‘চামার’ থেকে ক্রিকেট নায়ক!
উনিশ শতকের ইংল্যান্ড দুনিয়াকে রেলপথ দিয়েছে। দিয়েছে বিদ্যুৎ এবং বিবর্তনের তত্ত্ব। ফুটবলে লাথি মারার সময় বা হকিস্টিক নিয়ে মাঠে দৌড়ানোর সময় কজনের মনে থাকে- এই দুই খেলা এবং রাগবিও এসেছে উনিশ শতকের ইংল্যান্ড থেকে। আজকের দিনের প্রধান প্রায় সব খেলাই এই দ্বীপদেশ থেকে এসেছে। 'এ কর্নার অব ফরেন ফিল্ড'-এর ভূমিকায় এসবই ব্যক্ত করেন রামচন্দ্র গুহ।
ব্যাডমিন্টন, টেবিল টেনিস এবং টেনিসের মতো জনপ্রিয় যেসব খেলায় র্যাকেট লাগে, সেখানে উৎপত্তির সাথে জড়িয়ে আছে ইংল্যান্ডের নাম। মানুষ আগুন আবিষ্কারের পর থেকে দৌড় দিচ্ছে বা ঘুষোঘুষি করছে। কিন্তু এসবই ক্রীড়া হিসেবে প্রথাবদ্ধ হয়েছে সেকালের দ্বীপদেশটিতেই।
আপনি যদি বাস্কেট বল খেলেন বা গলফ নিয়ে মেতে থাকেন, তাহলে সুখবর। ইংল্যান্ডের নাম না নিলেও চলবে। ১৮৯০-এর দশকের নিউ ইংল্যান্ডে বাস্কেট বলের প্যাটেন্ট করা হয়। আর গলফের সাথে জড়িত রয়েছে স্কটল্যান্ডের নাম।
আধুনিক যুগের সূচনা পর্বে ক্রীড়া সৃষ্টির সূতিকাগার হয়ে উঠেছিল ইংল্যান্ড। ইতিহাসের সে সময়ে যেসব ক্রীড়ার উদ্ভব ঘটে, তার মধ্যে পুরোপুরি স্বতন্ত্র অবস্থানে রয়েছে ক্রিকেট। ইংরেজরা ক্রিকেটকে তাদের জাতীয় ক্রীড়া হিসেবে দেখে। দক্ষিণ ইংল্যান্ডের গ্রামীণ জনপদের জনপ্রিয় খেলা হিসেবে ক্রিকেটের যাত্রা শুরু। ১৯ শতকের মধ্যে বড় বড় শিল্পনগরীগুলোতে এ খেলা ছড়িয়ে পড়ে। ক্রিকেটের নিয়ম ও চেতনার মধ্যে ভিক্টোরীয় যুগের অভিজাত শ্রেণির আচরণের প্রতিফলন রয়েছে।
ক্রিকেট খেলতে কৌশল এবং দৈহিক সক্ষমতা থাকতেই হবে। ফুটবল বা রাগবির বেলায় ধাক্কাধাক্কি, ল্যাং মারা, পায়ে পায়ে টক্কর বা গুঁতো খাওয়ার সুযোগ রয়েছে। ক্রিকেটে তেমন কিছুই নেই। দ্বীপদেশটির ঔপনিবেশিক সূত্রে ক্রিকেট ভারতবর্ষে ডেরা গাড়ে। ক্রমে জনপ্রিয়তার তুঙ্গে উঠে আসে।
ইংরেজ চলে গেছে। জন্ম হয়েছে ভারত এবং পাকিস্তান। পাকিস্তান থেকে স্বাধীন হয়েছে বাংলাদেশ। কিন্তু ক্রিকেট ছিল। আছে। থাকবে। হিমালয়ান উপমহাদেশে ক্রিকেট ঘরে ঘরে কীভাবে ছড়িয়ে পড়ল, তার কাহিনি নিজ বইতে তুলে ধরেন রামচন্দ্র গুহ। তার বইয়ের সূত্রেই ইতিহাসের বিস্মৃত অধ্যায় থেকে উঠে আসেন ঔপনিবেশিক ভারতের দুর্দান্ত ক্রিকেট খেলোয়াড় এবং দলিত রাজনীতিবিদ পালওয়ানকার বালু। বাঁহাতি ধীরগতির বোলার বালু নিজে ছিলেন দলিত শ্রেণির মানুষ। এ সত্ত্বেও বোম্বাইয়ের (আধুনিক মুম্বাই। গুহ তার বইতে বোম্বাই নামটি ব্যবহার করেন) ইউরোপীয়দের বিরুদ্ধে হিন্দু দলের ক্রিকেট বিজয়ের নেতৃত্ব দেন তিনি। সর্বভারতীয় ক্রিকেট দল প্রথম ইংল্যান্ড সফর করে ১৯১১ খ্রিষ্টাব্দে। সফরকারী দলের পক্ষে বালু নিজেই এক'শর বেশি উইকেট হাতিয়েছেন। ১৮৯৫ থেকে ১৯৩৭ পর্যন্ত ক্রিকেট ও রাজনীতির অঙ্গনে দাপিয়ে বেড়িয়েছেন তিনি। বোম্বাইকে বালু বসবাসের নগরী হিসেবে বেছে নেন ১৮৯৬-৯৭-এর শীতকালে। তারই ঠিক এক শতাব্দী পরে নভেম্বরে বালু সম্পর্কে জানতে সে মহানগরীতে পা রাখেন রামচন্দ্র গুহ।
