তথ্যের অসংগতি: সরকারি তথ্য বলছে মাছ উৎপাদন বেড়েছে, চাষিরা বলছেন কমেছে
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের বার্ষিক প্রতিবেদনে গত অর্থবছরে অর্থবছরে মোট মাছের উৎপাদন ১.৫৬ লাখ টন বেড়েছে বলা হলেও দেশজুড়ে মৎস্যচাষিরা বলছেন বিপরীত কথা।
সরকারি তথ্য বলছে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে মাছের উৎপাদন হয়েছে ৪৯.১৫ লাখ টন, যা আগের অর্থবছরে ছিল ৪৭.৫৯ লাখ টন।
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের বার্ষিক প্রতিবেদনের তথ্যমতে, ২০২১-২২ অর্থবছরে বদ্ধ জলাশয় থেকে মাছের সরবরাহ আসে ৫৭.৩৯ শতাংশ।
মৎস্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মাহবুবুল হক টিবিএসকে বলেন, 'আমরা উৎপাদনের যে তথ্যটা তৈরি করছি, সেটা ভুল হওয়ার সুযোগ নেই। কারণ দেশি-বিদেশি বিভিন্ন সংস্থার মাধ্যমে কয়েক দফায় এটা ক্রস চেক করা হয়।'
তবে মাঠ পর্যায়ের তথ্য বলছে ভিন্ন কথা। মাছ উৎপাদনে জড়িত ছোট-বড় খামারিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তারা বড় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছেন। যার ফলে উৎপাদন কম হয়েছে, অনেক খামার বন্ধও হয়ে গেছে।
এই ধাক্কার মূল কারণ হিসেবে করোনা মহামারির কথা বলেছেন তারা। মহামারিকালে উৎপাদন খরচের নিচে মাছ বিক্রি করতে হয়েছে তাদের। এতে অনেক খামারি বড় ধরনের লোকসান করেন। এই লোকসানের কারণে অনেকেই সক্ষমতা হারিয়ে মাছ চাষ বন্ধ করে দেন। বড় বড় অনেক খামারি উৎপাদনের পরিমাণও কমিয়েছেন।
এই অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে আসতেই শুরু হয় রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। এ যুদ্ধের প্রভাবে ব্যাপকভাবে বাড়তে থাকে ফিডের দাম। গত দুই বছরের মধ্যে প্রতি কেজি ফিডের দাম ৬৬ শতাংশ বেড়ে ৭০ টাকায় উঠেছে।
একদিকে পুঁজি হারানো, অন্যদিকে মাছ উৎপাদনের খরচ বেড়ে লাভের পরিমাণ কমে যাওয়ায় খামারিরা মাছের উৎপাদন কমিয়ে এনেছেন।
ময়মনসিংহের ত্রিশাল উপজেলার আবু নোমান ৩০টি পুকুরে পাঙ্গাস, রুই, কাতলা ও পাবদা মাছের চাষ করেন।
করোনার আগে এই উদ্যোক্তা প্রতি বছর ১ হাজার ২০০ টন মাছ উৎপাদন করতেন। কিন্তু করোনায় মাছে লোকসান এবং পরবর্তীতে খরচ বেড়ে যাওয়ায় লাভ সীমিত হয়ে পড়েছে। সে কারণে তিনি দুই বছর ধরে এই উৎপাদন ৮০০ টনের নামিয়ে এনেছেন।
তিনি দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'দুই বছর ধরে উৎপাদন খরচ বেড়ে বেড়ে এমন অবস্থায় এসেছে যে মাছের লাভ একেবারেই সীমিত হয়ে পড়েছে। কোনো কারণে এটা উৎপাদন খরচের নিচে নামলেই কোটি কোটি টাকা লোকসান গুনতে হয়। যে কারণে উৎপাদন কমিয়ে আনতে বাধ্য হয়েছি।'
স্বাভাবিক সময়ে বছরে ৪ লাখ টনের বেশি তেলাপিয়ার উৎপাদন হয়। কিন্তু গত দুই-তিন বছরে নানা সংকটের কারণে অনেকেই এখন উৎপাদন বন্ধ ও কমিয়ে দিয়েছেন। এ কারণে গত দুই বছরে তেলাপিয়ার উৎপাদন ৩০-৪০ শতাংশ কমে গেছে।
