ছোটগল্পে হুমায়ূন আহমেদ: অনিচ্ছুক উদাসীনতা?
হুমায়ূন আহমেদের গল্পসমগ্র হাতে নিয়ে বারবার বিস্ময়ের পাতা নুয়ে পড়ে। তাঁর গল্পের সংখ্যা একশরও কম (হয়তো সর্বশেষ সংস্করণে আরও কিছু বাড়তে পারে) । আর উপন্যাস! সে সংখ্যার হিসাব এই মুহূর্তে অপ্রয়োজনীয়। হুমায়ূন আহমদে এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম।
সংখ্যার বিস্ময় এবং গল্প-উপন্যাসের সংখ্যাগত তুলনা ওঠার কারণ- ছোটগল্পের লেখক হিসেবে হুমায়ূন আহমেদের অনায়াস সিদ্ধি। সেজন্যেই আফসোস, কী হতো এ দেশের সাহিত্য ও সাময়িকী-পত্রের সম্পাদকমণ্ডলী তাঁর কাছে আরও বেশি গল্পের তাগিদ দিলে?
সম্পাদকদের সেই অনুরোধ তিনি রক্ষা করতেন কি করতেন না সেই প্রশ্ন পরে। কিন্তু তাঁর গল্পের এই সংখ্যা অন্তত বলে দেয়, প্রকাশক ও পার্বণি কাগজ (ঈদ ও পূজা সংখ্যা) তাঁর কাছে অক্লান্তভাবে উপন্যাসের দাবি জানিয়েছে, তিনি তা মিটিয়েছেন। কিন্তু দৈনিকের বিশেষ সংখ্যায় তারা তাঁকে একই অনুরোধ করলে হয়তো গল্পের সংখ্যা বাড়ত। হুমায়ূন আহমেদের গল্পসমগ্র হাতে নিলে দীর্ঘকাল ধরে- অন্তত ত্রিশ বছর- তাঁর গল্পের পাঠক হিসেবে এই তুলনা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে।
ছোটোগল্পের যে আঁটোসাঁটো গঠন, তাতে প্রায় কোথাও ঔপন্যাসিকের গল্পের বিস্তারে যাওয়ার সুযোগ নেই। যদি একটি সাহিত্যমাধ্যম হিসেবে ছোটোগল্পের গঠনের প্রাথমিক 'মান্য' কায়দাটার কথা মনে রাখি, তাহলে সেই কৌশল একেবারে শুরু থেকেই হুমায়ূন আহমেদ রক্ষা করেছেন। অথবা বলা যায়, এটি তাঁর প্রধান কৌশল।
কথা কত কম বলা যায়; কত কম বলে লক্ষ্যে পৌঁছানো যায়; বর্ণনার কৌশলে কতটা মন্তব্যহীন আর নির্লিপ্ত থাকা যায়; এমনকি সংলাপের ক্ষেত্রেও গল্পের কাহিনির প্রয়োজনে, গল্পের গন্তব্যমুখে যেতে প্রয়োজনীয় সংলাপটিই শুধু ব্যবহার করছেন। যদিও কিছু কিছু গল্পের কাহিনি তাঁর কোনো উপন্যাসের বীজ। আবার কোনো গল্পের নামেই পরবর্তীকালে উপন্যাসও লিখেছেন। তখন দেখা গেছে, সেই উপন্যাসটি হয়তো ওই গল্পের কাহিনির চুম্বক অংশই মাত্র ধারণ করে আছে, বাকিটুকু কাহিনির বিস্তার। এ ঘটতেই পারে, তারাশঙ্কর থেকে কায়েস আহমেদ পর্যন্ত বাংলা কথাসাহিত্যে এমনটা ঘটেছে।