টেলিফোন ডিরেক্টরি ঘেঁটে সাত পালওয়ানকারের তালিকা বানান তিনি। নিজেকে ঐতিহাসিক হিসেবে পরিচয় দিয়ে একে একে কথা বলা শুরু করেন। চার বা পাঁচ নম্বর ব্যক্তি প্রশ্নের জবাবে জানান, এককালের খ্যাতিমান ক্রিকেট তারকা পালওয়ানকারের সাথে তাদের পারিবারিক সম্পর্ক রয়েছে। গুহকে চায়ের আমন্ত্রণও জানান তিনি। বোম্বাই থেকে দূরে থানা নামের একটি জায়গায় থাকেন। ট্রেনে চেপে সেখানে যেতে যেতে ভাবেন, ভারতে প্রথম ট্রেনের যাত্রা শুরু হয় ১৮৫৩ খ্রিষ্টাব্দে। বোম্বাই এবং থানার মধ্যে যাত্রার মধ্য দিয়ে এই লৌহশকটের যাত্রাপথ রচিত হয়। ভারতে এখন ৬০ হাজার মাইলের মতো রেলপথ রয়েছে। গুহ মনে করেন, ক্রিকেট বা কংগ্রেস নয়-ভারতকে একত্র করে রেখেছে এই লৌহপথ।
ভূমিসন্তানদের মঙ্গল নয়, বরং ঔপনিবেশিক শক্তিকে মজবুত করার লক্ষ্য নিয়েই ভারতে রেলপথ বসানো হয়। ১৮৫৩ খ্রিষ্টাব্দের ৮ আগস্ট নিউ ইয়র্ক ডেইলি ট্রিবিউনে প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ সত্য তুলে ধরেন কার্ল মার্ক্স। রেলপথ বসানোয় সাদা চামড়ার প্রভুদের একদিকে সামরিক খরচ কমেছে। গোটা অঞ্চলের স্বনির্ভর গ্রামব্যবস্থাকে ধসিয়ে দেওয়া গেছে। ভারতীয় সমাজব্যবস্থায় বিরাজমান বর্ণব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন আনা হয়েছে।
ক্রিকেটের মাধ্যমে সনাতন এই বর্ণব্যবস্থার বিরুদ্ধে একধরনের চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছিলেন খোদ পি বালু। তার অধস্তন পুরুষের সাথে সাক্ষাৎ করতে ট্রেনযোগেই যাচ্ছেন কলকাতা থেকে মার্ক্সবাদের ওপর ডক্টরেট অর্জনকারী গুহ। ইতিহাসের রসিকতা! হয়তো।
থানায় পৌঁছে মাত্র পাঁচ মিনিট আলাপের পরই গুহ বুঝলেন, ক্রিকেট খেলোয়াড় পালওয়ানকারের সাথে খুব ঘনিষ্ঠ আত্মীয়তা নেই ভদ্রলোকের। তা ছাড়া বালু সম্পর্কে জানাশোনাও তেমন নেই। তবে ভদ্রলোক আশ্বাস দিলেন, বোম্বাইতে থাকেন আরেক পালওয়ানকার। অতীতের সেই ক্রিকেটার সম্পর্কে তার ভালো জ্ঞান আছে। বোম্বাইয়ে কোথায় থাকেন, সে তথ্য পরদিন দিতে পারবেন বলেও জানান। পরদিন সত্যিই নাম ও ফোন নম্বর দিলেন। কে ভি পালওয়ানকার নামের সে ব্যক্তি বোম্বাইর ওরলি থেকে ট্যাক্সিতে পনেরো মিনিটের রাস্তা দাদারে থাকেন।
বালুর ছোট ভাই পালওয়ানকার ভিটালের ছেলে কে ভি পালওয়ানকার। বেড়ে উঠেছেন চাচা বালুর বাসাতেই। গোটা সকাল তিনি বালুকে নিয়ে কথা বললেন। বিদায়ের সময় নিজ পিতার মারাঠি ভাষায় লেখা আত্মজীবনী তুলে দিলেন গুহকে। ১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত বইটির নাম 'মাজে ক্রিদা-জীব' (আমার ক্রীড়া-জীবন)। মনে করা হয়, বইটির মাত্র এক হাজার কপি ছাপানো হয়েছিল। এই পুস্তকের কথা এর আগে কেউই বলেনি। পুনেতে বালুর জীবনীকার লেখক বাল জে পণ্ডিতের সাথেও আলাপ হয় গুহের। এ বইটির কথা কখনোই শোনেননি বলে জানান তিনি।
বালু যেসময় ক্রিকেট খেলেছেন, সেসময় ভারতের নিজস্ব নিশান ছিল না; ছিল না মুদ্রা। এমনকি নিজস্ব কোনো টেস্ট টিমও ছিল না। ১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দ ওই আত্মজীবনী প্রকাশের জন্য ভালো সময়ও ছিল না। ইংরেজ শাসনের অবসান হয়েছে মাত্র এক বছর আগে। পাকিস্তান এবং ভারত নামে দুই রাষ্ট্র তৈরি হয়েছে। নানা হাঙ্গামা। বিচিত্র কাণ্ডকারখানা। এদিকে নতুন নতুন ক্রিকেট তারকারা তখন আসছেন ভারতে। তাদের নামের তোড়ে ধামাচাপাই পড়ে গেলেন পি বালু।
