একসময়ের অন্ধকার ইতিহাসের সাক্ষী ‘নীল চাষ’ এখন যেভাবে আশীর্বাদ
নীল চাষ নিয়ে বাঙালিদের উপর নির্যাতনের কাহিনী বইপুস্তকে পড়েছেন রংপুরের মনোহর রায়। কিন্তু তিনিই এখন নীল চাষ করেন। 'অভিশাপে'র নীল চাষ যে 'আশীর্বাদ' হবে কখনো ভাবেননি মনোহর। জানালেন, অদ্ভুত এক ফষল নীল চাষ। উৎপাদনে খরচ নেই বললেই চলে। অথচ প্রতিবিঘায় অন্তত ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা আয় হয়।
যে ফসল চাষের ঘটনায় বাঙালি জাতির উপর নির্যাতনের কাহিনী অবলম্বনে 'নীল দর্পণ' নাটক রচিত হয়েছে; সেই নীল চাষই আলোকবর্তিকার মতো কৃষকের সামনে হাজির হয়েছে।
নীল চাষের সঙ্গে জড়িতরা বলছেন, উত্তরাঞ্চলের রংপুর-নীলফামারী জেলাতে অন্তত ৩০০ হেক্টর জমিতে এখন এই ফসলের চাষাবাদ হচ্ছে।
তবে রংপুর বিভাগীয় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক মো. আফতাব হোসেন বলেন, নীল শুধুমাত্র রংপুর সদরের একটি অংশে সামান্য পরিমাণ চাষ হয়। এই অঞ্চলে ১০ হেক্টর বা এর কাছাকাছি জমিতে নীল চাষ হয়। তবে কৃষকের সংখ্যা আমাদের কাছে নেই। ফসল হিসেবেও আমাদের অন্তর্ভুক্ত নয়। এর অর্থনৈতিক দিক কেমন সেটাও জানি না। খোঁজ নিতে হবে।
কিন্তু কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর খামারবাড়ীর এক সাবেক পরিচালক ড. মো. জাহাঙ্গীর আলমের ২০২০ সালের দিকে উত্তরবঙ্গের নীল চাষ নিয়ে প্রকাশিত গবেষণাধর্মী এক প্রতিবেদন বলছে ভিন্ন কথা। সরকারি কৃষি তথ্য সার্ভিসের (এআইএস) ওয়েবসাইটে প্রকাশিত কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক ড. জাহাঙ্গীর আলম উল্লেখ করেন, ২০০৭ সালে রংপুর সদরের হরকলি ঠাকুরপাড়ার ডা. নিখিল চন্দ্র রায়ের হাত ধরে আধা-বাণিজ্যিকভাবে নীল উৎপাদন শুরু হয়। রংপুর সদর, তারাগঞ্জ, গঙ্গাচড়া ও নীলফামারীর কিশোরগঞ্জ উপজেলায় ১০০ হেক্টর জমিতে প্রায় ১৩ হাজার কৃষক নীল চাষ করছেন বিভিন্ন আঙ্গিকে। ৩-৪ বছর আগেও প্রায় ২০০ হেক্টর জমিতে আবাদ হতো। মাঝে নীল উৎপাদনকারী কারখানা বন্ধ থাকায় এর আবাদ কমে যায়। বন্ধ কারখানা চালু হওয়ায় এখন নীল চাষে নতুন উদ্যম সৃষ্টি ও গতি সঞ্চার হয়েছে।
এই গবেষক আরও বলেন, ভারতে প্রতি বছর দরকার হয় ৩০০ টন নীলের। সবচেয়ে ভালো নীল আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতি কেজি প্রায় ২৫ হাজার টাকায় বিক্রি হয়। দুনিয়াজুড়ে নীলের বেশির ভাগ চাহিদা মিটিয়ে আসছে এল সালভাদর। কিন্তু উত্তরবঙ্গের চাষীরা স্বপ্ন দেখছেন তাদের উৎপাদন দেশ ছাড়িয়ে বিদেশে যাবে। দেশের আয় হবে।
তিনি আরও বলেন, কয়েক বছর আগে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা এমসিসির উদ্যোগে রঙ তৈরির জন্য নীল চাষ শুরু হয়। বদলে যেতে থাকে পরিস্থিতি। রংপুরে বর্তমানে প্রতি বছর অন্তত ২ হাজার কেজির বেশি নীল উৎপাদিত হচ্ছে। যা দেশে চাহিদার বড় অংশ পূরণের পর বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে। একসময়ের মঙ্গাপীড়িত উত্তরবঙ্গে আশীর্বাদ হয়ে আবির্ভূত হয়েছে নীল চাষ।