সেটুকু পাশে সরিয়ে রাখলে একেবারে শুরুর নন্দিত নরকে, শঙ্খনীল কারাগার থেকেই হুমায়ূন আহমেদের বলয় ছোটোগল্পের বিপরীতমুখী। সোমেন চন্দ-র 'ইঁদুর' গল্প থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে লিখে ফেলেছেন তিনটি বড়গল্প বা ছোট উপন্যাস। সেই কলমে যখন একটি নির্দিষ্ট আয়তন মেনে গল্প লিখতে শুরু করেছেন, তখন উপন্যাস বা বড়গল্প রচনার ঝোঁককে রূপান্তর করেছেন দারুণ সফলতায়। ফলে তাঁর ছোটোগল্পের পাঠক হিসেবে কোনোভাবে ভোলা যায় না 'খাদক', 'সাদা গাড়ি', 'শ্যামলছায়া', 'জলিল সাহেবের পিটিশন', 'মন্ত্রীর হেলিকপ্টার', 'মৃত্যুগন্ধ', 'চোখ' অথবা 'ইতর'-এর মতো গল্প।
সমকাল সব সময়ই গল্পলেখকের বড়ো এক দায়! ঔপন্যাসিক সেই দায়ে সব সময়ে ভোগেন না। অথবা বাংলা গল্প বাংলা উপন্যাসের তুলনায় সব সময়েই অনেক বেশি সমকালমুখী। আবার গল্পলেখক গল্পে যতটা ব্যক্তিকে রেখে তার আশপাশে সমকালের সংকটে স্থাপিত হতে পারেন, ওই সমকালীনতার ভিতরে ব্যক্তি, ঔপন্যাসিকও সেটি পারেন না।
'সাদা গাড়ি'র সাব্বির, 'জলিল সাহেবের পিটিশন'-এর জলিল সাহেব, 'খাদক'-এর খাদক মতি, 'মৃত্যুগন্ধ'র বাসেত ও ডাক্তার, 'চোখ'-এর ডাকাত, 'ইতর' (এখন পর্যন্ত তাঁর কোনো গল্প সংকলনে গল্পটা অন্তর্ভুক্ত হয়নি)-এর শারীরিকভাবে কর্মাক্ষম লোকটি ও তার স্ত্রী- মনে হতে পারে, এখানে তো গল্পের চরিত্রদের কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু একটু আগেই তো বলা হয়েছে, ছোটোগল্পের পরিসরে ব্যক্তির বিকাশের সুযোগ যেমন থাকে না, সে কাজটি হুমায়ূন আহমেদও করেননি। কিন্তু ওই চলমান সময়ের সঙ্গে ব্যক্তি তার স্থান ও ভূগোল নিয়ে তীব্রভাবে উপস্থিত!
জলিল সাহেবের দুই ছেলে মুক্তিযুদ্ধে শহীদ। কিন্তু সেটি তার কাছে কোনও বিষয় নয়। বিষয় ত্রিশ লাখ মানুষের গণহত্যা। সে জন্য মুক্তিযুদ্ধের পরপরই সারা দেশে স্বাক্ষর সংগ্রহ করার উদ্যোগ তার। বয়েসি শরীরে সেই কাজটি করছেন। কিন্তু পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত অন্য অনেকেরই স্বাক্ষর না দেওয়ার ইচ্ছা কিংবা জলিল সাহেবের দুই ছেলের বিনিময়ে পরিত্যক্ত বাড়ি তাকে দেওয়ার কথাও ওঠে। আবার ধনীর ছেলে সাব্বির। যার পরিবারের কেউ-ই ত্রিশ বছরের বেশি বাঁচে না। বাপ-মায়ের কড়া নজরে থাকে। বাইরে বের হয় একটা সাদা গাড়ি নিয়ে। এই গাড়িতে সাব্বির গল্পের উত্তমপুরুষকে অনুসরণ করে। কিংবা 'চোখ' গল্পে একটি ডাকাতের চোখ তোলা হবে, পাঠকের স্নায়ুতে চাপ পড়তে থাকে, ডাকাত অপেক্ষা করছে কখন তার চোখ তোলা হবে। এই নির্লিপ্ততা। আবার 'মৃত্যুগন্ধ'-র বাসেত যে মানুষের শরীরে আগাম মৃত্যুর গন্ধ পায়, আর বুঝতে পারে লোকটি কখন মারা যাবে। কিংবা নীলক্ষেত বস্তিতে থাকা একটি পরিবার, স্বামী দুর্ঘটনায় প্রায় অচল, বউটি একদিন সঙ্গে করে একজন খদ্দের নিয়ে আসে, আর লোকটি তখন তাদের ছেলেটাকে নিয়ে বস্তির বাইরে ঘুরতে যায়।
