হামাসের আক্রমণে রাশিয়া ও ইসরায়েলের দুর্বল মৈত্রীর সম্পর্কের ইতি ঘটেছে
অনেক বছর ক্রেমলিনের সঙ্গে 'জটিল' সম্পর্ক বজায় রেখেছেন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে বজায় রেখেছেন উষ্ণ সম্পর্ক।
এমনকি ইউক্রেনে হামলা এবং ইসরায়েলের সবচেয়ে বড় শত্রু ইরানের সঙ্গে মৈত্রীও রাশিয়ার সঙ্গে ইসরায়েলের সম্পর্কে চিড় ধরাতে পারেনি। দুই নেতা ফোনে যোগাযোগ রেখেছেন। নেতানিয়াহু বলেছেন, তিনি ইউক্রেন যুদ্ধে কোনো পক্ষকে সমর্থন করবেন না। পশ্চিমারা চাপ দিয়ে গেলেও কিয়েভে অস্ত্র বা বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা পাঠাতে রাজি হননি তিনি।
ইরানের সমর্থনপুষ্ট হামাস ইসরায়েলে হামলার পর এবার সম্ভবত দুই নেতার মধ্যে কথা বন্ধ হয়ে যাবে। হামাসের আক্রমণের পর বেশ কজন বিশ্বনেতা নেতানিয়াহুকে সান্ত্বনা দিতে ফোন করেছেন—সেই নেতাদের তালিকায় নেই পুতিন।
ইসরায়েলের জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদে কাজ করতেন ভেরা মিচলিন, এখন যুক্তরাজ্যের থিঙ্কট্যাঙ্ক সিম্পোডিয়ামের শিক্ষা-প্রধান। ভেরা বলেন, 'পুতিন আর নেতানিয়াহুর মধ্যে অনেক আলাপ হতো। রাশিয়ার পদক্ষেপের জন্যই নিশ্চয় এখন আর দুজনের কথা হচ্ছে না।'
ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর মধ্যপ্রাচ্যে রাশিয়ার ভূমিকায় বড় পরিবর্তন এসেছে। রাশিয়া ও ইসরায়েলের মৈত্রীর অবসান এই পরিবর্তনের একটি আদর্শ উদাহরণ।
একসময় রাশিয়া অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে ইরানের সঙ্গে ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখে চলত। কিন্তু ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর তেহরানের সঙ্গে ক্রেমলিনের সম্পর্কের ভারসাম্য বদলে গেছে। এছাড়া ইউক্রেন যুদ্ধের জন্য অস্ত্র ও মিত্র সংগ্রহের উদ্দেশ্যে মিসর, ইরাক ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের মতো আরব দেশগুলোর সঙ্গেও সম্পর্ক জোরদার করছে রাশিয়া।
ধারণা করা হচ্ছে, ইরানের সঙ্গে কৌশলগত সম্পর্ক গড়ে তুলছে মস্কো। ইরান মস্কোকে কয়েক হাজার আত্মঘাতী শাহেদ ড্রোন পাঠিয়েছে। যুদ্ধে ইউক্রেনের বিদ্যুৎ অবকাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত করতে ব্যবহার করা হয়েছে এসব ড্রোন। ইরান এখন যন্ত্রাংশ পাঠাচ্ছে রাশিয়ায়—সেখানেই ড্রোন সংযোজন করে নেওয়া হবে।
বিনিময়ে রাশিয়া ইরানের বিমান বাহিনীকে ইয়াক-১৩০ প্রশিক্ষণ বিমান দিয়েছে। এছাড়া ইরানের কাছে সু-৩৫ জেট ফাইটার বিক্রি করার জন্য চুক্তির কথাও ভাবছে রাশিয়া, যা মধ্যপ্রাচ্যে বিমানশক্তির ভারসাম্য বদলে দিতে পারে।
রাশিয়া ও ইরান অনেক বছর ধরেই নিজেদের মধ্যে সম্পর্ক ভালো করার চেষ্টা করছিল। কিন্তু উভয় পক্ষই আলাদাভাবে পশ্চিমের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নত করার চেষ্টায় রত থাকায় দুই দেশের সম্পর্কে অবিশ্বাসের বীজ থেকে যাচ্ছিল। এতে দীর্ঘদিন দেশ দুটির মধ্যে সম্পর্কের টানাপোড়েন চলেছে। কিন্তু পশ্চিমারা উভয় দেশকেই একঘরে করে রাখায় দেশ দুটি এখন এক বিন্দুতে মিলে গেছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
কাতার বিশ্ববিদ্যালয়ের রাশিয়া-ইরান সম্পর্কের বিশেষজ্ঞ নিকোলাই কোজানভ বলেন, রাশিয়া এমন অংশীদার খুঁজছে যে তাকে অস্ত্র সরবরাহ করতে পারবে। তবে পশ্চিমাবিরোধী মনোভাবের জন্যও ইরানের সঙ্গে রাশিয়ার সম্পর্ক দৃঢ় হয়েছে।