জীবিকা গতি পেয়েছে নীল চাষকে কেন্দ্র করে
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, উত্তরে হাজারের বেশি কৃষক তাদের জীবিকার গতি পেয়েছে এই এলাকায় নীল চাষকে কেন্দ্র করে।
তাদের মধ্যে একজন রংপুরের হরকালি ঠাকুরপাড়ার বাসিন্দা মনোহর। এই চাষী জানান, বাপ-দাদার আমল থেকে পতিত জমিতে তারা নীল (আঞ্চলিক ভাষায় মাল গাছ) চাষ করতেন। অবশ্য ফসল হিসেবে নয়, সবুজ সার কিংবা খড়ির প্রয়োজনে। কিন্তু গত তিন বছর আগে জানতে পারেন এটি অর্থকরী ফসল। চাষাবাদে কীটনাশক লাগে না। রোপণ করলে স্বয়ংক্রিয়ভাবেই হয়ে যায়। নিড়ানি দেওয়ার প্রয়োজন নেই। পাতা কাটতেও খরচ নেই। প্রতি বিঘায় দেড় থেকে ২ টাকা বিনিয়োগ করলে ১ থেকে ১৮ হাজার টাকা আয় হয়। এর বাইরে এক একর জমির শুকনো নীলগাছ জ্বালানি হিসেবে বিক্রি হয় ৯ থেকে ১০ হাজার টাকায়।
গঙ্গাচড়া থানার খিলনগঞ্জে ১০০ শতক জমিতে নীল চাষ করেছেন শরৎ চন্দ্র রায়। খড়ির গাছের পাতা বিক্রি করে টাকা আয়ের কথা স্বপ্নেও ভাবেননি শরৎ। জানালেন, অনেক সময় তুলনা করলে জমি হিসেবে অন্যান্য ফসলের দ্বিগুণ আয় নীল চাষে। বলতে গেলে ঘরে বসে বাড়তি পয়সা পাওয়া।
খড়ির 'মাল গাছ' থেকে টাকা আয়ের এই পথ দেখিয়েছেন এলাকার সংগঠক নিখিল রায়। রংপুরের গঙ্গাচড়ায় হরকলি ঠাকুরপাড়ায় তিনি প্রতিষ্ঠা করেছেন নীল তৈরির কারখানা। শতাধিক নারী-পুরষ কাজ করে সেখানে। তার লক্ষ্য এই এলাকায় হাজার হেক্টর জমিতে নীল চাষ করানো। তার ভাষ্য, নীল পতিত জমির স্বর্ণ।
রংপুর-দিনাজপুর মহাসড়কের পাশে নিখিল গড়ে তুলেছেন 'হস্ত কুটিরশিল্প প্রশিক্ষণ ও কল্যাণকেন্দ্র' নামক একটি সংগঠন। এই প্রতিষ্ঠান থেকে দেশের বাইরের একটি এনজির সহযোগিতায় একটি 'গবেষণাধর্মী' কাজ করেন নিখিল। ২০০৭ সালে শুরু হওয়া গবেষণার ফল মেলে ২০১০ এ।
তাদের গবেষণায় নীল গাছের পাতা থেকে প্রথম নীল উৎপাদন হয়। এরপর তারা এটি বাজারমুুখী করার চেষ্টায় নামেন। ২০১৬ সালে নীল থেকে তারা 'বাই প্রোডাক্ট' তৈরি করেন। এখন দেশে নীলের রমরমা বাণিজ্য। প্রান্তিক চাষীদের কাছ থেকে পাতা কিনে নীল উৎপাদন করেন নিখিল। একই সাথে বিনামূল্যে বীজ বিতরণ করে নীল চাষে চাষীদের উদ্বুদ্ধও করেন এই উদ্যোক্তা।
নিখিল রায় নিজেও নীল চাষী। তিনি এবার ১২০ বিঘা জমি ইজারা নিয়ে নীল চাষাবাদ করেছেন। লাভজনক হওয়ার কারণে রংপুর ও এর আশেপাশের কৃষকরা ক্রমাগত আগ্রহী হচ্ছেন।
নিখিল জানান, নীল চাষ এতো লাভজনক যা অন্য ফসলে সম্ভব নয়। অথচ বিষয়টি নিয়ে কৃষি দপ্তরের কোনো বিকার নেই। তবে কয়েকটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা নীল চাষ ও নীল উৎপাদনে সহায়তা করে।
