অ্যাটলাসের স্কন্ধতত্ত্ব ও ভূমিকম্প মিথ
পৃথিবী তো গ্রিক দেবতা অ্যাটলাসের কাঁধে। আমার ওজন, আপনার ওজন যোগ করে পৃথিবীর ওজন দাঁড়ায় ৬.৫৩৫ বিলিয়ন ট্রিলিয়ন মেট্রিক টন। এমন একটা ভারী বোঝা কাঁধে নিয়ে কতক্ষণ স্থির থাকা যায়? কাজেই মাঝে মাঝে কাঁধে আলতো ঝাঁকুনি দিতে হয় অ্যাটলাসকে। সেই ঝাঁকুনিতেই ভূমিকম্প। বড় ঝাঁকুনিতে সব লন্ডভন্ড করে দেয়। অ্যাটলাসের এই কাঁধ ঝাঁকুনির তত্ত্ব একসময় বিশ্বাস করা হতো। বিজ্ঞান অনেক বিশ্বাস ভেঙে দিয়েছে, নাকচ হয়ে গেছে অ্যাটলাসের স্কন্ধতত্ত্ব। পায়ের নিচে যে মাটি, তার নিচে কত যে রহস্য লুকিয়ে। নেই কেবল অ্যাটলাসের কাঁধ। স্কন্ধতত্ত্ব খারিজ হলেও কিছু কিছু মিথ কারও মনে এখনো বহাল রয়েছে:
কুকুর এবং কোনো জন্তু ভূমিকম্প যে ঘটছে, তা আগেই টের পায়
ভূমিকম্প আসন্ন– সে কারণে কুকুর বিড়াল ও অন্য জন্তু অস্বাভাবিক আচরণ করছে কি না, তার নির্ধারণ এখনো নিশ্চিত হয়নি। শেকলবাঁধা কুকুর শেকল ছিড়তে চাইছে কিংবা বিড়াল ছুটে রাস্তার ওপারে চলে গেছে কিংবা গরু বিকট শব্দে হাম্বা ডাকতে শুরু করেছে, কিন্তু তারা সত্যিই ভূমিকম্পের আগমনী বার্তা পেয়েছে কি না, কে জানে! আবার ভূমিকম্পের আগে এই প্রাণীগুলোকে শান্ত ও সুবোধ থাকতেও দেখা গেছে। তাদের আচরণে ধারাবাহিকতার প্রমাণ কেউ পাননি। কাজেই প্রাণীর এই পূর্বানুভূতি তত্ত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়নি।
ভূমিকম্পের মৌসুমেই ভূমিকম্প হয়ে থাকে
সাধারণ ধারণা হচ্ছে, উষ্ণ ও শুষ্ক মৌসুমে ভূমিকম্প হয়। গ্রিকরা তা-ই বলেছে। কিন্তু পৃথিবীপৃষ্ঠের বহু মাইল তলদেশে ভূমিকম্প হয়। সেখানে পৃথিবীর আবহাওয়া বিরাজ করে না। কাজেই ভূমিকম্পের মৌসুম তত্ত্ব খারিজ। যেকোনো সময় যেকোনো আবহাওয়ায় ভূমিকম্প হতে পারে।
বড় মাপের ভূমিকম্প ভোরবেলাতেই হয়ে থাকে
যেকোনো মাপের ভূমিকম্প যেমন আবহাওয়াকে পাত্তা দেয় না, তেমনি সকাল-বিকাল-রাত কিংবা সুবেহ সাদিকের সময়কেও পাত্তা দেয় না। ১৯৪০-এর ইম্পেরিয়াল ভ্যালি ভ'মিকম্প হয়েছে রাত ৯টা ৩৬ মিনিটে আর ১৯৮৯-এর লোমা প্রিয়েতা ভূমিকম্প হয়েছে ভোর ৫টা ২ মিনিটে। ইম্পেরিয়াল ভ্যালি এবং লোমা প্রিয়েতার ভূমিকম্প দুটি বড় ধরনের এবং দুটো স্থানই যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া অঙ্গরাজ্যে।
ভূমিকম্প ঘটার সময়-নিয়ন্ত্রক কোনো কর্তৃপক্ষ নেই। চলতি ডিসেম্বরের প্রথম তিন দিনের কয়েকটি ভূমিকম্পের সময় উল্লেখ করা হচ্ছে।
৩ ডিসেম্বর ২০২৩
৬.৬ মাত্রার ভূমিকম্প ফিলিপাইন থেকে ২০০ কিলোমিটার দূরে; বিকেল ৪টা ৩৫ মিনিটে।
