প্রথমটি ছিল প্রেমিকার উপহার, তারপর থেকে টাইপরাইটার সংগ্রহ করাই তার নেশা
খুব বেশিদিন নয়, মাত্র কয়েক যুগ আগেও আদালত প্রাঙ্গণ মানেই ছিলো বিরামহীন খটাখট শব্দ। সে অন্য কিছু নয়- টাইপরাইটারে টাইপিস্টদের ক্রমাগত আঙুল স্পর্শের শব্দ। কারো দলিলের কপি, কারো বা আদালতের নথিপত্র। সে সময় সকাল-সন্ধ্যা বিরতিহীন টাইপিং চলতো যে যন্ত্রে, তা এখন অনেকটাই যাদুঘরে স্থান পেয়েছে।
একসময়ের সেরা প্রযুক্তিটিও কালের পরিক্রমায় হয়ে পরে অচল, কিংবা নতুন প্রযুক্তির কল্যাণে হারিয়ে যায় চিরতরে। অতীতের শ্রেষ্ঠ আবিষ্কার ক্যাসেট, ল্যান্ডলাইন অথবা টেলিফোন বুথ যেমন কেবলই গল্প আজ। তবুও এমন কিছু মানুষ থাকেন, যারা ছাড়তে পারেন না অতীতের মায়া, কিংবা নতুন করে প্রেমে পড়েন এসব চিরাচরিত যন্ত্রের। এমনই এক ব্যক্তির নাম মেহেদি হাসান ফুয়াদ। আদালত প্রাঙ্গণে খটাখট আওয়াজ পাওয়া না গেলেও, টাইপরাইটার সংগ্রাহক ফুয়াদের সংগ্রহশালা থেকে সে শব্দ নিয়মিতই পাওয়া যায়। অর্ধশতাধিক টাইপরাইটার নিয়ে ফুয়াদ দেশের অন্যতম সেরা সংগ্রাহক।
প্রথম টাইপরাইটার ছিলো প্রেমিকার উপহার
আমার যদি একটি টাইপরাইটার থাকতো, তোমাকে চিঠি লিখতাম। প্রেমিকাকে উদ্দেশ্য করে কথাটি বলেছিলেন ফুয়াদ। এ ঘটনা ২০১৭ সালের। তিনি তখন আহসানউল্লাহ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। সে বছরই ফুয়াদের জন্মদিনে প্রেমিকা তাকে উপহার হিসেবে দেন একটি টাইপরাইটার! ফুয়াদকে তাই কথা রাখতে হলো। টাইপরাইটারে চিঠি টাইপ করে পাঠালেন প্রেমিকাকে। একটি, দুটি, তারপর অগণিত। ব্যবহার করতে করতে যন্ত্রটির প্রতি এমনই ভালোবাসা জন্মালো তার, শুরু করলেন টাইপরাইটার সংগ্রহ। আর এভাবেই হয়ে উঠলেন দেশের অন্যতম সেরা টাইপরাইটার সংগ্রাহক!
এই হলো শুরুর গল্প। ২০১৭ সাল থেকে ২০২৩, ছয় বছরে ফুয়াদের সংগ্রহে এখন ৬০টি টাইপরাইটার। যেগুলোর প্রায় সবই সচল। প্রেমিকার দেয়া টাইপরাইটার থেকে শুরু, এরপর সারা দেশ ঘুরে বাকিগুলো সংগ্রহ করেছেন তিনি। দেশের বিভিন্ন জায়গায়, যখন যেখানে খোঁজ পেয়েছেন, ছুটে গিয়েছেন। এরমধ্যে ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, যশোর ও সিলেট থেকে সবচেয়ে বেশি সংগ্রহ করেছেন বলে জানালেন ফুয়াদ। মাঝেমধ্যে টাইপরাইটারে লেখালেখিও করেন তিনি। 'আমার কিছু প্রিয় টাইপরাইটার রয়েছে, যেগুলো আমি মাঝেমধ্যে ব্যবহার করি, লিখালিখি করি। তবে এখন সময়ের অভাবে খুব বেশি ব্যবহার করা হয় না।'
টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ডিপ্লোমা ফুয়াদ এখন ইন্টার্নি করছেন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে। এর পাশাপাশি 'ফিল্ম ক্যামেরা' নিয়ে একটি ব্যবসাও রয়েছে তার। মূলত ব্যবসার আয় দিয়েই তিনি শখের টাইপরাইটার সংগ্রহ করেন। এই সংগ্রহ নিয়ে পরিবারের সাহায্যও পেয়েছেন বলে জানালেন ফুয়াদ। 'আমি কখনো সংগ্রহ নিয়ে পরিবারকে চাপ দেই নি। শুরু থেকেই আমার পরিবার অনেক সাপোর্টিভ ছিলো। তবে মাঝেমধ্যে বলতো, এত হাবিজাবি জিনিস দিয়ে বাসাকে জঙ্গল বানাচ্ছো কেন! এমন কিছু কিছু কথা শুনতে হয়েছে। কিন্তু তারা অনেক সাহায্য করেছে।'
টাইপরাইটার সংগ্রহ নিয়ে রয়েছে দারুণ সব গল্প
