লোহিত সাগরে হুথিদের হামলা ইসরায়েলের অর্থনীতিকে কি ক্ষতিগ্রস্ত করছে?
গত বৃহস্পতিবার রাতে হুথি সশস্ত্র গোষ্ঠী নিয়ন্ত্রিত একাধিক স্থাপনায় বোমা হামলা চালিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য। হামলার পর বিদ্যমান সামরিক উত্তেজনা লোহিত সাগর থেকে ইয়েমেন পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে।
৩০ কিলোমিটার প্রশস্ত বাব-এল-মান্দেব প্রণালির মধ্য দিয়ে যাওয়া ইসরায়েলি সংযোগ থাকা একাধিক বাণিজ্যিক জাহাজে হামলা চালিয়েছে হুথিরা। তারা ইসরায়েলের কাছে গাজায় বোমা বর্ষণ বন্ধ এবং মানবিক সহায়তার অনুমতি দেওয়ার দাবি জানিয়েছে।
ইয়েমেনি গোষ্ঠীর ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন ঠেকানোর লক্ষ্যে লোহিত সাগরে ডেস্ট্রয়ার (এক ধরনের যুদ্ধ জাহাজ) ও অন্যান্য সামরিক শক্তি মোতায়েন করে হুথিদের নিবৃত্ত করার চেষ্টা করছে মার্কিন নেতৃত্বাধীন জোট। তবে হুথিরা স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে যে, ইসরায়েলের যুদ্ধ শেষ না হওয়া পর্যন্ত তারা হামলা বন্ধ করবে না। এখন পর্যন্ত ইসরায়েল-গাজা যুদ্ধে প্রায় ২৪,০০০ ফিলিস্তিনি মৃত্যুবরণ করেছেন।
এই সংঘাতের ফলে লোহিত সাগর দিয়ে যান চলাচল ৪০ শতাংশেরও বেশি কমে যাওয়ায় বৈশ্বিক পণ্য পরিবহনে ব্যাঘাত ঘটছে। লোহিত সাগরের নিয়মিত রুটের পরিবর্তে, শিপিং জাহাজগুলো আফ্রিকার দক্ষিণ প্রান্তে অবস্থিত কেপ অফ গুড হোপের চারপাশ দিয়ে চলাচল করছে। রুটের এই পরিবর্তনের ফলে অতিরিক্ত ৩,০০০-৩,৫০০ নটিক্যাল মাইল (প্রায় ৬,০০০ কিলোমিটার) যুক্ত হওয়ায় পণ্য সরবরাহে হচ্ছে বিলম্ব।
কী ঘটছে বিশ্বের অন্যতম ব্যস্ত সমুদ্রপথে?
গত নভেম্বরে ইসরায়েলি 'গ্যালাক্সি লিডার' জাহাজটি দখলের পর থেকে এ পর্যন্ত অন্তত ২৬টি জাহাজে হামলা চালিয়েছে হুথিরা। এই অঞ্চলে মার্কিন যুদ্ধজাহাজগুলো হুথিদের আরও বেশ কয়েকটি হামলা প্রতিহত করেছে।
সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী, গত বুধবার, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্য হুথিদের ছোড়া ক্ষেপণাস্ত্র এবং ড্রোন গুলি করে ভূপাতিত করেছে। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ গত বুধবার, হুথিদের এ হামলার তীব্র নিন্দা জানিয়েছে।
লোহিত সাগর সুয়েজ খালের মাধ্যমে এশিয়াকে ইউরোপ ও ভূমধ্যসাগরের সাথে সংযুক্ত করেছে। বর্তমানে, বিশ্বের প্রায় ১২ শতাংশ জাহাজ লোহিত সাগর দিয়ে চলাচল করে এবং প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৫০টি জাহাজ ৩০০ থেকে ৯০০ কোটি ডলারের মালামাল বহন করে। ধারণা করা হয়, বছরে এই পথ দিয়ে অন্তত এক ট্রিলিয়ন ডলারেরও বেশি পণ্য পরিবহণ হয়।
সব জাহাজ কি ক্ষতিগ্রস্ত হয়?