পালওয়ানকার নাম দিয়েই তার সূত্রের পরিচয় ফুটে উঠেছে। উত্তর গোয়ার কোনকান উপকূলের গ্রাম পালওয়ান থেকে এ নামের উৎপত্তি। বর্ণে-স্বাদে-গন্ধে অতুলনীয় আলফোনসো প্রজাতির আমের জন্য গ্রামটির খ্যাতি রয়েছে। ব্রিটিশদের দখলে যাওয়ার আগে 'উপনাম' রাখার ধারা এ ভূমিতে প্রচলিত ছিল না। মারাঠা গ্রামাঞ্চলের সব জাতের মানুষকে 'উপনাম' রাখার নির্দেশ দিল ব্রিটিশ রাজ। তারা নিজ গ্রামকে নামের সাথে জুড়ে দিল। 'পালওয়ানকার' মানে পালওয়ান গ্রামের অধিবাসী। এই উপনামের আড়ালের ব্যক্তিটি জাতে ব্রাহ্মণও হতে পারে। কিন্তু ক্রিকেট খেলোয়াড় পালওয়ানকার বালু জাতে চামার। সংস্কৃত 'চর্ম' থেকে আগত এই শব্দের দ্বারা চামড়ার কাজ করে এমন জাতকেই বোঝানো হয়। হিন্দু জাত প্রথায় এদের অবস্থান সর্বনিম্নে। চামার জীবনের বাস্তবতা হলো কঠোর দারিদ্র্য ও নিরক্ষরতা। এ জাতের মানুষকে অস্পৃশ্য হিসাব করা হয়। তাদের স্পর্শে আসলেই বর্ণ হিন্দুকে স্নান সেরে পবিত্র হতে হয়। এ জাতের সাথে মরা পশুর চামড়া খালানোর কাজ জড়িয়ে থাকে।
ব্রিটিশ শাসনের সুবাদে হাতের কাজ দক্ষ চামাররা নিজ গ্রাম থেকে সরে পড়ার সুযোগ পান। বারুদাগার বা অস্ত্র কারখানার কাজের ধারেকাছেও যেত না বর্ণ হিন্দুরা। ওখানে গরুর চর্বি ব্যবহার হয় এমন এক রটনার কারণে ওসব কাজে ভিড়তেন না তারা। কিন্তু এ বাবদ চামারদের কোনো বাছবিচার ছিল না। ১৮১৮ খ্রিষ্টাব্দে পেশোয়াদের পরাজিত করার পর পশ্চিমাঞ্চলীয় এবং দক্ষিণাঞ্চলীয় ভারতে ক্যান্টনমেন্ট এবং কারখানা গড়ে তুলতে শুরু করে ইংরেজ। সেখানে কাজের আশায় জড়ো হতো চামারদের দল।
পালওয়ানকার বালুর জন্ম দাক্ষিণাত্যের ধারওয়াদ শহরে। নিজ গ্রাম থেকে কমপক্ষে ৫০০ মাইল দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত। বালুর জন্মের পরপরই তার বাবা সেখানকার পাট চুকিয়ে দেন। পুনেতে চাকরি নিয়ে চলে আসেন বলে ধারণা করা হয়। সেনাবাহিনীর আওতায় চাকরি করতেন তিনি। কেউ কেউ ধারণা করেন, কিরকির উপকণ্ঠে গোলা-বারুদের কারখানায় চাকরির করতেন। অন্য দলের ধারণা, ১১২তম পদাতিক রেজিমেন্টে সিপাহি ছিলেন তিনি।
সাহেবদের বাতিল করা সাজসরঞ্জাম দিয়ে পুনেতেই বালু ও তার ছোট ভাই শিবরাম ক্রিকেট খেলা রপ্ত করে। দুই ভাই অল্প সময়ের জন্য স্কুলে যাতায়াত করেছে। উপার্জনে সাহায্য করার আরা তাদের স্কুল থেকে নাম কাটিয়ে নিয়ে আসা হয়। পারসিকদের পরিচালিত একটি ক্রিকেট ক্লাবে প্রথম চাকরি নেন বালু। ক্রিকেট পিচকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হতো। মাঝে মাঝে নেটে ক্লাব সদস্যদের অনুশীলনের জন্য বল করতে হতো। এ কাজের বিনিময়ে মাসে তখন পেতেন ৩ টাকা।