এলাকার অন্তত ১৫ জন কৃষকের সাথে কথা বলে জানা গেছে, প্রতি বিঘায় নীল চাষে সর্বোচ্চ ২ হাজার টাকা খরচ হয়। কিন্তু এক বিঘা জমিতে অন্তত ৪,৫০০ কেজি পাতা উৎপাদন হয়। প্রতি কেজি পাতার সর্বনিম্ন দাম ৫ টাকা। এই হিসাবে এক বিঘা থেকে ২২ হাজার ৫০০ টাকার পাতা বিক্রি হয়। অর্থাৎ এক বিঘা জমিতে নীল চাষ করলে ২০ হাজার টাকার উপরে লাভ করা সম্ভব।
দেশে নীলের চাহিদা কতো তার সঠিক হিসাব কৃষি দপ্তরে নেই। তবে একাধিক বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার সূত্র মতে, দেশে ৮ থেকে ১০ টন নীল প্রয়োজন।
নীলের রপ্তানি সম্ভাবনা
সম্ভাবনাময় নীল বিদেশে রপ্তানির দুয়ার অবারিত হচ্ছে।
রপ্তানির সম্ভাবনায় নীল উৎপাদনে এই অঞ্চলে কাজ করছে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ফ্রেন্ডশিপ বাংলাদেশহ আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠান। তারা নীল উৎপাদন করে এবং বিভিন্ন তৈরি পোশাক কারখানা এবং ব্র্যাকের মতো প্রতিষ্ঠানের কাছে বিক্রি করে।
ফ্রেন্ডশিপ বাংলাদেশের জেনারেল ম্যানেজার শাহ মো. আব্দুল জব্বার জানান, "নেদারল্যান্ডসভিত্তিক প্রতিষ্ঠান জি-স্টার, ফ্রান্স, লুক্সেমবার্গসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আমাদের উৎপাদিত নীল পাঠিয়েছি। তারা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছেন। আমরা আশা করছি ভবিষ্যতে তাদের সাথে বড় ধরনের বাণিজ্য হবে আমাদের। তখন আমরা আরও বড় পরিসরে উৎপাদনে যেতে পারব।"
তবে এর মধ্যে রংপুরের রাজেন্দ্রপুরে লিভিং ব্লু প্রাইভেট লিমিটেড ও কেয়ার বাংলাদেশ যৌথভাবে বিদেশে নীল রপ্তানি শুরু করেছে। রাজেন্দ্রপুরে লিভিং ব্লু এককভাবে এক থেকে দেড় টন নীল উৎপাদন করে। ২০০৬ সালে এখানে নীল উৎপাদন শুরু হয় বলে জানিয়েছেন প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান হাকিম সুমন্ত কুমার। কেয়ার বাংলাদেশের মাধ্যমেই তারা দেশ ও দেশের বাইরে নীল বিক্রি করেন বলে জানান সুমন্ত।
দেশে উৎপাদিত নীল সম্পর্কে বিদেশিদের ফিডব্যাকও ভালো উল্লেখ করে কেয়ার বাংলাদেশের উপদেষ্টা আনোয়ারুল হক বলেন, "আমাদের প্রক্রিয়াজাত নীলের বিদেশে ১০, ২০, ৫০ বা ১০০ কেজি পরিমাণের চাহিদা বেশি।"
স্থানীয় কৃষি কর্মকর্তারা নীলকে কৃষিপণ্য না বললেও ঢাকা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের (খামারবাড়ি) অনুমোদন নিয়ে নীল বিদেশে রপ্তানি হচ্ছে।
ঢাকা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কোয়ারেন্টাইন প্যাথলজিস্ট এক্সপোর্ট কর্মকর্তা সুস্মিতা রায় বলেন, "নীল আমাদের মাধ্যম হয়ে দেশের বাইরে রপ্তানি হয়। চলতি বছরে এখনো রপ্তানি শুরু হয়নি। তবে এবারও প্রক্রিয়া চলছে।"