এ সপ্তাহের শুরুতে বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানিয়েছে, সংঘাতে তেলের ট্যাংকারগুলো কম ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং বেশি ক্ষতির শিকার হয়েছে কন্টেইনার জাহাজগুলো।
মেরিট্রেস থেকে প্রাপ্ত তথ্য থেকে জানা যায়, ডিসেম্বর মাসে গড়ে ৭৬ টি তেলবাহী জাহাজ লোহিত সাগরে অবস্থিত ছিল যা আগের মাসের গড়ের চেয়ে মাত্র দুটি কম। অন্যান্য ট্র্যাকারগুলোও জাহাজের সংখ্যা বৃদ্ধির কথা নিশ্চিত করেছে।
জানুয়ারির গোড়ার দিকে হুথি বিদ্রোহীরা ঘোষণা করেছিল যে, ওই এলাকা অতিক্রম করতে ইচ্ছুক কোনো জাহাজ যদি জলসীমায় প্রবেশের আগেই নিজেদের মালিকানা ও গন্তব্য ঘোষণা করে, তাহলে সেটিকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়া হবে না। এদিকে শিপিং কোম্পানি মায়ের্স্ক এবং হাপাগ-লয়েড বিদ্রোহী গোষ্ঠীর সাথে কোনও চুক্তিতে পৌঁছানোর বিষয়টি অস্বীকার করেছে।
হামলায় ইসরায়েলের অর্থনীতি কতটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে?
ডিসেম্বরের মাঝামাঝি পর্যন্ত ইসরায়েলের একমাত্র লোহিত সাগর বন্দর ইলাতে, হামলা শুরুর পর থেকে কার্যক্রম ৮৫ শতাংশ কমে গেছে।
মৃত সাগরের পটাশ কিংবা ডিসেম্বরের মাঝামাঝি পর্যন্ত ইসরায়েলের একমাত্র লোহিত সাগর বন্দর ইলাতে, হামলা শুরুর পর থেকে কার্যক্রম ৮৫ শতাংশ কমে গেছে। মৃত সাগরের পটাশ কিংবা চীনা উৎপাদিত বৈদ্যুতিক গাড়ির মত সব পণ্যই ইসরায়েলে হাইফা এবং আশদোদের ভূমধ্যসাগরীয় বন্দরের মধ্য দিয়ে চলাচল করে। তবে জাহাজ এবং নাবিক উভয়ের জন্য যথেষ্ট ঝুঁকির কারণে, চীনা রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ক্যারিয়ার কসকো, তার সহায়ক সংস্থা ওওসিএলসহ ইসরায়েলে চালান সাময়িকভাবে স্থগিত করেছে।
চীনা উৎপাদিত বৈদ্যুতিক গাড়ির মত সব পণ্যই ইসরায়েলে হাইফা এবং আশদোদের ভূমধ্যসাগরীয় বন্দরের মধ্য দিয়ে চলাচল করে। তবে জাহাজ এবং নাবিক উভয়ের জন্য যথেষ্ট ঝুঁকির কারণে, চীনা রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ক্যারিয়ার কসকো, তার সহায়ক সংস্থা ওওসিএল সহ ইসরায়েলে চালান সাময়িকভাবে স্থগিত করেছে।
মার্কিন নৌবাহিনীর সাবেক ক্যাপ্টেন এবং র্যান্ড কর্পোরেশনের ইনস্টিটিউট ফর সাপ্লাই চেইন সিকিউরিটির পরিচালক ব্র্যাড মার্টিন ইসরায়েলের সামনে থাকা চ্যালেঞ্জগুলোকে অতিরঞ্জিত না করার প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দিয়েছেন।
এক ই-মেইলে তিনি বলেন, "লোহিত সাগরের জাহাজ চলাচল ব্যাহত হওয়া এবং এমনকি কিছু জাহাজ ইসরায়েলি পণ্য পরিবহন বন্ধ করে দিলেও ইসরায়েলের অর্থনীতির অতটা ক্ষতি হবে না।"
মার্টিন বিশ্বাস করেন যে, ভূমধ্যসাগরের মধ্য দিয়ে জাহাজ চলাচল উল্লেখযোগ্য বাঁধা ছাড়াই অব্যাহত থাকবে। তিনি আরও উল্লেখ করেছেন যে, ইসরায়েল তার বেশিরভাগ প্রতিবেশীর দেশের তুলনায় ভালোভাবে যেকোনো নাজুক পরিস্থিতি মোকাবিলা করার সক্ষমতা রাখে।
তবে তিনি সতর্ক করে দিয়েছেন যে, কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক পদক্ষেপগুলো পণ্য পরিবহণ ও বাণিজ্যকে প্রভাবিত করতে পারে; যা ইসরায়েলকে অর্থনৈতিকভাবে বিচ্ছিন্নতার দিকে পরিচালিত করতে পারে।
দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব কী হতে পারে?
