কয়েন, হিজাব পিন, ব্যাটারি: বাবা-মায়ের অজান্তে কী খাচ্ছে শিশুরা!
গত ১৮ অক্টোবর একটি লাল রঙের খেলনা গাড়ি নিয়ে খেলছিল ২ বছর ১ মাস বয়সী রিহান। হঠাৎ গাড়ির একটি চাকা খুলে যায় এবং চাকার ভেতরে লাগানো ধাতব ওয়াশার সে তৎক্ষণাৎ মুখে দিয়ে গিলে ফেলে সে। তারপর থেকে খাবার গিলতে কষ্ট হচ্ছিল রিহানের। একসময় খাওয়া বন্ধ হয়ে যায়।
ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে স্থানীয় চিকিৎসকের পরামর্শে এক্সরে করে রিহানের খাদ্যনালীতে ধরা পড়ে ধাতব ওয়াশারটি। শুরু হয় তার বাবা-মার এক হাসপাতাল থেকে অন্য হাসপাতালে ছোটাছুটি।
চারদিন পর ঢাকার একটি প্রাইভেট হাসপাতালে আনা হয় রিহানকে, সেখান থেকে ফিরিয়ে দিলে ২৩ অক্টোবর সকালে বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটে (পূর্বে ঢাকা শিশু হাসপাতাল হিসেবে পরিচিত) নেওয়া হয় রিহানকে।
হাসপাতালের পেডিয়াট্রিক গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজি, হেপাটোলজি ও নিউট্রিশন বিভাগের চিকিৎসকেরা জরুরিভিত্তিতে এন্ডোস্কোপির মাধ্যমে শিশুটির ঘুমন্ত অবস্থায় বিশেষায়িত যন্ত্র দিয়ে ৪ মিনিটের মধ্যে তার শরীর থেকে ওয়াশারটি বের করে আনেন। রিহান এখন পরিপূর্ণভাবে সুস্থ।
এর আগে আগস্টের প্রথম সপ্তাহে দাদুর সাথে খেলতে গিয়ে ২ পয়সার একটি কয়েন খেয়ে ফেলে গাজীপুরের বাসিন্দা আড়াই বছর বয়সী তাহসিন। হাসপাতালে আনার পর এক্সরে করে দেখা যায় কয়েনটি তার খাদ্যানালিতে আটকে গেছে। হাসপাতালের একই বিভাগের চিকিৎসকরা এন্ডোস্কপির মাধ্যমে তাহসিনের পেট থেকেও কয়েনটি বের করে আনেন।
শুধু রিহান বা তাহসিন নয়, প্রায় প্রতি মাসে কয়েন, হিজাব পিন, চাবি, কয়েনসহ বিভিন্ন জিনিস খেয়ে শিশু হাসপাতাল, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও শেখ রাসেল গ্যাস্টোলিভার হাসপাতালে আসছে শিশুরা। এসব ক্ষতিকর উপাদান খেয়ে ফেলার কারণে দীর্ঘমেয়াদী অসুস্থতা এমনকি মৃত্যুঝুঁকিও বাড়ছে শিশুদের। শিশুরা যাতে হাতের কাছে এসব জিনিস হাতের নাগালে না পায় সে বিষয়ে বাবা-মাকে সতর্ক হওয়ার পরামর্শ চিকিৎসকদের।
পেডিয়াট্রিক গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজি, হেপাটোলজি ও নিউট্রিশন বিভাগ জানিয়েছে, শিশু হাসপাতালে প্রায় প্রতিমাসেই এমন এক থেকে দুটি শিশুকে নিয়ে আসা হয় যারা বিভিন্ন ক্ষতিকর উপাদান গিলে ফেলেছে। হাসপাতালে শিশুরা যেসব ক্ষতিকর উপাদান খেয়ে আসে তা সংগ্রহ করে রাখে পেডিয়াট্রিক গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজি, হেপাটোলজি ও নিউট্রিশন বিভাগ। সেখানে দেখা গেছে, দেশি-বিদেশি বিভিন্ন কয়েন, চাবি, হিজাব পিন, কানের দুল, চুলের ব্যান্ড, তারকাঁটা, ব্যাটারি খেয়ে হাসপাতালে এসেছিল শিশুরা।
শিশু হাসপাতালের পাশাপাশি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও শেখ রাসেল গ্যাস্টোলিভার হাসপাতালে এ বছর এখন পর্যন্ত ৫০টিরও বেশি শিশুকে এসব ক্ষতিকর উপকরণ খেয়ে ফেলার পর নিয়ে আসা হয়েছে।
পেডিয়াট্রিক গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজি, হেপাটোলজি ও নিউট্রিশন বিভাগের সহকারি অধ্যাপক ড. সালাহউদ্দিন মাহমুদ টিবিএসকে বলেন, "শিশুরা যেসব ফরেন বডি খেয়ে ফেলে সেগুলো অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। এসব থেকে শিশুদের মৃত্যুও হতে পারে। তাবিজ, হিজাব পিন, পেরেক, চুম্বক, কয়েন, চাবি, বাটন ব্যাটারি -এমন ছোট ছোট জিনিস আকারে গোল হওয়ার কারণে শিশুরা এগুলো গিলে ফেললে তা সহজেই ভেতরে চলে যায়। এসব উপকরণ শিশুদের নাগালের মধ্যে রাখা যাবেনা। শিশুদের এসব থেকে দূরে রাখতে বাবা মায়েদের সতর্কতার বিকল্প নেই।"
তিনি আরো বলেন, "হিজাব পিন এক্ষেত্রে মারাত্মক। মায়েরা ব্যাগের মধ্যে, টেবিলেও ওপর হিজাব পিন রেখে দেয়, যা শিশুরা হাতে নিয়ে খেয়ে ফেলে। হিজাব পিন ভিতরে ঢুকলে তা বের করতেও অনেক কষ্ট হয়। এছাড়া শিশুরা লিথিয়াম ব্যাটারি খেয়ে ফেলে। এতে এসিড থাকায় ভিতরে ঘা হয়ে যায়। এমনকি ব্যাটারি বের করলেও খাদ্যনালী পুড়ে যাওয়াসহ দীর্ঘমেয়াদী জটিলতা বাড়ে।"
সাধারণত ৫ বছরের কম বয়সী শিশু এসব ক্ষতিকর উপাদান খেয়ে হাসপাতালে আসে। আগে এসব ক্ষতিকর উপকরণ খেলে ফেললে অপারেশনের প্রয়োজন হলেও এখন অত্যাধুনিক যন্ত্র ব্যবহারে করে এন্ডোস্কপির মাধ্যমে এসব বের করা যায় বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকেরা।
বাংলাদেশ শিশু হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, "আমাদের আশে পাশে রাখা ছোট ছোট বিভিন্ন জিনিস শিশুরা অসাবধানতাবশত খেয়ে ফেলে। পরে তা খাদ্যানালী ও খাদ্যাথলিতে আটকে যায়। শিশুরা ক্ষতিকর কিছু খেয়ে ফেললে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে না আসলে শিশুর মৃত্যু পর্যন্ত ঘটতে পারে। তাই বাবা মাকে সতর্ক থাকতে হবে।"