) কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো হাউজ অব কমনস বা দেশটির সংসদের নিম্নকক্ষে বলেছেন যে, হরদীপ সিং হত্যার পেছনে ভারত সরকারের এজেন্টদের সংশ্লিষ্টতা থাকার বিষয়ে 'বিশ্বাসযোগ্য অভিযোগের' তদন্ত করছেন গোয়েন্দারা।
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এই অভিযোগ অস্বীকার করে জানিয়েছে, এটা সত্যিকার সমস্যা থেকে মনোযোগ সরিয়ে দেওয়ার একটা প্রচেষ্টা এবং সমস্যাটা হলো ভারতীয় ভিন্নমতাবলম্বীদের- যাদেরকে নয়াদিল্লি সন্ত্রাসী হিসেবে আখ্যা দিয়েছে, কানাডা তাদেরকে আশ্রয় দিচ্ছে। এ ঘটনার জেরে উভয় দেশই একজন করে কূটনীতিককে বহিষ্কার করেছে।
হরদীপ সিং নিজ্জার একজন কানাডীয় নাগরিক, যার জন্ম ভারতে এবং তিনি ভ্যাঙ্কুয়েভারের শহরতলী এলাকা সারি'তে প্লাম্বিং এর ব্যবসা করতেন। কিন্তু খালিস্তান আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়ায়ই মূলত তিনি ভারতীয় সিকিউটি সার্ভিসের নজরে পড়েন।
২০২২ সালের জুলাইয়ে ভারতের জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থা তাকে পাঞ্জাবে একজন হিন্দু পুরোহিতকে হত্যার ষড়যন্ত্র করার অভিযোগে অভিযুক্ত করে এবং তাকে 'পলাতক সন্ত্রাসী'র তকমা দেয়। ভারতের সন্ত্রাসবিরোধী সংস্থা এনআইএ হরদীপের কানাডার বাড়ির ঠিকানা প্রকাশ করে এবং তার কর্মকাণ্ড সম্পর্কে তথ্য দেওয়ার জন্য ১ মিলিয়ন রূপি (১২,০০০ ডলার) পুরস্কার ঘোষণা করে।
হরদীপের পরিবার এবং বন্ধুবান্ধরা জানান, তিনি শিখ আবাসভূমির দাবিতে শান্তিপূর্ণ ও গণতান্ত্রিক উপায়ে সমর্থন দিয়েছেন। মৃত্যুর আগে তিনি খালিস্তানের প্রতি সমর্থন আদায়ের উদ্দেশ্যে প্রবাসী শিখদের মধ্যে একটি গণভোটের আয়োজন করছিলেন। শিখ সম্পরদায়ের অন্যরা জানান, চলতি মাসে এক লাখেরও বেশি মানুষ গুরুদুয়ারায় হাজির হয়েছিলেন ভোট দিতে।
ওয়ার্ল্ড শিখ অর্গানাইজেশন অব কানাডার আইনি পরামর্শদাতা বলপ্রীত সিং বোপারাই জানান, এক বছরেরও বেশি সময় ধরে নিজ্জারের প্রতি এসব হুমকি সম্পর্কে অবগত ছিল কানাডার নিরাপত্তা সংস্থাগুলো। বোপারাই আরও জানান, তিনি ২০২২ সালের গ্রীষ্মকালের সময় থেকেই নিজ্জারের নিরাপত্তা নিয়ে তার আশঙ্কার কথা কানাডার আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে জানিয়েছিলেন; এমনকি নিজ্জার হত্যার কয়েক সপ্তাহ আগেও জানানো হয়েছিল।
"স্পষ্টত, তারা যথেষ্ট ব্যবস্থা নেয়নি", বলেন বোপারাই। তার সংস্থা নিজ্জারের এই হত্যাকাণ্ডকে কানাডীয় কর্তৃপক্ষের ব্যর্থতা বলে অভিহিত করেছে।
দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট রয়্যাল কানাডিয়ান মাউন্টেড পুলিশ-এর কাছে জানতে চেয়েছিল যে, তারা শিখ নেতা নিজ্জারকে তার জীবনের ঝুঁকির ব্যাপারে সতর্ক করেছিল কিনা কিংবা মৃত্যুর আগে তাকে সুরক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা নিয়েছিল কিনা। কিন্তু কানাডিয়ান মাউন্টেড পুলিশ এর উত্তর দিতে অস্বীকৃতি জানায়। কানাডিয়ান সিকিউরিটি ইন্টেলিজেন্স সার্ভিস-এর মুখপাত্র এরিক বালসাম বলেন, জনসমক্ষে এ বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে পারবেন না তিনি।