ভাগ্যবদলের ঢেউ লাগল ১৮৯২ খ্রিষ্টাব্দের দিকে। পুনের পারসিক ক্রিকেট খেলোয়াড়দের বদলে এবারে ইউরোপীয় ক্রিকেট খেলোয়াড়দের সাথে কাজ শুরু হলো বালুর। এডওয়াডস গার্ডেন নামের একটি জায়গায় পুনে ক্লাবে যোগ দেন বালু। বোম্বাই সরকারের সাথে ইজারার চুক্তি ছাড়া ক্লাবটির ঐতিহাসিক কোনো নথিপত্র আর নেই। ৯৯ বছরের জন্য বছরে ১৩ টাকা ১২ আনায় ক্লাবটিকে ইজারা দেওয়া হয় প্রায় ১৪ একর ভূমি। জনগণের নানা রকম বিনোদনের জন্য এ ইজারা বরাদ্দ করা হয়। 'জনগণ' বলতে এখানে অবশ্যই সাদা চামড়ার মানুষদেরই বোঝানো হয়েছে। ক্লাবের প্যাভিলিয়নটি বানানো হয় ১৮৮০-এর দশকে। এ প্যাভিলিয়ন এলাকায় হয়তো বিনা অনুমতিতে ঢুকতে পারতেন না পি বালু।
পুনে ক্লাবে বালুর বেতন বেড়ে মাসে ৪ টাকা দাঁড়ায়। সাথে সাথে কাজের মাত্রাও বাড়ে। পিচ তৈরি করা, ঠিকঠাক রাখা, টেনিস কোর্টগুলোর দাগ দেওয়া ও রক্ষণাবেক্ষণ করাসহ নানা দায়িত্ব বর্তায় তার ঘাড়ে। নিয়মিত এসব কাজ ছাড়াও পরে তাকে সদস্যদের জন্য বল করার দায়িত্বও দেওয়া হয়। বালুর জন্য এ ছিল আনন্দের কাজ। মি. ট্রস নামে এক সাহেব তাকে বল করতে বালুকে উৎসাহ জোগায়। খেলা শেষে বালুকে খালি নেটে দু-একবার বল করতে নিশ্চয়ই দেখেছেন তিনি। সাথে সাথেই বালুর বল করার জন্মগত প্রতিভার বিষয়টি বুঝতে পারেন। বালু সে সময় জনৈক ক্যাপ্টেন বার্টনের বল করাকে অনুসরণ করতেন। বাঁ হাতে মোলায়েম ধারায় বল করার জন্য পরিচিত ছিলেন বার্টন। বালুকে এর পর থেকে প্রায় নিয়মিতই ক্লাব সদস্যদের জন্য বল করতে হতো। অভিজ্ঞ টিমের সাথে ক্লাবের পক্ষ থেকে খেলতে নামার জন্য তাদের নিয়মিত এ রকম অনুশীলন চলত।
তৎকালে পুনের সবচেয়ে খ্যাতিমান ইংরেজ ক্রিকেট ক্যাপ্টেন ছিলেন, পরবর্তীতে বোম্বাই গভর্নরের সামরিক সচিব মেজর জে জি গ্রেইগ। 'জন গ্লিন' নামটি দ্রুত বলতে গেলে 'জুনগ্লে'তে রূপ নিত। এমন 'ডাকনামেই' পরিচিত হয়ে ওঠেন তিনি। খর্বাকৃতি 'জুনগ্লে'র রানের ক্ষুধা ছিল অসাধারণ। একালের ডন ব্রাডম্যান বা সুনীল গাভাস্কারের সাথে তুলনা চলে। এক শ করার পরও থামতেন না 'জুনগ্লে'। তখনো অক্লান্ত রান তুলতেন তিনি।
পুনে ক্লাবে অন্যান্য সতীর্থ খেলোয়াড়ের আসার অন্তত এক ঘণ্টা আগে আসতেন তিনি। সে সময় মাঠে অনুশীলন করতেন। এ জন্য বালুকে বল করতে নির্দেশ দিতেন। এতে একদিকে নিজের খেলার হাত পাকা হতো, অন্যদিকে বালুর বল করার হাত শানানোর পালাও চলত। মুখে মুখে প্রচলিত গল্প আছে, প্রতিবার বল করে তাকে আউট করতে পারলে বালুকে আট আনা বকশিশ দিতেন ক্যাপ্টেন গ্রেইগ বা 'জুনগ্লে'। সপ্তাহে একবার করেও যদি বল করে আউট করতে পারতেন, তবে বালুর মাসিক আয় দ্বিগুণ বেড়ে যেত।
বালু একবার আক্ষেপ করে তার ছেলেকে বলেছিলেন যে পুনে ক্লাবে শত শতবার বল করেছেন। কিন্তু একবারের জন্যেও তাকে ব্যাট করার সামান্য সুযোগটুকু দেওয়া হয়নি। ইংল্যান্ডের মতো ঔপনিবেশিক ভারতেও ব্যাট করার সুযোগ কেবল অভিজাত-বর্গীয়দের জন্য সংরক্ষিত ছিল। বালুর সান্ত্বনা একটাই, অন্যান্য কাজের সাথে বল করার সুযোগ যোগ হওয়ায় তার মাসিক আয় তিন গুণে গিয়ে ঠেকত। 'জুনগ্লে'র জন্য হাজার হাজার বল করার মধ্য দিয়ে বল করায় হাত পাকিয়ে ফেলেন বালু। দক্ষতার শিখরে ওঠেন এভাবেই। তার পূর্বপুরুষেরা চর্মকার হিসেবে দক্ষতা দেখিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেছেন। বালু এবারে বল করায় দক্ষতা দেখাতে শুরু করলেন।