৬.০ মাত্রার ভূমিকম্প ফিলিপাইন থেকে ২০২ কিলোমিটার দূরে; রাত ২টা ৫২ মিনিটে।
৬.২ মাত্রার ভূমিকম্প, ফিলিপাইন থেকে ২১৫ কিলোমিটার দূরে; রাত ১২টা ৯ মিনিটে।
২ ডিসেম্বর ২০২৩
৬.২ মাত্রার ভূমিকম্প, ফিলিপাইন থেকে ১৯৯ কিলোমিটার দূরে; রাত ১১টা ৪০ মিনিটে।
৬.৯ মাত্রার ভূমিকম্প, ফিলিপাইন থেকে ২৪২ কিলোমিটার দূরে; রাত ১০টা ৩ মিনিটে।
৬.৪ মাত্রার ভূমিকম্প ফিলিপাইন থেকে ২০১ কিলোমিটার দূরে; রাত ১০টা ৩ মিনিটে। (অর্থাৎ একই সময় দুটি ভিন্ন স্থানে দুটি ভূমিকম্প)
৫.৫ মাত্রার ভূমিকম্প, বাংলাদেশের চাটখিল থেকে ৯ কিলোমিটার দূরে। সকাল ৯টা ৩৬ মিনিটে।
১ ডিসেম্বর ২০২৩
৪.৮ মাত্রার ভূমিকম্প, যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া থেকে ১১ কিলোমিটার দূরে; বেলা ১টা ৪৩ মিনিটে।
৫.০ মাত্রার ভ'মিকম্প, যুক্তরাষ্ট্রের আলাস্কা থেকে ১৬৫ কিলোমিটার দূরে; রাত ১১টা ৫০ মিনিটে।
সুতরাং ভূমিকম্পের সময় পছন্দ তত্ত্ব ধূলিস্যাৎ হয়ে গেল।
ক্যালিফোর্নিয়া মহাসাগরে বিলীন হযে যাবে
দুটো বৃহৎ টেকটোনিক প্লেটের বিভাজক লাইনটি হচ্ছে সান আন্দ্রিজ ফল্ট সিস্টেম। প্যাসিফিক প্লেট নর্থ আমেরিকান প্লেটের তুলনায় বেশি উত্তর-পশ্চিম দিকে যাচ্ছে। এই গতি ও সরল আনুভূমিক, ফলে লস অ্যাঞ্জেলেস যাচ্ছে সান ফ্রান্সিসকোর দিকে। যুক্তরাষ্ট্রের জিওগ্রাফিক্যাল সোসাইটি স্পষ্টভাবেই জানিয়েছে ক্যালিফোর্নিয়ার মহাসাগরে পতিত হওয়ার কোনো কারণ নেই। কাজেই বিলীন হবে না। পৃথিবীতে শক্ত মাটির ওপরই অঙ্গরাজ্যটির দৃঢ় অবস্থান। প্যাসিফিক প্লেট প্রতিবছর কতটা উত্তর-পশ্চিমে যাচ্ছে, তা জানা দরকার। বৈজ্ঞানিক হিসাবে বছরে ৪৬ মিলিটার, অর্থাৎ যে গতিতে আমাদের নখের আঙুল বড় হয়, সেই হারে এগোচ্ছে। ক্যালিফোর্নিয়া বেশই আছে। তবে লস অ্যাঞ্জেলেস ও সান ফ্রান্সিসকো একদিন কাছাকাছি এসে যাবে। তারপরও সতর্ক থাকা ভালো, বড় মাপের ভূমিকম্পে ভূমিধস হবে, ক্যালিফোর্নিয়ার উপকূলরেখার কিঞ্চিৎ পরিবর্তন ঘটবে।
ভূমিকম্পে পৃথিবী হাঁ করবে এবং মানুষ গিলে ফেলবে
এই বর্ণনাটি আদিকালের এবং গ্রাম্য ধাঁচের হলেও এই মিথে কিছুটা সত্য আছে। ভূমিকম্পে স্থলভাগের ফাটল হামেশাই দেখা যায়। ফাটল বড় হলে তাতে কেবল মানুষ নয়, হাতি-ঘোড়া, বাস-ট্রাকসহ অনেক কিছুই তাতে পড়ে যেতে পারে।
১৯৮৮ সালের ২২ জানুয়ারি অস্ট্রেলিয়ার ডারউইনে উপর্যুপরি ভূমিকম্পে ৩৬ মাইল দীর্ঘ ফাটল সৃষ্টি হয়েছিল। ১৯৫৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের মনটানার হেনগেন লেক ভূমিকম্প ম্যাডিসন নদীর প্রবাহ আটকে দিয়ে পরবর্তীকালে কোয়েক লেক নামে খ্যাত কোথায় কোথাও ১২৫ ফুট গভীরতার ছয় মাইল দীর্ঘ একটি খাল সৃষ্টি করেছিল।