প্রয়াত নিজ্জারের আইনজীবী গুরুপতবন্ত সিং পান্নুম জানান, মৃত্যুর আগেরদিন নিজ্জার তাকে কল দিয়ে বলেছিলেন, কানাডিয়ান কর্তৃপক্ষ তাকে সতর্ক করেছে যে তার জীবনের ঝুঁকি রয়েছে। তবে পান্নুম বলেন, কর্তৃপক্ষ সুনির্দিষ্ট করে নিজ্জারকে কিছু জানায়নি।
নিজ্জার হত্যাকাণ্ডের দিন বোপারাই অন্টারিওর ব্রাম্পটনে তার নিজের গুরুদুয়ারার সদস্যদের সঙ্গে সাম্প্রতিক সময়ে শিখ নেতাদের হত্যার ঘটনাগুলোর বিষয়ে কথা বলছিলেন। তিনি জানান, ওই সময় সদস্যদের মধ্যে কেউ একজন বলে উঠেছিলেন যে 'মনে হচ্ছে পরবর্তী নিশানা হবেন হরদীপ সিং নিজ্জার।'
গত ১৮ জুন রবিবার গুরুদুয়ারায় প্রার্থনা করে সময় কাটানোর জন্য আগেভাগে উঠে পড়েছিলেন নিজ্জার। তিনি বেরিয়ে যাওয়ার আগেই তার ২০ ও ২১ বছর বয়সী দুই ছেলে তাকে বাবা দিবসের উপহার দেওয়ার জন্য উঠে পড়েছিলেন। বাবাকে একটা নতুন জিনস উপহার দিয়েছিলেন তারা। ছেলে বলরাজের ভাষ্যে, উপহার পেয়ে নিজ্জার মজা করে বলেছিলেন- "তোমরা তো জানোই আমি ডায়েটে আছি। তাই এগুলো হয়তো আমার আর ফিট হবে না।" তখন বলরাজ বলেছিলেন, 'তুমি ওজন কমালেই আমি আরেকটা নতুন জিনস এনে দেবো।" এর জবাবে নিজ্জার তার বড় ছেলেকে বলেছিলেন, "তুমি নিশ্চিত যে তোমার কাছে সেই টাকা আছে?"
গুরুদুয়ারায় গিয়ে তিনি শিখ সম্প্রদায়ের উদ্দেশ্যে সাপ্তাহিক বক্তব্য রাখেন, যেখানে প্রায়ই তিনি বিশ্বজুড়ে এই সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে হুমকির কথা তুলে ধরতেন। তিনি শিখদের সহিংসতার সঙ্গে নয়, বরং ভোটের মাধ্যমে তাদের বার্তা ছড়িয়ে দেওয়ার আহ্বান জানান।
পাঞ্জাবি ভাষায় তিনি বলেছিলেন, "আমাদের তো একে-৪৭ হাতে তুলে নেওয়ার দরকার নেই। আমাদের শুধু 'হ্যা বা না' ভোট দিয়ে ব্যালট বাক্স ভরতে হবে।
গুরুদুয়ারায় তার বক্তব্যের ভিডিও রেকর্ড করা হয়েছিল। সেখানে নিজ্জারকে বলতে শোনা যায়, "আমরা মনে করি আমরা কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রে স্বাধীনভাবে বসবাস করছি; কিন্তু আসলেই কি তাই? আমরা কি তাদের কথা ভাবছি যারা ইতোমধ্যেই খুন হয়েছেন, আমাদের শহীদদের কথা? আমাদের সবাইকে এক হতে হবে এবং স্বাধীনতা অর্জন করতে হবে।"
রাত সাড়ে আটটার একটু আগে তিনি তার বন্ধু গুরমিত সিং টুরের সঙ্গে গুরুদুয়ারা থেকে বেরিয়ে যান। ৫২ বছর বয়সী ট্রাকচালক গুরমিতের সঙ্গে তিনি গুরুদুয়ারায় আসন্ন প্রোগ্রামগুলো নিয়ে কথা বলছিলেন। এরপর তারা একে অপরকে বিদায় জানিয়ে যার যার গাড়ির দিকে চলে যান।
এর দুই মিনিট পরেই গুরমিত গুলির আওয়াজ পান বলে জানান। তিনি নিজের গাড়ি থেকে বেরিয়ে দৌড়ে ৩০০ গজ দূরে নিজ্জারের পিকআপের দিকে যান। গিয়ে দেখেন ড্রাইভারের সাইড উইন্ডো চুরমার হয়ে গেছে, দরজায় একাধিক বুলেটের ফুটো এবং নিজ্জার ডানদিকে ঢলে পড়েছেন, তার বাম বাহু, বুক এবং মাথা থেকে রক্ত পড়ছে।