সাহেবদের দৃষ্টিতে 'নেটিভ' হিসেবে পরিচিত স্থানীয় অধিবাসীদের মধ্যে বালুর বল করার দক্ষতার কথা ছড়িয়ে পড়ল। ক্রিকেট খেলায় ইউরোপীয়দের এক হাত দেখিয়ে দিতে চাইল পুনের হিন্দু ক্লাব।
'চামার' বালুকে দলে নেওয়া হবে কি না, তা নিয়ে লাগামছাড়া তর্কাতর্কি হলো পুনে ক্লাবে। বালুকে দলে নিতে ক্লাবের তেলেগু সদস্যদের আপত্তি ছিল না। কিন্তু মারাঠি ব্রাহ্মণ সদস্যরা আপত্তির ঝড় তুললেন। এ পর্যায়ে নাক গলালেন জে জি গ্রেইগ। তিনি এক সাক্ষাৎকারে বললেন, বালুকে দলে না নেওয়াটা হিন্দুদের জন্য বোকামি ছাড়া আর কিছুই হবে না। সমাজ সংস্কারক সাজার জন্য এ কথা বলেননি তিনি। ব্রাহ্মণ সন্তানদের হিন্দু জাতপ্রথার প্রতি যে রকম টান থাকে, গ্রেইগের নিজ শ্বেতাঙ্গ জাতের তার তুলনায় কম টান থাকার কারণেও এমন কথা বলেননি গ্রেইগ। বরং ক্রিকেট লড়াইয়ে নিজ নেট বোলার বালুর বিরুদ্ধে আপন ক্রিকেট দক্ষতা প্রমাণ করার আগ্রহ থেকেই এমন অভিপ্রায় ব্যক্ত করেন তিনি।
পুনে হিন্দু দল শেষ পর্যন্ত বালুকে নিজেদের দলে নিতে সম্মত হলো। সেখানেও জাত-পাতের প্রথা থেকে রেহাই পেল না বালু। খেলার মাঠে অস্পৃশ্য বালুর ছোঁয়া বল ধরতে আপত্তি করেনি বড় জাতের সন্তানেরা। মাঠের বাইরের ছবিটি ছিল ভিন্ন। চা-বিরতির সময় বালুকে প্যাভিলিয়নের বাইরে মাটির ভাঁড়ে চা দেওয়া হয়। অন্যদিকে তার সতীর্থ খেলোয়াড়েরা সাদা পোর্সিলিনের ঝকঝকে কাপে চা পান করেন। বিরতির সময় হাত-মুখ ধোয়ার দরকার হলে ক্লাবের আরেক অস্পৃশ্য চাকর কেতলি করে পানি নিয়ে যেত। মাঠের বাইরে সে পানি ঢালা হতো এবং এভাবেই হাত-মুখ ধুয়ে খুশি থাকতে হতো বালুকে। দুপুরের খাবার পর্বও একইভাবে পৃথক জায়গায় বসে নম নম করে সারতে হয়েছে তাকে।
বালু অনেক উইকেট নিল। বলা যায়, বালুর বলের তোড়ে প্রতিপক্ষের খেলা বাংলা প্রবাদের বালুর বাঁধে পরিণত হলো। ভেস্তে গেল তাদের প্রতিরোধ প্রচেষ্টা। পুনে হিন্দুদের কাছে গো হারা হারল পুনে ইউরোপীয়রা। একইভাবে 'হারামণি'দের কাতারে চলে গেল অন্যান্য দলও। পুনে হিন্দুদের দলটি পাশের শহর সাতারা সফরে গেল। জিমখানার সাদা চামড়াদের দলের বিরুদ্ধে খেলতে হলো তাদের। জিমখানার দল আগেই তৈরি ছিল। বালুর স্পিন ঠেকানোর জন্য এক সপ্তাহ ধরে পিচ পিটিয়ে তৈরি করা হলো। তারপরও বালু একাই নিলেন সাত উইকেট। তার দল তরতর করে সহজ বিজয়ের পথে চলে গেল।
খুশিতে সাতারার সাধারণ মানুষ বালুকে হাতিতে বসিয়ে আনন্দ শোভাযাত্রা বের করল। পুনেতে ফিরে আসার পর প্রকাশ্য অনুষ্ঠানে বালুর গলায় পুষ্পমাল্য পরিয়ে দিলেন সেকালের শ্রদ্ধেয় পণ্ডিত মহাদেব রানাদে। তিনি আরও এক ধাপ এগিয়ে এলেন। বললেন, বালুকে নিয়ে যদি ক্রিকেট খেলা যায়, তবে তাকে সাথে নিয়েই একত্রে চা এবং খাবার খাওয়া উচিত। পরে বিখ্যাত ব্রাহ্মণ জাতীয়তাবাদী বাল গঙ্গাধর তিলক জনসমক্ষে বালুর প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে ওঠেন। এ ঘটনাকে আশ্চর্যজনক হিসেবে গণ্য করতে হবে। কারণ, সেই সময়ে সামাজিক নিম্নবর্ণের লোকদের মানুষ হিসেবেই গ্রাহ্য করা হতো না। সম্মান তো দূরের কথা। তখনো নিম্নবর্ণের মানুষদের হরিজন আখ্যা দিয়ে মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীর আন্দোলনও শুরু হয়নি।