এ সময় হামাসের সঙ্গেও সম্পর্ক ভালো হয়েছে রাশিয়ার। গত এক বছরে হামাসের অন্তত দুটি প্রতিনিধি দল মস্কো সফর করেছে আলোচনার জন্য।
গত সপ্তাহে ইসরায়েলের সঙ্গে চলমান সঙ্ঘাতে পুতিনের অবস্থানের প্রশংসা করে টেলিগ্রামে নিজেদের চ্যানেলে একটি বার্তা লিখেছে হামাস।
হামাসের আকস্মিক হামলার নিন্দা জানায়নি ইসরায়েলের একসময়ের মিত্র রাশিয়া। উল্টো স্টেট ডুমার ডেপুটি এবং এর প্রতিরক্ষা কমিটির সদস্য আন্দ্রেই গুরুলেভ প্রতিরক্ষাব্যূহ ভেদে হামাসের সক্ষমতা দেখে নিজে টেলিগ্রাম চ্যানেলে লিখেছেন যে রুশ বাহিনী তাদের [হামাস] কৌশল এবং ইসরায়েলের প্রতিক্রিয়া থেকে শিখতে পারে।
গুরুলেভ লিখেছেন, 'ইসরায়েল কার মিত্র? যুক্তরাষ্ট্রের। ইরান ও তার আশপাশের মুসলিম বিশ্ব কার মিত্র? আমাদের।'
ইরানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক এবং ইসরায়েলের আরব প্রতিবেশীদের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদারে মস্কো যে প্রচেষ্টা চালাচ্ছে, তার সঙ্গে স্নায়ুযুদ্ধের সময় ইসরায়েলের ব্যাপারে মস্কোর অবস্থানের অনেক মিল রয়েছে। ওই সময় যুক্তরাষ্ট্রকে ব্যতিব্যস্ত এবং দুর্বল অর্থনীতির দেশগুলোর ওপর প্রভাব বজায় রাখার উদ্দেশ্যে ইসরায়েলের সবচেয়ে বড় শত্রুদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলেছিল রাশিয়া। এর জেরে ১৯৬৭ সালে ছয়-দিনের যুদ্ধ এবং ছয় বছর পর ইয়ম কিপ্পুর যুদ্ধ সংঘটিত হয়।
রাশিয়া স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের সমর্থক, যে রাষ্ট্রের রাজধানী হবে পূর্ব জেরুজালেম।
একই সঙ্গে রাশিয়ার সীমান্ত থেকে দূরে নতুন আরেকটি যুদ্ধকে স্বাগত জানানোর অভ্যন্তরীণ কারণও আছে ক্রেমলিনের। আগামী মার্চে রাশিয়ায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হবে। সেজন্য ক্রেমলিন চাইছে ইউক্রেন যুদ্ধ থেকে সবার নজর অন্য কোনোদিকে ঘুরিয়ে দিতে।
২৩ বছর ধরে রাশিয়ার শাসনক্ষমতায় আছেন পুতিন। এই দীর্ঘ সময় তিনি রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম ব্যবহার করে দেশের সমস্যা থেকে মনোযোগ অন্যদিকে সরিয়ে দিয়ে ক্ষমতায় থেকেছেন। ইউক্রেন যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হওয়ায় এবার সেরকম করাটা কঠিনই ছিল।
এই মুহূর্তে ইসরায়েলের হামাসের হামলায় রাশিয়ার সুবিধাই হলো। গত সপ্তাহের আগেও রাশিয়াসহ বিশ্বের বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রথম পাতার খবর ছিল ইউক্রেন যুদ্ধ। কিন্তু গত সপ্তাহ থেকেই রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যমগুলোর মনোযোগের কেন্দ্র হয়ে উঠেছে গাজা ও ইসরায়েল।
শীর্ষ রুশ কর্মকর্তারা বলছেন, এ যুদ্ধের অন্যান্য উপকারিতাও দেখছেন তারা। হামাসের সঙ্গে ইসরায়েলের এ যুদ্ধ যুক্তরাষ্ট্রের সুনামের ওপর বড় আঘাত হয়ে এসেছে বলে মনে করছেন তারা।
রুশ কর্মকর্তারা বলছেন, ইসরায়ে ও ইউক্রেনকে একসঙ্গে কতদিন সাহায্য পাঠানো অব্যাহত রাখতে পারবে, তা নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে ওয়াশিংটনকে।
ভেরা মিচলিন বলেন, রাশিয়ার প্রথম প্রতিক্রিয়া ছিল—ইসরায়েল-হামাসের এই সঙ্ঘাত তাদের জন্য আশীর্বাদ। এ লড়াই তাদের ওপর থেকে নানাভাবে চাপ সরিয়ে নিচ্ছে।