গুরুদুয়ারার অন্যরা ঘটনাস্থলে জড়ো হয়ে চিৎকার ও কান্নাকাটি করছিলেন এবং এসময় মুখোশধারী দুই ব্যক্তি পালিয়ে যান। গুরমিত এবং অন্যরা তাদেরকে তাড়া করেছিলেন কিন্তু ধরতে ব্যর্থ হন। মুখোশধারী ওই দুই ব্যক্তি বাইরে অপেক্ষমান একটি গাড়িতে উঠে পালিয়ে যান; পরবর্তীতে পুলিশ জানায় গাড়িটি ছিল একটি ২০০৮ টয়োটা ক্যাম্রি।
পরবর্তীতে পুলিশ ওই দুজনকে লম্বাচওড়া ও শক্তসমর্থ ব্যক্তি এবং মুখোশধারী বলে বর্ণনা দেয়। এই দুজন এবং তৃতীয় আরেক সন্দেহভাজন- যিনি ছিলেন তাদেরকে পালাতে সাহায্য করা গাড়িটির চালক; তারা তিনজন নিজ্জারকে হত্যার অন্তত এক ঘণ্টা আগে থেকেই ওই এলাকায় অপেক্ষা করছিলেন বলে জানায় পুলিশ। কিন্তু এ ঘটনায় কাউকে গ্রেপ্তার করা হয়নি।
খবর শুনে বলরাজ তার মা ও ভাইকে নিয়ে গুরুদুয়ারায় পৌঁছান এবং বাবাকে ডাকতে থাকেন; কিন্তু কোনো সাড়া আসেনি।
তারা ঘটনাস্থলে পৌঁছে দেখেন সেখানে শত শত লোক জড়ো হয়েছে এবং পুলিশ টেপ দিয়ে ওই স্থান ঘেরাও করে রেখেছে। এরপর বলরাজ তার বাবার পিকআপটা দেখেন।
পারিবারিক বন্ধুবান্ধবরা বলরাজকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করেন, কিন্তু বলরাজের মনোযোগ ছিল তখন মা ও ছোট ভাইয়ের দিকে।
নিজ্জারের মৃত্যুর খবর দ্রুত স্থানীয় শিখ সম্প্রদায়ের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। গুরুদুয়ারার একজন সদস্য ও আইনজীবী জে সিং বাবা দিবস উপলক্ষে পরিবার নিয়ে বাইরে ডিনার করতে গিয়েছিলেন। কিন্তু খবর শোনার সঙ্গেসঙ্গে তিনি রেস্টুরেন্ট ত্যাগ করেন এবং গুরুদুয়ারায় চলে আসেন। সেখানে পৌঁছেই শোনেন শোকার্তদের কান্না এবং 'খালিস্তান জিন্দাবাদ!' বলে স্লোগানের আওয়াজ।
"আমরা তখনই বুঝতে পেরেছিলাম যে এই পেছনে ভার সরকারের হাত আছে", বলেন জে সিং।
হরদীপ সিং নিজ্জারের ছেলে জানান, নিজ্জারের কার্যক্রম শুধু শিখ বিচ্ছিন্নতাবাদের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। তিনি শিখ সম্প্রদায়ের মানুষকে অন্যান্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সঙ্গে হয়ে যাওয়া অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে উতসাহিত করতেন। তিনি আদিবাসীদের সঙ্গে দেখা করেছিলেন এবং মুসলিমদের সমাবেশেও যোগ দিয়েছিলেন, বলেন বলরাজ।
আফগান শিখরা যখন কানাডায় আসে, তখন নিজ্জার তাদেরকে কম্বল ও খাবার দিয়ে সাহায্য করেছেন। কানাডায় যখন দাবানল হয়, তিনি ফার্স্ট-এইড কিট দিয়েছেন। আশেপাশের কোনো অঞ্চলে বন্যা হলে, সেখানে জরুরি সহায়তার জন্য তিনি হেলিকপ্টারের ব্যবস্থা করতে সাহায্য করেছেন।
হরদীপ সিং নিজ্জারের মৃত্যুর কয়েক মাস পেরিয়ে গেলেও, তার ছেলে জনসমক্ষে বাবার মৃত্যু নিয়ে কথা বলতে দ্বিধাবোধ করেন। মনে মনে তিনি নিশ্চিত যে এই হত্যকাণ্ডের পেছনে ভারত সরকারেরই হাত রয়েছে, কিন্তু তিনি জনসমক্ষে কখনো এই অভিযোগ করেননি। তিনি আশা করেন, কানাডীয় কর্তৃপক্ষ এই অভিযোগগুলো সামনে নিয়ে আসার জন্য যথেষ্ট প্রমাণ বের করতে পারবে।
"সত্য আপনাআপনিই সামনে চলে আসবে", বলেন তিনি।
সোমবার রাতে ট্রুডোর ঘোষণার পরে বলরাজ তার বাবার গুরুদুয়ারার বাইরে রিপোর্টারদের সামনে দাঁড়িয়ে প্রথমবার জনসমক্ষে বাবার মৃত্যুর প্রসঙ্গে কথা বলেন।