ঔপন্যাসিক হুমায়ূন আহমেদ যেখানে সাধারণত মধ্যবিত্ত নাগরিক, কখনও গ্রামীণ কখনও আধানাগরিক জীবনই তাঁর কাহিনি লেখায় বেছে নিয়েছেন; সেখানে সেই জীবনেরই পাশাপাশি আপাত তুচ্ছ জীবন, ক্ষুদ্র ঘটনা, একেবারেই চোখে না পড়াকে দিনযাপনেরই অংশ করে তুলেছেন গল্পে। সেটিই স্বাভাবিক। বাংলা ছোটগল্পের সাধারণ উত্তরাধিকারই তাই।
কিন্তু যারা তাঁর উপন্যাস ও বড়গল্পের পাঠক, যে হুমায়ূন আহমেদকে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কাহিনি-পাঠক হয়ে 'নির্মল মনোরঞ্জনকারী' হিসেবে মনে রাখে, তার কাছে তাঁর ছোটোগল্প একটু কষা আর তীব্র! সেখানে গল্পের লেখন কৌশলে যেমন ফাঁক নেই, গদ্যের চলনে বাক্য থেকে চোখ তোলা যায় না, আপাত প্রাপ্তি নেই, একইরকমভাবে প্রতিদিনের জীবনযাপনে চোখে না পড়াটা চোখে পড়ায়। এমনকি একটু তলিয়ে ভাবলে, একটি গল্প লেখার সময়ে লেখক হিসেবে তাঁর অন্তর্গত প্রস্তুতিও বুঝে নেওয়া যায়।
হুমায়ূন আহমেদের অসংখ্য উপন্যাসের পাশে এককোণে ম্রিয়মাণ আলোর সর্বস্বতা নিয়ে হেলে থাকে গল্পসমগ্র। এ বড়ো অবাক কাণ্ড! বাংলা কথাসাহিত্যে যারাই গল্প-উপন্যাস লিখেছেন, প্রত্যেকেরই গল্পের সংখ্যা উপন্যাসের চেয়ে অনেক বেশি। এমনকি যে লেখকদের পরিচয় শুধু ঔপন্যাসিকই; ভিন্ন পার্বণে ও প্রকাশকদের দাবির মুখে যারা উপন্যাস লিখে গেছেন, তাদেরও গল্পসংখ্যা উপন্যাসের চেয়ে বেশি। এ ক্ষেত্রে হুমায়ূন আহমেদের বেলায় যেমন, তাদের ক্ষেত্রেও তাই। তারা গল্প লিখেছেন সাময়িক পত্র ও সাহিত্য সাময়িকীর সম্পাদকের চাপে। সে চাপে গল্পের সংখ্যা তার উপন্যাসের সংখ্যাকে অনায়াসে ছাড়িয়ে গেছে।
এই কথাগুলো ভাবনায় বলকে উঠতে উঠতেই ঔপন্যাসিক হুমায়ূন আহমেদের অতিপ্রজতার পাশে গল্পকার হুমায়ূন আহমেদের (প্রায়) বিরলপ্রজতার কথা মনে আসে। মনে হয়, ছোটোগল্প কখনই হুমায়ূন আহমেদের পূর্ণ মনোযোগ পায়নি; আরও অনেক ধরনের গদ্য রচনার পাশাপাশি ছোটোগল্প তাঁর এক ধরনের পার্শ্বরচনা।
জনপ্রিয় ঔপন্যাসিক কখনও লিখেছেন গল্প। ছোটোগল্প উপন্যাসের মতো পাঠকপ্রিয় মাধ্যমও নয়। কিন্তু সেই মাধ্যমটিতে তাঁর আরও শ্রম ও মনোযোগের কথা যে তোলা যায়, তা তো ওই মাধ্যমে তাঁর সাফল্যের জন্যই। বাংলা সাহিত্যের এই কনিষ্ঠ সন্তান গদ্যলেখকদের একনিষ্ঠ মনোযোগ ছাড়াই কবিতার পরে সবচেয়ে শিল্পসফল! সেখানে এতখানিক আফসোসের পরে হুমায়ূন আহমেদের যে সফলতা, তাতে তাঁর কয়েকটি ছোটগল্পের কাছে বারবার ফেরা যায়, তাঁর গল্পসমগ্র পড়া যায় যে কোনো সময়ে!