গত সপ্তাহে হামাসের হামলার পর প্রথম মন্তব্যেই যুক্তরাষ্ট্রকে তুলোধুনা করেন পুতিন। বলেন, এই আক্রমণ 'যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যপ্রাচ্য নীতির ব্যর্থতার স্পষ্ট উদাহরণ'।
অন্যদিকে শান্তি আলোচনায় পুতিন কখনও কার্যকরভাবে ফিলিস্তিনিদের স্বার্থ রক্ষা করেননি। শুক্রবার তিনি বলেছেন, হামাসের আক্রমণ থেকে নিজেকে রক্ষা করার অধিকার আছে ইসরায়েলের। তবে তিনি একইসঙ্গে শান্তি আলোচনার মাধ্যমে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র তৈরির আহ্বানও জানিয়েছেন।
রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভও ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের মধ্যে শান্তি স্থাপনের ব্যর্থতার জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে দায়ী করেছেন। দুপক্ষের সঙ্ঘাত শুরুর কয়েকদিন পর তিনি আরব লিগের প্রধান আহমেদ আবুল গিত-এর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। সেখানে দুজনে অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি করে আন্তর্জাতিক মধ্যস্থতায় আলোচনায় বসার আহ্বান জানিয়েছেন।
লাভরভ বলেন, 'ইসরায়েলে আমাদের অনেক স্বদেশী বাস করেন। বর্তমান পরিস্থিতিতে আমরা তাদের ভাগ্য নিয়ে উদ্বিগ্ন। তাদের মধ্যে কারও কোনো সাহায্য লাগবে কি না জানার জন্য আমরা সম্ভব সবকিছু করছি।'
গত সপ্তাহে যুদ্ধ শুরুর পরপরই রাশিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট দিমিত্রি মেদভেদেভ বলেছেন, ইসরায়েলি ও ফিলিস্তিনিদের মধ্যে শান্তি স্থাপনের চেষ্টা না করে রাশিয়াকে ধ্বংস করার জন্য যুক্তরাষ্ট্র যে অর্থ ও সময় ব্যয় করেছে, তার প্রাপ্য শাস্তি হচ্ছে হামাসের এই হামলা।
মস্কো বারবার দৃঢ়ভাবে বলে এসেছে যে যুক্তরাষ্ট্র কিয়েভের রাশিয়াবিরোধী নাৎসি শাসন ব্যবস্থাকে সহায়তা ও অস্ত্রের পাশাপাশি উসকানি দিয়ে এসেছে বলেই তারা ইউক্রেনে আক্রমণ করেছে।
গত শনিবার হামাস ইসরায়েলে হামলা চালানোর কয়েক ঘণ্টা পর মেদভেদেভ লেখেন, 'ফিলিস্তিনি-ইসরায়েলিদের মধ্যে শান্তি স্থাপনে সক্রিয়ভাবে কাজ না করে এই নির্বোধের দল আমাদের পিছনে ছুটেছে এবং নব্য-নাৎসিদের সব রকমের সাহায্য দিয়ে আমাদের জাতিকে সংঘাতের মধ্যে ঠেলে দিয়েছে।'
ক্রেমলিনের অন্যান্য বিশ্লেষকও এই ভেবে খুশি হয়ে উঠেছেন যে ইসরায়েলে যুদ্ধ শুরু হওয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের দুই মিত্র এখন প্রতিরক্ষাহীন হয়ে পড়েছে। ক্রেমলিনের টিভি উপস্থাপক ভ্লাদিমির সলোভিয়ভ এক সংবাদ প্রতিবেদনে দাবি করেছেন, জানুয়ারিতে ইসরায়েলে মার্কিন অস্ত্রের মজুত থেকে ৩ লাখ মার্কিন ১৫৫ মিলিমিটার আর্টিলারি শেল সরিয়ে ইউক্রেনীয় বাহিনীকে দেওয়া হয়েছে।
রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমে লন্ডন ও নিউইয়র্কে ফিলিস্তিনের সমর্থনে প্রতিবাদ মিছিলের খবরও ফলাও করে প্রচার করা হয়েছে।
কাউন্সিল অন ফরেইন রিলেশনস-এর ডিস্টিঙ্গুইশড ফেলো টমাস গ্রাহাম বলেন, রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যমগুলো সম্ভবত এখন ইসরায়েল বা অন্য যেকোনো জায়গার বিশৃঙ্খলার খবরাখবর ফলাও করে প্রচার করবে, যাতে রাশিয়ার নিজের সমস্যা থেকে সবার দৃষ্টি ঘুরিয়ে দেওয়া যায়।