ত্রিরত্নের ‘ক্ষ্যাপা’: বাংলা র্যাপ গানের অনন্য এক সংকলন
সময়টা গত শতকের নব্বই দশক। দীর্ঘ সামরিক শাসনের পর বাংলাদেশে আবারও শুরু হয়েছে সংসদীয় গণতন্ত্রের চর্চা। বিশ্বব্যাপী স্নায়ুযুদ্ধেরও অবসান ঘটেছে। বাংলাদেশে পথচলা শুরু করেছে অনেকগুলো রক ব্যান্ড। কলকাতায় তখন জীবনমুখী গানের জোয়ার। দেশের ব্যান্ডগুলোর কিছু কিছু গানেও তখন আর্থসামাজিক বাস্তবতার প্রতিফলন ঘটতে শুরু করেছে। তরুণদের রক্তে কম্পন তোলা রক সংগীত প্রশ্ন করতে শেখাচ্ছে কর্তৃত্বকে।
সে সময় পুরো পৃথিবীজুড়ে আলোড়ন ফেলে দিয়েছেন আমেরিকান র্যাপাররা। টুপাক শাকুর বা নটোরিয়াস বিগ-এর মতো র্যাপাররা গানের মাধ্যমে গণমানুষের কথাগুলো তুলে ধরছেন। তাদের গান তুলে ধরছে সমসাময়িক আমেরিকাকে।
বাংলাদেশের নব্বইপরবর্তী সংসদীয় গণতন্ত্রের যাত্রা সঙ্গীতের ধারাতেও নিয়ে এলো বদল। কলকাতার জীবনমুখী গানের সমান্তরালে আমাদের এখানে গড়ে উঠল বেশকিছু ব্যান্ড। তবে তার ভেতরেও চমকপ্রদ একটি ব্যাপার ঘটল ১৯৯৩ সালে। গীতিকার আশরাফ বাবু, রেকর্ডিস্ট আজম বাবু ও সোলস ব্যান্ডের পার্থ বড়ুয়া মিলে একটি প্ল্যাটফর্ম গড়লেন — নাম ত্রিরত্ন।
সেই প্ল্যাটফর্মের প্রথম অ্যালবাম ক্ষ্যাপাও এলো সে বছর। বাংলা গানে রক, জ্যাজ, ব্লুজ, র্যেগের মতো ধাঁচগুলোর সঙ্গে ততদিনে শ্রোতারা পরিচিত। তবে র্যাপ গান তখনো সেভাবে তাদের কাছে পরিচিত নয়। আর বাংলা গানে র্যাপের প্রয়োগ — সে তো প্রায় অবিশ্বাস্য ব্যাপার। সে ব্যাপারটিকেই সম্ভব করল ত্রিরত্ন। বাংলা ভাষায় শ্রোতারা শুনতে পেলেন র্যাপ গান।
শুধু তা-ই নয়, গানের কথাতেই দেখা গেল ঝাঁঝ। র্যাপ গানের কাঠামোটি শুধু নয়, বক্তব্যধর্মীতার জায়গাটিকেও ধারণ করল ক্ষ্যাপা। নামি কোনো অডিও প্রযোজনা সংস্থা থেকে ক্যাসেটটি প্রকাশিত হয়নি। সার্প প্রোডাক্ট নামক একটি ইলেকট্রনিক দোকান থেকে ক্যাসেটটি প্রকাশ করেন এর মালিক জাহাঙ্গীর আলম।
নামের সার্থকতা প্রমাণ করে ফেলল ক্যাসেটের গানগুলো। বিশেষত প্রথম গান 'চলছে'-এ র্যাপের মাধ্যমে সে সময়ের ঢাকা, মানুষের যাপিত জীবনের নানা অনুষঙ্গ তুলে আনলেন তারা। গানে ঢাকাই সিনেমা, ব্যান্ড সঙ্গীত, সেলিব্রেটিদের নিয়ে ছড়ানো গসিপ, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধিসহ বহু প্রসঙ্গের উল্লেখ পাওয়া যায়।
তবে এ নিয়ে খানিকটা ঠাট্টা করতেও ছাড়েননি গীতিকার আশরাফ বাবু। ক্যাসেটের ফ্ল্যাপে লেখা ছিলো: 'সস্তা সেন্টিমেন্টের বস্তাপঁচা গান লিখে বিকৃত মানসিকতার পরিচয় দিয়েছেন আশরাফ বাবু।'
'চলছে' ছাড়াও অ্যালবামে ছিল আরও ৯টি গান। ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ আর হাস্যরসের ছলে প্রতিটি গানেই তারা তুলে ধরেন জীবনের নানান দিক। 'প্রেম ভার্সেস বাবা' গানে যেমন লুসি নামের প্রেমিকার বাবা ফোন ধরে ফেলার পর সে নিয়ে নানান হাস্যরসাত্মক পরিস্থিতির উদ্ভব হয়। 'গায়ে হলুদ' গানে একটি বিয়ে নিয়ে বরপক্ষ ও কনেপক্ষের নানান কার্যক্রম হাস্যরসের মাধ্যমে তুলে ধরা হয়। এতে শ্রোতারা খুব ভালোই বুঝতে পারবেন ৩০ বছর আগে মধ্যবিত্ত একটি বাড়ির বিয়ে আসলে কেমন ছিল। নানা অম্ল-মধুর অভিজ্ঞতায় ঘেরা এ আয়োজন তখনো কমিউনিটি সেন্টারনির্ভর হয়নি।