রানাদে এবং তিলকের তৎপরতাকে নিম্নবর্ণের হিন্দুদের ক্রমবর্ধমান আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে দেখা উচিত। জোতিবা ফুলে ১৮৭৩ খ্রিষ্টাব্দে ব্রাহ্মণ শক্তির বিরোধিতা করেন। 'মানুষে মানুষে ভাই'- এই নীতি প্রচারের মধ্য দিয়ে তিনি সত্যশোধক সমাজ নামে আন্দোলন শুরু করেন। ব্রাহ্মণ সংস্কারকদের সৎ সাহসের ঘাটতি ছিল। তারা নিম্নবর্ণের লোকদের মানুষের অধিকার দেননি বলে মনে করছেন তিনি। প্রতিভাবান চিন্তাবিদ জোতিবা ফুলে জাতিতে ছিলেন মালি। ব্রাহ্মণ সংস্কারকেরা নিম্নবর্ণের মানুষগুলো দুঃখ-বেদনার গভীরতা বুঝতে পারেননি বলেও অভিযোগ তোলেন তিনি।
ফুলে এবং তার মতো অন্যদের আন্দোলন বা লেখালেখির প্রভাবেই হয়তো ব্রাহ্মণ সমাজ চামার বোলারকে মেনে নিতে শুরু করে। পুনের রক্ষণশীলরা বালুর জন্য দরজা খুলতে শুরু করে। সে সময় বালু সপরিবারে বোম্বাই চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। মনে করা হয়, ১৮৯৬-এ পুনেতে প্রাণঘাতী প্লেগ রোগের প্রকোপ এই সিদ্ধান্তের অন্যতম কারণ। এ ছাড়া বোম্বাইতে ক্রিকেট খেলার সুযোগ আরও ভালোভাবে পাওয়া যাবে বলেও ধরে নেন বালু।
বোম্বাইতে সেনাবাহিনীতে কাজ পান বালু। ক্রিকেট খেলতেন পরমানন্দ জীবনদাস হিন্দু জিমখানার পক্ষ নিয়ে। এই ক্লাবেও সহজে স্থান করে নিতে পারেননি বালু। বোলিং দক্ষতার জন্য তাকে ক্লাবে নিতে চান ক্রিকেট অধিনায়ক কীর্তিকর। জাত-পাতের দোহাই পেড়ে বাগড়া দেয় কোনো কোনো সদস্য। কীর্তিকর শেষ পর্যন্ত তাদের সম্মতি আদায় করেন। বালু যোগ দিলেন পরমানন্দ জীবনদাস হিন্দু জিমখানায়।
ঊনবিংশ শতকের বোম্বাই নগরীতে তিন ধরনের ক্রিকেট ক্লাব ছিল। পারসিকদের ক্লাব ছিল; পাশাপাশি জাত-পাত মেনে কিছু ক্লাব গড়ে তুলেছিল হিন্দুরা। দ্বিতীয়ত, বোম্বাই নগরীতে অভিবাসী হয়ে আসা জনগোষ্ঠী গড়ে তুলেছিল কিছু ক্লাব। এ ছাড়া ব্যাংক এবং কোম্পানির পৃষ্ঠপোষকতায় গড়ে উঠেছিল ভিন্ন ধাঁচের ক্রিকেট ক্লাব। এমন সব ক্লাবে নানা বর্ণের হিন্দুরা তাদের মুসলমান বা খ্রিষ্টান সহকর্মীদের সাথে একত্রেই ক্রিকেট খেলতেন। এ রকম ক্রিকেট দলের ব্যবস্থাপক হতেন সাধারণভাবে ইংরেজ। এ রকমই একটি ক্লাব চালাতেন বোম্বাই বেরার এবং সেন্ট্রাল ইন্ডিয়ান (বিবিসিআই) রেলওয়ে। তাদের ক্রিকেট দলের ব্যবস্থাপক এবং অধিনায়ক মিস্টার লুকারের পরামর্শে এরাই বালুকে চাকরি দেয়।
আন্তদপ্তর ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় বিবিসিআই রেলওয়ের পক্ষ নিয়ে মাঠে নামতেন বালু। এমন প্রতিযোগিতা না থাকলে পিজে হিন্দু জিমখানার হয়ে খেলতেন। প্রতি রোববারে কেনেডি সি ফেসে জড়ো হতো হাজার হাজার ক্রিকেটভক্ত। তিনটি জিমখানায় একই সাথে চলত ক্রিকেট প্রতিযোগিতা। সেকালে মুসলমানেরা পিছিয়ে পড়ার দলেই ছিল। যা-ই হোক, এর মধ্যে টান টান উত্তেজনার ঢেউ বইত পিজে হিন্দু জিমখানা এবং ব্যারোনেট ক্রিকেট ক্লাবের মতো শীর্ষস্থানীয় পারসিক দলের খেলায়।