ছোট ছোট ভূমিকম্প বড় ভূমিকম্প হওয়া ঠেকিয়ে দেয়
রিখটার স্কেলের ১ থেকে ১০ মাত্রায় প্রতিটি ঊর্ধ্বগামী ধাপে পূর্ববর্তী ধাপের ৩০ গুণ বেশি শক্তি অবমুক্ত হয়। ৩ মাত্রার ৩০ গুণে ৪ মাত্রা, আর ৯০০ গুণে ৫ মাত্রা আর ৯ মাত্রা মানে ৩ গুণের ৭২৯ বিলিয়ন গুণ শক্তির অব্যাহতি প্রদানকারী। কাজেই ছোট ছোট ভূমিকম্প ফল্ট লাইনের চাপ কিঞ্চিৎ কমালেও তা বড় ধরনের ভূমিকম্প ঠেকাতে পারে না। বড় ভূমিকম্পের চাপ কমাতে হলে হিসাব করে বিজ্ঞানীরা দেখিয়েছেন, রিখটার স্কেলের ৯ মাত্রার একটি ভূমিকম্পের বদলে একই স্কেলের ২ মাত্রার ১৬৩,৮৪০,০০০.০০০টি ভূমিকম্প হতে হবে। আর প্রতিদিন যদি ১০ লক্ষ এমন ভূমিকম্প হয়, তাহলে চাপ ফুরোতে সময় লাগবে ৫০০ বছর। কাজেই এটা স্পষ্ট, কম মাত্রার ভূমিকম্প বেশি মাত্রার শক্তিশালী ভূমিকম্প ঠেকাতে কোনো ভূমিকা রাখতে পারে না। তবে সিসমলজিস্টরা বলে থাকেন, বড় ভূমিকম্পের আগে ছোট মাপের ভূমিকম্প হওয়ার অনেক নজির তারা দেখতে পেয়েছেন।
ভূমিকম্প আগের চেয়ে বেড়ে গেছে
এটি প্রতিষ্ঠিত সত্য নয়। উল্লেখ করার মতো ৫৫টি ভূমিকম্প প্রতিদিন ঘটে থাকে। কয়েক শতাব্দী ধরে ৭ বা ততধিক মাত্রার ভূমিকম্পের সংখ্যা মোটামুটি একই থাকছে– সঠিকভাবে বলতে গেলে সামান্য কমেছে। এখন পৃথিবীজুড়ে অনেক ভূমিকম্প নির্ণায়ক কেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে; অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি সূক্ষ্ম কম্পনকেও রেকর্ড করতে সমর্থ হচ্ছে, সে জন্য সংখ্যাবৃদ্ধি ঘটছে বলে মনে হচ্ছে। কার্যত এর একটি উল্লেখযোগ্য অংশ আগে রেকর্ডবহির্ভূত থেকে যেত। তা ছাড়া সিসমিসিটি বা ভূমিকম্প সংঘটনের কিছু হ্রাস-বৃদ্ধি নতুন কোনো ঘটনা নয়। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে এভাবেই চলে আসছে। কমক্যাট আর্থকোয়েক ক্যাটালগে বিগত দশকগুলোতে ভূমিকম্পের ক্রমবর্ধমান সংখ্যার উল্লেখ ভূমিকম্পের ফ্রিকোয়েন্সি বাড়ার কারণে নয় বরং যন্ত্রের ধারণক্ষমতা বৃদ্ধির কারণে। ১৯০০ সাল থেকে প্রতিবছর পৃথিবীতে ৭ বা ততধিক মাত্রা ১৬টি ভূমিকম্প প্রত্যাশিত, তার মধ্যে একটি ৮ বা ততধিক মাত্রার। ৪০ বছরে এ ধরনের ভূমিকম্পের বৃদ্ধি লক্ষ করা গেছে। ২০১০ সালে ৭-এর অধিক মাত্রার ২৬টি ভূমিকম্প হয়েছে, তারপর হ্রাস পেয়েছে। ১৯৮৮ ও ১৯৮৯ সালে এই শক্তির ভূমিকম্প হয়েছে সবচেয়ে কম। ১৯৮৮ সালে ৭টি এবং ১৯৮৯ সালে ৮টি; ২০২২ সালে ৭ থেকে ৭.