যদিও বিশ্লেষকরা একমত হয়েছেন যে, ইসরায়েলের অর্থনীতিতে হুথি বিদ্রোহীদের হামলার প্রত্যক্ষ প্রভাব সীমিত হয়েছে। তবে সংঘাত যত দীর্ঘস্থায়ী হবে, এর প্রতিক্রিয়াও বেশি দেখা যাবে।
ইসরায়েল বর্তমানে বিশ্ববাজারে তরল প্রাকৃতিক গ্যাসের (এলএনজি) অন্যতম রফতানিকারক হওয়ার লক্ষ্যে আছে। বৈশ্বিক এলএনজি বাজারে ইসরায়েলের প্রভাব তুলনামূলকভাবে কম থাকলেও এটি তার বাজার দখল বাড়ানোর জন্য কাজ করছে।
সুতরাং ইসরায়েল যে বিষয় নিয়ে চিন্তিত তা হল- রাজনৈতিক ও বাণিজ্যিক চ্যালেঞ্জগুলো ইসরায়েলকে নির্ভরযোগ্য এলএনজি রফতানিকারক হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করার ক্ষমতাকে প্রভাবিত করতে পারে।
রিস্ক কনসালটেন্সি এস-আরএমএর সহযোগী পরিচালক গ্যাব্রিয়েল রিড বলেন, "হামলার আগে (৭ অক্টোবর) ইসরায়েল একটি নির্ভরযোগ্য গ্যাস রফতানিকারক হওয়ার পথে ছিল। কিন্তু, শত্রুতা ইসরায়েলে ব্যবসা করার রাজনৈতিক ঝুঁকি বাড়িয়ে তুলেছে এবং বিশ্বব্যাপী প্রাকৃতিক গ্যাসের বাজারে পূর্ব ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের সম্ভাব্য ভূমিকার ওপর অনিশ্চয়তা সৃষ্টি করেছে।"
অন্যত্র কী প্রভাব পড়েছে?
ক্লার্কসন রিসার্চ সার্ভিসেস লিমিটেডের মতে, ডিসেম্বরের প্রথমার্ধ পর্যন্ত লোহিত সাগরের মধ্য দিয়ে জাহাজ চলাচল বর্তমানে ৪৪ শতাংশ কমেছে। কারণ উল্লেখযোগ্য সংখ্যক জাহাজ বন্দরে পৌঁছানোর জন্য বিকল্প কেপ অফ গুড হোপের রুট বেছে নিচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ ও এশিয়ার মধ্যে আটটি প্রধান রুটে শিপিং ট্র্যাক করা ড্রুরি ওয়ার্ল্ড কনটেইনার ইনডেক্স অনুসারে, চীন থেকে ইউরোপে ৪০ ফুট (১২ মিটার) কন্টেইনার পরিবহনের ব্যয় নভেম্বরে ১,১৪৮ ডলার থেকে ২৪৮ শতাংশ বাড়বে বলে আশা করা হচ্ছে।
ড্রুরির কন্টেইনার রিসার্চের সিনিয়র ম্যানেজার সাইমন হেনি আল জাজিরাকে বলেছিলেন যে, সামগ্রিক ব্যয় তিন থেকে ২১ শতাংশের মধ্যে যে কোনও জায়গায় বাড়তে পারে।
এছাড়া, বিঘ্নের কারণে সৃষ্ট বিলম্ব উন্নত অর্থনীতিতে 'জাস্ট ইন টাইম' উৎপাদনের জন্য একটি বড় সমস্যা। এই সিস্টেমটি পণ্যগুলোর প্রয়োজনের সময় সঠিকভাবে সরবরাহের ওপর নির্ভর করে এবং বাঁধাগুলো ব্যবসায়ের জন্য তাদের উৎপাদন সময়সূচি সামঞ্জস্য করা এবং বজায় রাখা কঠিন করে তোলে।
বিশ্ব অর্থনীতিতে কেমন প্রভাব ফেলেছে?
শিপিং ব্যয় এবং সময়সূচির পরিবর্তন চীন ও ভারতের মতো দেশগুলোর উৎপাদিত পণ্যগুলোর চাহিদাকে প্রভাবিত করতে পারে। মহামারি চলাকালীন জাহাজ চলাচল বিঘ্নিত হওয়ার কারণে বিশ্বব্যাপী মুদ্রাস্ফীতিতে এক শতাংশ বৃদ্ধি হবে বলে অনুমান করা হলেও অর্থনীতিবিদরা জানিয়েছেন, এই জাতীয় মুদ্রাস্ফীতির প্রভাব এখনও ঘটেনি।