পাঁচ-দশ সারি দর্শক, তারপরও উপচে পড়ত। আশেপাশের রেলওয়ে ওভারব্রিজে দাঁড়িয়ে থাকত অনেকে। সাগরের পাশে হওয়ায় বাড়তি মজা যোগ হতো। তখনো কোনো মেরিন ড্রাইভ তৈরি হয়নি। কখনো-সখনো সাগরের ঢেউ পাথর টপকে ক্রিকেট মাঠেই হানা দিত।
দারুণ উদ্দীপনাময় সেসব ক্রিকেট প্রতিযোগিতার কোনো নথি বা দলিলপত্র আজ আর নেই। তারপরও বিনা দ্বিধায় বলা যায়, সে সময়ে বালু ছিলেন এক অসামান্য ক্রিকেটার। শুরু থেকেই পিজে হিন্দু জিমখানার চৌকস খেলোয়াড় এবং গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ছিলেন তিনি। মন খুলে বালুর প্রশংসা করেন প্রতিদ্বন্দ্বী দল ব্যারোনেট সিসির খেলোয়াড় ডক্টর এম ই পাভরি। তিনি বলেন, নেটিভদের মধ্যে সেরা ছিলেন বালু। বল করায় দক্ষতা ছিল। অপ্রত্যাশিতভাবেই বলকে ঘোরাতে পারতেন। পরের বলটি কী হবে, তা নিয়ে ব্যাটসম্যান সব সময়ই চিন্তায় পড়তেন। স্যাঁতসেঁতে এবং আঠালো মাটিতে বল করার কায়দায় তার মতো দক্ষ আর কেউ ছিল না। বালুকে ভারতের 'রোডস' (ইংরেজ পেশাদার ক্রিকেটার উইলফ্রিড রোডস ১৮৯৯-১৯৩০-এর মধ্যে ৫৮টি টেস্ট ম্যাচ খেলেন। বিশ্বের সেরা বাঁহাতি স্লো বোলারদের অন্যতম তিনি) বলা হতো। ব্যাটসম্যান হিসেবে নিজের যোগ্যতার পরিচয় দিয়েছেন এবং প্রাণবন্ত ফিল্ডারও ছিলেন বালু।
ক্রিকেটের 'রণকৌশল' ও ভালোভাবেই বালুর আয়ত্তে ছিল। মাঠে এমনভাবে ফিল্ডারদের সাজাতেন, বলই তাদের কাছে আসত। বল ধরার জন্য ছুটতে হতো না- বালুর খেলা দেখে এমন কথা বলেন কলকাতার এক ক্রিকেটবোদ্ধা।
এদিকে বালুকে ভারতের 'রোডস' বলা হলেও ইংল্যান্ডের ক্রিকেটের সোনালি যুগের খেলোয়াড় এফ এফ বার্নসের সাথে বরং বেশি মিল পাওয়া যায়। বাঁহাতি স্পিনার হিসেবে বালুর জুড়ি ছিল না। ভারতের বিশ্বমানের বাঁহাতি বোলার বিনোদ মানকাড এবং বিষেণ বেদির অগ্রদূত হিসেবেও তাকে বিবেচনা করা যায়।
বোলার হিসেবে বালু নাম যখন ছড়িয়ে পড়ছে, তখনই রাজপুত রাজপুত্র কে এস রণজিৎ সিংয়ের নামও ব্যাটসম্যান হিসেবে ইংল্যান্ডে ছড়িয়ে পড়ে। গায়ের রংয়ের কারণ কেমব্রিজের ছাত্র হওয়া সত্ত্বেও প্রথম দুই বছর বিশ্ববিদ্যালয়ের মাঠে খেলতে দেওয়া হয়নি রাজপুত্র রণজিৎকে। তিনি অবশ্য 'রণজি' নামেই পরিচিত ছিলেন। কাউন্টি ক্রিকেটে দুই বছর তুখোড় স্কোর করার পরও ১৮৯৬ সালে অস্ট্রেলিয়া সফরকারী ইংল্যান্ডের দলে তার স্থান হয়নি। লর্ডসেও টেস্ট খেলতে পারেননি রণজি। যা-ই হোক, ১৮৯৭ খ্রিষ্টাব্দে তিনি অস্ট্রেলিয়া সফর করেন। সিডনি টেস্টে অনবদ্য ১৭৫ রানসহ পাঁচ টেস্টে ৪৫৭ রান তোলেন তিনি।
'কলসি কণা খেয়েও প্রেম বিলাতে' ব্রতীদের দলেই পড়েন রণজি। তিনি মনেপ্রাণে রাজভক্ত ছিলেন। রানি ভিক্টোরিয়ার ক্ষমতায় আরোহণের ষাটতম বার্ষিকীকে কেন্দ্র করে রণজি লেখেন 'দ্য জুবলি বুক অব ক্রিকেট'। বইতে বলা হয়, 'মহামহিম রানি-সম্রাজ্ঞীর করুণাময় অনুমতিক্রমে বইটি তাঁকে উৎসর্গ করা হলো।' মজার বিষয় হলো, ক্রিকেট নিয়ে বইতে বিস্তারিত আলোচনা হলেও তাতে ভারতীয় বা অন্য কোনো স্থানের ক্রিকেট নিয়ে উচ্চারিত হয়নি একটি শব্দও।