৯ মাত্রা ভূমিকম্প হয়েছে ১১টি। ৮ মাত্রা বা ততধিক মাত্রার কোনো ভ'মিকম্প হয়নি। ২০২৩ সালে নভেম্বর পর্যন্ত ৭-৭.৯ মাত্রার ১৮টি ভূমিকম্প হয়েছে। ২০২১ সালে সংখ্যাটি ছিল ১৬। এই সংখ্যা কিছু বাড়া বা কমায় সার্বিক ভূমিকম্প পরিস্থিতিতে তেমন কোনো পরিবর্তন ঘটে না।
যত বেশি মাত্রার ভূমিকম্প, তত বেশি সর্বনাশ
সত্য নয়। সাহারা মরুভূমি ৭ মাত্রার ভূমিকম্পে যত না ক্ষতি হবে, ঢাকা শহরে ৬ মাত্রার ভূমিকম্পে তার চেয়ে অনেক বেশি ক্ষতির কারণ হবে। রিখটার স্কেলের মাত্রা প্রকৃতপক্ষে যে শক্তি বহির্গত হয়, তা নির্দেশ করে। ভূমিকম্পের এপিসেন্টার কোথায়, সেটা গুরুত্বপূর্ণ। ২০১৫ সালের কাঠমান্ডু ভূমিকম্পে ৮৯৬৪ জনের মৃত্যু ঘটেছে। এই ভূমিকম্পের এপিসেন্টার ছিল চীন সীমান্ত বরাবর। কাঠমান্ডুর আরও কাছে হলে মৃত্যুর মিছিল হয়তো আরও বড় হতো।
মেগাভূমিকম্প ঘটতে পারে
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ১০ মাত্রা বা ততধিক মাত্রার ভূমিকম্প ঘটার সম্ভাবনা তেমন নেই। ভূমিকম্পের আকারসংশ্লিষ্ট ফল্ট এর ওপর নির্ভরশীল। যে ফল্টের সাথে ভূমিকম্পের সম্পৃক্ততা, তা দীর্ঘ হলে ভূমিকম্পের মাত্রাও বেশি হবে। যেমন– সান আন্দ্রেস ফল্ট ৮০০ মাইল দীর্ঘ। এখানে ১০.৫ ম্যাগনিচিউড ভূকম্পন ঘটাতে ফল্ট লাইনকে অনেক বড় হতে হবে। আসলে ১০.৫ মাত্রার ভূমিকম্প সৃষ্টি করার মতো কোনো ফল্টলাইন নেই।
ভূমিকম্প মিথ
অ্যারিস্টটলের মিথ: পৃথিবীপৃষ্ঠের তলদেশে বিভিন্ন প্রকোষ্টে বাতাসের প্রবাহের শক্তির ওপর ভূমিকম্পের তীব্রতা নির্ভর করে। পৃথিবী, বাতাস, আগুন ও পানি নিয়ে অ্যারিস্টটলের ধারণা তেমন বিজ্ঞানসম্মত ছিল না।
চীনা মিথ: একটি অতিকায় ব্যাঙের ওপর পৃথিবীর অধিষ্ঠান। ব্যাঙ নড়েচড়ে ওঠা মানেই পৃথিবীতে ভূমিকম্প।
জাপানি মিথ: পৃথিবীপৃষ্ঠের তলদেশে অতিকায় একটি মাগুর মাছ রয়েছে। যখন শরীরে মোচড় দেয়, কিংবা হাঁ করে, পৃথিবীতে ভূমিকম্প অনিবার্য হয়ে ওঠে।
পূর্ব আফ্রিকান মিথ: একটি মাছ একটি বড় পাথর বহন করে। পাথরের ওপর দাঁড়িয়ে আছে একটি গরু। একটি শিং দিয়ে গরু পৃথিবীকে বহন করে ভারসাম্য রক্ষা করে চলেছে। যখন তার ঘাড়ব্যথা শুরু হয়, তখন পৃথিবীকে অন্য শিংয়ের ওপর তুলে দেয়। এই সময়ের কম্পন ভূমিকম্প সৃষ্টি করে।
ভারতীয় মিথ: হাতি পৃথিবীর ভার বহন করে। যখন ক্লান্ত হয়ে পড়ে, মাথা নোয়ায় এবং ঝাঁকি দেয়, তাতেই সৃষ্টি হয় ভূমিকম্প।
মানুষকে সতর্ক করতে স্রষ্টা বিশেষ বার্তার নাম ভূমিকম্প।