নোয়াম চমস্কি ৯৫ বছরে, যেভাবে তার বিখ্যাত দার্শনিক হয়ে ওঠা
নোয়াম চমস্কি নিজের মেধা ও প্রজ্ঞার মাধ্যমে বিশ্বজুড়ে ব্যাপকভাবে খ্যাতি অর্জন করেছেন। তাকে বর্তমান সময়ের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বুদ্ধিজীবী ও দার্শনিক হিসেবেও অভিহিত করা হয়। সম্প্রতি এই কিংবদন্তি ৯৫ বছর বয়সে পদার্পণ করেছেন।
দীর্ঘ এই জীবনে চমস্কি আধুনিক ভাষাবিজ্ঞানে নিজের অনন্য প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন। এছাড়াও মনোবিজ্ঞান, দর্শন এবং রাজনৈতিক বিষয়েও রয়েছে তার অসামান্য অবদান।
চমস্কি 'কগনিটিভ সাইন্স' কে একটি ডিসিপ্লিন হিসাবে প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। পরবর্তীতে এর মৌলিকতার ওপর ভিত্তি করেই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কিংবা এআইয়ের উত্থান ঘটে। যদিও বিষয়টি নিয়ে খুব একটা আলোচনা করা হয় না।
চমস্কি ১৯৫৭ সালে 'সিনট্যাকটিক স্ট্রাকচারস' নিয়ে কাজ করে একাডেমিক জগতে সর্বপ্রথম আলোচনায় আসেন। এটি একটি উচ্চ প্রযুক্তিগত ভাষাবিজ্ঞান মনোগ্রাফ যা ভাষার অধ্যয়নে বিপ্লব ঘটিয়েছে।
১৯৫৯ সালে চমস্কি বি. এফ. স্কিনারের 'ভার্বাল বিহেবিয়ার' এর ওপর রিভিউ লিখে রীতিমতো হইচই ফেলে দেন। স্কিনার ছিলেন একজন মনোবিজ্ঞানী এবং আচরণবিদ; যিনি 'অপারেন্ট কন্ডিশনিং' তত্ত্ব দিয়ে মনোবিজ্ঞানের জগতে বিখ্যাত হয়ে উঠেছিলেন।
স্কিনারের তত্ত্ব অনুযায়ী, একটি ভাষাকে ভাষাবিজ্ঞানের মৌলিক উপাদানগুলিতে ভেঙে অনুমিতভাবে 'অপারেন্ট কন্ডিশনিং' এর মাধ্যমে শেখা সম্ভব।
তবে চমস্কি স্কিনারের এই তত্ত্বের সাথে সম্পূর্ণ ভিন্নমত প্রকাশ করেন। তিনি দেখান যে, ভাষাকে ঐ তত্ত্বের আলোকে প্রকৃতপক্ষে বোঝা সম্ভব না।
ভাষা সম্পর্কে চমস্কি বলেন, "ভাষা সৃজনশীল। আমরা প্রায়শই এমন সব বাক্য উচ্চারণ করি যা আগে কখনও শোনা যায়নি। যার মানে হচ্ছে, স্কিনারের বর্ণিত পুরষ্কার কিংবা শাস্তির মতো সাধারণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এই দক্ষতা অর্জন করা যায় না।"
চমস্কির জন্ম ১৯২৮ সালের ৭ ডিসেম্বর, যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভেনিয়া অঙ্গরাজ্যের সবচেয়ে বড় শহর ফিলাডেলফিয়ায়। তার পরিবার ছিল ইহুদি অভিবাসী।
চমস্কি পেনসিলভানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন। ভাষাতত্ত্বের দর্শনে পারদর্শী হওয়ার আগে তিনি প্রথমে ভাষাতত্ত্ব ও আধুনিক হিব্রু বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করেন।
এটা সত্য যে, ভাষার ব্যাকরণ ও সিনট্যাক্স কাঠামোর উপর দেওয়া চমস্কির নানা তত্ত্ব তাকে বেশ জনপ্রিয় করে তুলেছে। তবে তার জনপ্রিয়তার ক্ষেত্রে এরচেয়েও বেশি প্রভাব রেখেছে বিভিন্ন রাজনৈতিক ইস্যুতে তার বিচারতাত্ত্বিক ও সমালোচনামূলক অবস্থান।
১৯৬০ এর দশকের পর থেকে চমস্কি ভিয়েতনাম যুদ্ধের বিরুদ্ধে নিজের রাজনৈতিক ভিন্নমত প্রকাশের পাশাপাশি প্রতিবাদে শামিল হন। তার এমন কর্মকাণ্ডে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন তাকে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ পর্যন্ত ভাবতে শুরু করে।
পরবর্তী সময়েও চমস্কি নিজের রাজনৈতিক দর্শন প্রকাশ ও প্রতিবাদের কাজ চালিয়ে গিয়েছেন। যার অন্যতম বিষয়বস্তু ছিল যুদ্ধ ও ফ্যাসিবাদ বিরোধী অবস্থান এবং বাক স্বাধীনতার পক্ষে কথা বলা।
চমস্কি বলেন, "হেয় প্রতিপন্ন হওয়া মানুষের মত প্রকাশের স্বাধীনতায় আমরা বিশ্বাসী না হলে প্রকৃতপক্ষে আমরা মত প্রকাশের স্বাধীনতায়ই বিশ্বাস করি না।"
ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাত নিয়েও চমস্কি সবসময় সোচ্চার ভূমিকা পালন করেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের যে অল্প সংখ্যক বুদ্ধিজীবী ফিলিস্তিনে চালানো ইসরায়েলের ক্রমাগত দখলদারিত্ব নিয়ে সমালোচনা করেন, তিনি তার মধ্যে অন্যতম।
২০২১ সালের মে মাসে গাজা ইস্যুতে ইসরায়েলকে উদ্দেশ্য করে চমস্কি টুইট করেন যে, "তোমরা আমাদের পানি কেড়ে নিয়েছ, জলপাই গাছ ধ্বংস করেছ, আমাদের কর্মসংস্থান কেড়ে নিয়েছ, আমাদের ভূমি দখল করেছ, আমার বাবাকে কারাবন্দি, আর মাকে হত্যা করেছ। বোমা ফেলে আমাদের দেশকে ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছ, আমাদের সবাইকে ক্ষুধার্ত রেখেছ, আমাদের সবাইকে অসম্মান করেছ। এসব সত্ত্বেও আমাদের দোষারোপ করে বলছ, আমরা পাল্টা রকেট নিক্ষেপ করেছি।"
চমস্কির বহু বক্তব্য বেশ বিখ্যাত ও ইন্টারনেট দুনিয়ার প্রতিনিয়ত আলোড়ন তৈরি করে থাকে। ভবিষ্যতে সম্পর্কে বিখ্যাত এই দার্শনিক একবার বলেন, "ভালো ভবিষ্যতের জন্য আমাদের আশাবাদী হতে হবে। কেননা আপনি যদি না-ই বিশ্বাস করেন যে ভবিষ্যত আরও ভালো হতে পারে, তবে আপনার এটি তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ ও দায়িত্ব গ্রহণের সম্ভাবনা কম।"