রণজিৎয়ের বিপক্ষে অন্তত দুটি ম্যাচ খেলেছেন বালু। প্রথমটি রাজকোটে রণজিৎয়ের কাঠিয়াড় দলের বিপক্ষে জালাওয়াদের হয়ে খেলেন। জালাওয়াদের পক্ষ থেকে খেলায় অংশ নিতে আমন্ত্রণ করা হয়েছিল বালুকে। তবে এই খেলার কিছু আগে দুর্দান্ত ক্রিকেট খেলার জন্য বোম্বাইতে রণজিৎকে সম্মাননা দেয় পিজে হিন্দু জিমখানা। ক্লাবটির দাপুটে খেলোয়াড় হওয়ার পরও অনুষ্ঠানে নিম্ন জাতের চামার হওয়ার কারণে ঠাঁই হয়নি বালুর।
খেলার মাঠে জালাওয়াদের কাছে ১০ রানে হেরে যায় কাঠিওয়াড়। উইকেটের কাছেই বালুর হাতেই ক্যাচ আউট হয়ে মাঠ ছাড়তে হয় রণজিৎকে। দশ বছর বাদে আবার দুজনের দেখা হয় কলকাতায়। নাটোরের মহারাজার দলের পক্ষে মাঠে নামেন বালু। তত দিনে গুজরাট অঞ্চলের নওয়ানগর রাজ্যের 'জাম সাহেব' (রাজা) হয়ে গেছেন রণজিৎ। যোধপুরের মহারাজার দলের পক্ষ নিয়ে ব্যাট করতে নামেন রণজিৎ। ২০ রান করার পর বালুর ছোড়া বল হাঁকাতে গিয়ে এলবিডব্লিউ হয়ে প্যাভিলিয়নে ফিরে আসেন তিনি। এ ঘটনা বালুর পরিবারের মধ্যে বহুবার বলা হয়েছে। বালুর ছোট ভাইয়ের আত্মজীবনীতেও এ ঘটনার উল্লেখ করা হয়। বালুর ভাইয়েরাও ভালো ক্রিকেট খেলতেন।
এ কথা ঠিক যে ভারতের প্রথম শীর্ষ ক্রিকেটারের নাম নিতে গেলে কে এস রণজিৎয়ের নামটিই আসবে। অথচ ভারতীয় বংশোদ্ভূত হওয়া সত্ত্বেও তিনি নিজেকে 'ইংলিশ ক্রিকেটার' বলেই মনে করতেন। ক্রিকেট খেলার বেশির ভাগই ইংল্যান্ডে রপ্ত করেছেন। ১৮৯৫ থেকে ১৯০০ পর্যন্ত ভারতে বেশ কয়েক দফা ক্রিকেট ম্যাচে অংশ নিয়েছেন তিনি। কিন্তু তার ইংরেজ জীবনীকারেরা বোধগম্য কারণেই সেসব কাহিনি লেখেননি। অন্যদিকে যোধপুর বনাম নাটোরের মতো ভারতে যেসব ম্যাচ খেলেছেন, তা মনে রাখার চেয়ে বরং অস্ট্রেলিয়ার ম্যাচগুলোকে মনে রাখতে ভালোবাসতেন খোদ রণজিৎ।
১৯০৬ খ্রিষ্টাব্দে ক্রিকেটে অভিষেক হয় বালুর। গড়ে ৩৮.২৮ করে ৩৭টি টেস্টে ৭২টি উইকেট নেন। ব্যাটসম্যান হিসেবেও তার দক্ষতা চোখে পড়ার মতোই। টেস্ট ক্রিকেটে ২০০০-এর ওপর রান করেন এবং গড় ছিল ৩৭.০৪।
পশ্চিমাঞ্চলীয় ভারতে দলিত গণমানুষের মুক্তি আন্দোলনের প্রথম প্রতীক বালু। ভারতের খ্যাতিমান আইনবিষয়ক পণ্ডিত এবং দলিত শ্রেণির নেতা, ভারতের সংবিধানের জনক ড. বি আর আম্বেদকারের প্রথম জীবনের নায়কও ছিলেন বালু। এ কথা আম্বেদকারের জীবনীকারেরা উল্লেখ করতে ভুলে যান বা লজ্জা পান! ভারতীয় দলিত মানুষদের আশা এবং উদ্দীপনার প্রতীক বালু ১৯৩৪ খ্রিষ্টাব্দে ক্রিকেট থেকে অবসর গ্রহণ করেন। তিনি ১৯৮৫ খ্রিষ্টাব্দের ৩ আগস্ট বোম্বাইয়ে নিজ বাসভবনে পরলোকগমন করেন। একই দিনে তাকে ওয়াদালা হিন্দু শ্মশানে দাহ করা হয়।
বোম্বাইয়ের দাদার এলাকায় তার নামে একটা সড়ক আছে। বোম্বাইয়ের সবচেয়ে পুরোনো আন্তবিদ্যালয় ক্রিকেট প্রতিযোগিতার নামও রাখা হয়েছে দ্য পালওয়ানকার বালু চ্যালেঞ্জ শিল্ড। বোম্বাইয়ের একটি ক্রিকেট ক্লাবের নাম পালওয়ানকার বালু ক্রিকেট ক্লাব।
অবিভক্ত ভারতের অন্যতম সেরা বোলার হিসেবে ক্রিকেট ইতিহাসকে উজ্জ্বল করে রাখবেন দলিত জনগোষ্ঠী থেকে উঠে আসা খেলোয়াড় পালওয়ানকার বালু।