চিকিৎসা ব্যয় বহনে হিমশিম খাচ্ছে ১৪% ডায়াবেটিস রোগী
ডায়াবেটিস পরীক্ষায় ব্যবহৃত স্ট্রিপ, ইনসুলিন এবং মুখে খাওয়া বিভিন্ন ওষুধের দাম বাড়ায় চিকিৎসা ব্যয় বহনে হিমশিম খাচ্ছে ডায়াবেটিস রোগীরা।
সাম্প্রতিক একটি সমীক্ষা থেকে জানা গেছে, ক্রমবর্ধমান চিকিৎসা ব্যয় ১৪% এরও বেশি ডায়াবেটিস রোগীকে আর্থিক ক্ষতির ঝুঁকিতে ফেলছে।
বাংলাদেশ এন্ডোক্রাইন সোসাইটির মতে, বাংলাদেশে আনুমানিক ১.৩১ কোটি মানুষ ডায়াবেটিসে ভুগছেন; ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যার দিক থেকে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান এখন অষ্টম।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত বছর থেকেই ডায়াবেটিস সহ সব ধরণের ওষুধের দাম বেড়ে চলেছে।
বাজারে খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, গত দুই মাসে ডায়াবেটিসের ওষুধ কমপ্রিড ৮০-এর দাম ছিলো ৭ টাকা পাতা, এখন সেটির দাম ৮ টাকা; লিজেন্টা ২.৫/৫০০ এর দাম ১২ টাকা পাতা থেকে বেড়ে ১৩ টাকা, এছাড়াও মেটফরমিনের দাম ৪ টাকা থেকে বেড়ে ৫ টাকা হয়েছে।
সবচেয়ে বেশি বেড়েছে ইনসুলিনের দাম। অ্যাবাসাগলার ইনসুলিনের দাম আগে ছিলো ১০৮৪ টাকা, এখন সেটির দাম ১২৮০। একইসাথে হুমালগ কিউইকপেন ইনসুলিনের দাম ৮৭০ থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯২৫ টাকা।
ডায়াবেটিস টেস্টের স্ট্রিপের দামও বেড়েছে। অ্যাকুচেক একটিভ স্ট্রিপের দাম ৬ মাস আগেও ছিলো ১১০০ টাকা, এখন সেটির দাম ১২৬০ টাকা। অধিকাংশ ডায়াবেটিস রোগীদের ডায়াবেটিসের ওষুধের পাশাপাশি উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ ও কিডনি রোগের ওষুধও খেতে হয়, সেসব ওষুধের দামও বেড়েছে।
লাজ ফার্মার ঢাকা মেডিকেল শাখার ব্যবস্থাপক রাসেল মাহমুদ বলেন, গত দুই মাসে মানুষের সব ধরণের ওষুধের ব্যয় ২০% বেড়ে গেছে।
এতে ডায়াবেটিস রোগীদের ওপর প্রতিনিয়ত ব্যয়ের বোঝা বাড়ছে।
প্রতিদিন চারবার করে ইনসুলিন নিতে হয় ৭২ বছর বয়সী মাহবুবা জাহানকে। ২০১৪ সাল থেকে ডায়াবেটিসে ভুগছেন তিনি। আগে মাসে ৩৫০০ টাকার ইনসুলিন লাগতো তার কিন্তু ইনসুলিনের দাম বাড়ায় গত দুই মাস ধরে তার মাসে ইনসুলিনের পিছনে খরচ হচ্ছে প্রায় ৪০০০ টাকা। ইনসুলিনের দাম বেড়ে যাওয়ায় এখন চারবারের বদলে তিনবেলা ইনসুলিন নেয়ার কথা ভাবছেন তিনি।
১০ বছর ধরে ডায়াবেটিসে ভুগছেন গ্যারেজ শ্রমিক আতাউর রহমান আখন্দ (৬০)। পায়ে অল্প কেটে গিয়েছিল, ডায়াবেটিস থাকায় সেখান থেকে ঘা হয়ে গেছে। এখন চিকিৎসকরা বলছেন, বাম পা কেটে ফেলতে হবে। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখতে প্রতিদিন ইনসুলিন নিতে হয়। ১২০০ টাকার ইনসুলিনে তার ২০ দিন চলে।
ওষুধের দাম বেড়ে যাওয়ায় মাহবুবা জামান ও আতাউরের মত অনেক ডায়াবেটিস রোগী ঠিকমত চিকিৎসা চালিয়ে যেতে পারছেন না।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) এন্ডোক্রাইনোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. শাহজাদা সেলিম বলেন, "বর্তমানে শহর ও গ্রামে প্রায় সমানভাবে বেড়ে চলেছে ডায়াবেটিসের রোগী। এখনই ব্যবস্থা না নিলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে। সর্বস্তরের সমন্বিত কর্মপরিকল্পনা এবং ডায়াবেটিস রোগীর সেবায় সুলভে ওষুধ সরবরাহ থেকে শুরু করে অন্যান্য সহযোগী ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা খুবই জরুরি।"
সমীক্ষা
২০১৭ সালে সংগৃহীত ডেটার আলোকে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ (বিআইডিএস) এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব হেলথ ইকোনোমিকসের গবেষকরা 'আউট অব পকেট এক্সপেন্ডিচার অ্যামং পেশেন্টস উইথ ডায়াবেটিস ইন বাংলাদেশ: আ নেশন-ওয়াইড পপুলেশন বেজড স্টাডি' শীর্ষক একটি গবেষণা পরিচালনা করেন।
২,৬৬৪ খানার প্রায় ২,৮৮৭ জন ডায়াবেটিস রোগীকে গবেষণায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। গবেষণাটি চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে প্রকাশিত হয়।
সমীক্ষা অনুসারে, ২০১৭ সালে জনপ্রতি ডায়াবেটিস রোগীর আউট অব পকেট এক্সপেন্ডিচার (ওওপি) ছিল ৩২৩ ডলার (২৫,৪৭৩ টাকা)। এর মধ্যে শুধু ওষুধের পেছনেই খরচ ৭৫.৪৩%। ফলে ১৪% এরও বেশি ডায়াবেটিস রোগীকে চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে বিপর্যয়ের সম্মুখীন হতে হয়।
গ্রামীণ পরিবারগুলোয় (১৭%) বিশেষ করে, বরিশাল বিভাগে এই বিপর্যয়মূলক স্বাস্থ্য ব্যয় (সিএইচই) সবচেয়ে বেশি (১৯.৫%)। বেসরকারী স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণকারী রোগীদের ক্ষেত্রে আবার এ হার সর্বোচ্চ- ২২%।
বিআইডিএস-এর স্বাস্থ্য অর্থনীতিবিদ এবং সমীক্ষার অন্যতম গবেষক ডা. আবদুর রাজ্জাক সরকার বলেন, "আমরা গবেষণায় দেখেছি ধার করে, সম্পদ বিক্রি করেও চিকিৎসা ব্যয় বহন করতে হয়েছে রোগীদের। ওষুধের ব্যয় সবচেয়ে বেশি। ওষুধের দাম নিয়ন্ত্রণে উদ্যোগ নিতে হবে। পাশাপাশি চিকিৎসকেরা যাতে বেশি দামী ওষুধ না লেখে তা মনিটর করতে হবে, রোগীদেরও চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া অপ্রয়োজনীয় ওষুধ কেনা থেকে বিরত থাকতে হবে।"
ডায়াবেটিস সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে প্রতি বছর ১৪ নভেম্বর বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবস পালন করা হয়। এ বছর দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য- 'ডায়াবেটিসের ঝুঁকি জানুন, প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিন'।