'একবার আমার সেমিস্টার ফাইনাল চলছিলো। ফেসবুকে হঠাত পোস্ট দেখলাম, একটি টাইপরাইটার বিক্রি করবে। বিক্রেতা যখন বলে যে তাড়াতাড়ি বিক্রি করে দেবে৷ আমি পরীক্ষার হলে না গিয়ে আগে টাইপরাইটার কালেক্ট করতে চলে যাই। তা ওখান থেকে ফিরে যখন পরীক্ষা হলে যাই, জ্যামের কারণে দেরি হয়ে যায়। পরে আর আমাকে ঢুকতে দেয়া হচ্ছিলো না। অনেক রিকুয়েস্ট করে সেবার পরীক্ষা দিয়েছিলাম।' বলছিলেন ফুয়াদ।
দীর্ঘ ৬ বছরের এ সংগ্রাহকের জীবনে এমনই নানা ধরণের গল্প রয়েছে তার ঝুলিতে। এমনও হয়েছে, টাকা অগ্রীম দিয়েছেন, গিয়ে দেখেন অন্যকোথাও বিক্রি হয়ে গিয়েছে টাইপরাইটার। 'একবার একজায়গায় থেকে টাইপরাইটার সংগ্রহের কথা ছিলো। ব্যস্ততার কারণে সেখানে যেতে একটু দেরি হয়। তা গিয়ে দেখি সে টাইপরাইটারটি বেশি দাম পেয়ে বিক্রি করে দিয়েছে! এটা খুব কষ্টকর ছিলো।'
বেডরুমই ফুয়াদের সংগ্রহশালা
ফুয়াদের সংগ্রহের বেশিরভাগ টাইপরাইটারই আমেরিকা, স্পেন ও জাপানের। এছাড়া জার্মান বেশ কিছু টাইপরাইটারও রয়েছে। ৪০ এর দশকের 'এবিসি ও রেমিংটন' টাইপরাইটার তার সংগ্রহের আভিজাত্য বাড়িয়েছে।
প্রেমিকার উপহার দেয়া টাইপরাইটারটি ছিলো 'অলিভেটি লেটার ৩২'। এরপর তিনি একে একে সংগ্রহ করেছেন 'ব্রাদার', 'সিলভার রেড', 'অলিম্পিয়া', 'ব্রাদার চেঞ্জার' সহ অসংখ্য টাইপরাইটার। সবচেয়ে পুরাতন দুটির নাম 'স্মিথ করোনা' ও 'ইম্পেরিয়াল গুড'। যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি 'স্মিথ করোনা' সংগ্রহ করা সংগ্রাহকদের 'স্বপ্ন' থাকে বলে জানালেন ফুয়াদ, যেটি তার রয়েছে। অন্যদিকে ইংল্যান্ডে তৈরি 'ইম্পেরিয়াল গুড'ও তার সংগ্রহে এক দারুণ সংযোজন বলে মনে করেন তিনি।
টাইপরাইটারকে জীবনের একটি অংশ বানিয়ে ফেলেছেন ফুয়াদ। নিজের বেডরুমই তাই এখন তার সংগ্রহশালা। খাটের নিচে, পড়ার টেবিলে, সর্বত্রই টাইপরাইটারের দেখা মেলে। সংগ্রাহকদের সবচেয়ে বড় সমস্যা জায়গার অভাব বলে মনে করেন তিনি। 'টাইপরাইটার সংগ্রহ করতে অনেক পরিমাণ জায়গার দরকার হয়। যে কারণে আমার টাইপরাইটারগুলো কিছু খাটের নিচে, কিছু স্টোর রুমে, কিছু আবার টেবিলের নিচে, এভাবে রাখা। আমার রুমে টাইপরাইটার থাকে, অনেক সময় আমারই থাকার জায়গা থাকে না!'
ফুয়াদের মতে, আরেকটি সমস্যা হলো অর্থ! 'মাঝেমধ্যে দেখা যায় অর্থসংকটে ভুগতে হয়। আর যেহেতু অন্যান্য সংগ্রহের চেয়ে টাইপরাইটার সংগ্রহ তুলনামূলক ব্যয়বহুল, সেহেতু এই সমস্যাটি হয়।' তা কতদামে সংগ্রহ করেছেন এগুলো? ফুয়াদ জানালেন, মডেল ও বয়সভেদে দাম নির্ধারিত হয়ে থাকে। তার সংগ্রহের টাইপরাইটারগুলো আড়াই হাজার থেকে শুরু করে পঁচিশ হাজার টাকা।
সংগ্রহ নিয়ে ভবিষ্যত পরিকল্পনা
ফুয়াদ প্রথমে সংগ্রহ করতেন পুরাতন ক্যামেরা, এছাড়াও সংগ্রহে ছিলো টেলিফোনের মত যন্ত্র। এরপর টাইপরাইটার সংগ্রহে এসে স্বপ্ন বড় হয় তার। ভবিষ্যতে এ সংগ্রহগুলো নিয়ে রয়েছে নানা পরিকল্পনা।
ফুয়াদের মতে, বর্তমান প্রজন্ম তো শুধু কম্পিউটার, কাগজ-কলমের লেখালেখি সম্পর্কে জানে। যান্ত্রিক লেখালেখি বা টাইপরাইটারের ব্যবহার তাদের অধিকাংশেরই অজানা। 'এভাবে কিন্তু টাইপরাইটারের ইতিহাস হারিয়ে যাচ্ছে। আমি বর্তমান প্রজন্মকে সেই যান্ত্রিক লেখালেখি সম্পর্কে জানাতে চাই।'
এ উদ্দেশ্যে একটি সংগ্রহশালা গড়ে তোলার স্বপ্ন রয়েছে ফুয়াদের। 'যদি কখনো সুযোগ হয়, আমি এমন একটি জায়গা তৈরি করতে চাই, যেখানে এসে মানুষ টাইপরাইটারের ইতিহাস সম্পর্কে জানতে পারবে।' আপাতত এটুকুই স্বপ্ন দেখেন তিনি। চান, তার মতো সকলেই যেন ইতিহাস সচেতন হয়ে ওঠে।