বাংলাদেশ তেলাপিয়া ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদক এবং এগ্রো থ্রি ফিশ হ্যাচারি অ্যান্ড কালচার ফার্মের স্বত্বাধিকারী এবিএম শামসুল আলম বাদল টিবিএসকে বলেন, অনেক চাষি উৎপাদন বন্ধ করে দিয়েছেন, অনেকে আবার সীমিত পরিসরে উৎপাদন করছেন।
তিনি বলেন, 'অনেক কৃষক আছেন যারা বাকিতে খাদ্য নিয়ে মাছ চাষ করে লোকসান করেছেন, ঠিকমতো খাদ্যের দাম পরিশোধ করতে পারেননি। যে কারণে এখন ফিড উৎপাদনকারীরা বাকিতে খাদ্য বিক্রি বন্ধ করে দিয়েছে। ফলে এখন চাইলেও অনেকের পুঁজি খাটানোর সক্ষমতা কমে গেছে।'
শামসুল আলম আরও বলেন, 'চাষিরা মাছ চাষ থেকে সরে আসায় বা কমিয়ে দেওয়ায় যে উৎপাদন ঘাটতি তৈরি হয়েছে, তা মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনে প্রতিফলিত হয়নি বলেই মনে হচ্ছে।'
চিংড়ির তথ্যে অসংগতি
দেশে মাছের মোট উৎপাদনের উল্লেখযোগ্য একটা অংশে রয়েছে চিংড়ি। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে চিংড়ির উৎপাদন হয়েছে ২.৬১ লাখ টন। তবে চিংড়ির উৎপাদন ও রপ্তানির সঙ্গে জড়িতরা বলছেন, উৎপাদনের এই তথ্য ও মাঠের উৎপাদনের তথ্যে বিস্তর ফারাক রয়েছে।
তথ্যের এই অসংগতি সরকারি নথিতেও দেখা গেছে। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় গত মার্চে 'বাংলাদেশে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে ভেনামি চিংড়ি চাষ নির্দেশিকা' পাঠিয়েছে মৎস্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের কাছে। এই নির্দেশনায় বলা হয়েছে, দেশে বাগদা চিংড়ির উৎপাদন ৭২ হাজার ৮০৯ টন।
চিংড়ি চাষি ও রপ্তানিকারকরা বলছেন, বাংলাদেশে শুধু বাগদা ও গলদার চিংড়ির উৎপাদনই রয়েছে। ভেনামি এখনো সেভাবে উৎপাদন শুরু হয়নি।
তারা বলছেন, বাগদার উৎপাদন যদি ৭২ হাজার ৮০৯ টন হয়, তবে গলদার উৎপাদন কোনোভাবেই বাগদার এক-তৃতীয়াংশের বেশি নয়। সেই হিসাবে চিংড়ির উৎপাদন ১ লাখ টনের কাছাকাছি পৌঁছাই কষ্টকর। কিন্তু সরকার আড়াই লাখ টনের হিসেব দেখাচ্ছে।
চিংড়ি রপ্তানিকারক এবং বাংলাদেশ ফ্রোজেন ফুডস এক্সপোর্টারস অ্যাসোসিয়েশন-এর (বিইএফইএ) সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে টিবিএসকে বলেন, 'চিংড়ির উৎপাদন কোনোভাবেই ১ লাখ টনের বেশি নয়। আড়াই লাখ টনের বেশি যেটা বলা হচ্ছে, তা মোটেও ঠিক না।'
এদিকে বাজারে মাছের দাম চড়া। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, উৎপাদন কমার পাশাপাশি গত বছর অনিয়মিত বৃষ্টি ও দেরিতে বন্যার পানি আসায় নদনদী থেকেও মাছের আহরণ কম হয়েছে। এছাড়া দেরিতে বৃষ্টি হওয়ায় খরাপ্রবণ অনেক অঞ্চলের পুকুরগুলোতেও এবারে মাছের উৎপাদন আশানুরূপ হয়নি।
মাছের চড়া দাম নিয়ে উদ্বেগের বিষয়ে মৎস্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মাহবুবুল হক বলেন, 'মাছের দাম বেশি হওয়ার মানে এই না যে উৎপাদন কম হয়েছে। দু-চারটা সমস্যা ছাড়া গণহারে মাছের উৎপাদন চাষিরা বন্ধ করেছেন, এমন তথ্য নেই।'