'দেখলাম আর শুনলাম' গানে জীবনের নানান পরিস্থিতি উঠে এসেছে, বিশেষ করে যেসব জায়গায় আমরা দেখেও না দেখার ও শুনেও না শোনার ভান করি। গানটির ভেতর দিয়ে এমন সব পরিস্থিতির কথা প্রকাশিত হয়েছে যা সে সময়ের মতো এ সময়েও প্রাসঙ্গিক হয়ে রয়েছে।
'মাথা ঘুরছে ভনভন' গানটির কথা সময়ের চেয়ে এগিয়ে। ভনভন-এর সঙ্গে ছন্দ মিলিয়ে সিচুয়েশন, ফ্রাস্ট্রেশন, পালপিটিশন, অ্যাকশনের মতো শব্দগুলো ব্যবহৃত হয়েছে এ গানে। আজকের দিনেও কোনো তরুণ যদি এ গান শোনেন, তবে নিজের জীবনের অনিশ্চয়তা, অস্থিরতা, হতাশার সঙ্গে গানটিকে খুব সহজেই মিলিয়ে ফেলতে পারবেন।
'বাথরুমে' গানটিতে উঠে এসেছে বাথরুম সিঙ্গারদের কথা। যারা বাথরুমে কল ছেড়ে দিয়ে কিংবা শাওয়ারের নিচে দাঁড়িয়ে আপনমনে সঙ্গীতচর্চায় মগ্ন হন, তাদের জন্য চমৎকার এক ট্রিবিউট এ গানটি।
ক্যাসেটের আলোচিত আরেকটি গান 'পুরনো দিনের গান'। এ গানটিতে পুরনো দিনের মন-প্রাণ ভরিয়ে দেওয়া গানগুলোকে একরকম ট্রিবিউট দেওয়া হয়েছে। তার সঙ্গে রয়েছে আশরাফ বাবুর স্বভাবসুলভ ব্যঙ্গ। এখানে পুরনো দিনের গানের প্রতি মুগ্ধতা প্রকাশ করার পাশাপাশি রসিকতা করা হয়েছে ব্যান্ড গান নিয়ে। তবে সে সময়ের বোদ্ধাদের কেউ কেউ যেমন রক গানকে অপসংস্কৃতি বলতেন, তাদের কথানুযায়ী র্যাপও অপসংস্কৃতির আরেকটি রূপ ছিল তাদের কাছে। এদিক থেকে পুরোনো দিনের গানের প্রতি মুগ্ধতা জানিয়ে নিজেদের গান নিয়ে 'সার্কাজম' করাটা একরকম মধুর প্রতিশোধই বলতে হয়।
নিজেদের প্রতি ব্যঙ্গের প্রকাশ ঘটেছে ক্যাসেটের কভারেও। 'জঘন্য রেকর্ডিং ও যা-তা মিক্সিং করে ক্যাসেটটির বারোটা বাজিয়েছেন আজম বাবু' কিংবা 'হেঁড়ে গলায় চেঁচিয়ে অশ্রাব্য গান গাওয়ার অপচেষ্টা এবং অসহ্য আবহ সঙ্গীত সৃষ্টি করেছেন পার্থ' — এমন ধাঁচের কথাগুলোতেই স্পষ্ট তাদের সার্কাজম।
এছাড়া ব্যাকআপ ভোকাল সাইফ ও রেকর্ডিস্ট চারুসহ কয়েকজনকে 'ধন্যবাদ দিয়ে ছোট করা'র উল্লেখও পাওয়া যায় ক্যাসেটের কভারে। প্রযোজনা সংস্থা সার্প প্রোডাক্টের জাহাঙ্গীর সাহেবকে 'ধৈর্য ধরে প্রচণ্ড টেনশনে থাকার জন্য'ও ধন্যবাদ জানানো হয়!
ক্যাসেটের কভারে বিশেষ দ্রষ্টব্য হিসেবে লেখা ছিলো: 'কিনেছেন ভাল করেছেন, কাউকে কিনতে পরামর্শ দিবেন না।' ত্রিরত্ন শ্রোতাদের উদ্দেশে ক্যাসেট কভারের ফ্ল্যাপে লিখেছিল: 'মূল্যবান সময় অপচয় করার জন্য শ্রোতাদের ধন্যবাদ, খোদা হাফেজ।'
র্যাপ গানের এ সংকলনটি প্রকাশের পরই আলোচিত ও প্রচণ্ড ব্যবসাসফল হয়। সে সময়ের তরুণ শ্রোতাদের তুমুল আগ্রহের কল্যাণে বাংলা র্যাপ গান নিয়ে এ প্রচেষ্টা শুরুতেই দারুণ সাফল্যের মুখ দেখে। ফলে পরবর্তীকালে এমন আরও কয়েকটি অ্যালবাম বেরিয়েছিল।
যদিও ত্রিরত্ন আর চলছে না বহুদিন ধরেই, তবে ক্ষ্যাপার মতো অ্যালবাম স্থায়ী হয়ে রয়েছে বাংলা গানের ইতিহাসে, সময়ের সঙ্গে প্রাসঙ্গিকতা ধরে রেখে গানগুলো এখনো 'চলছে'।