প্রথমবারের মতো রেসাস বানরের ক্লোন বানালেন বিজ্ঞানীরা
চাইনিজ গবেষকরা প্রথমবারের মত রেসাস বানরের ক্লোন তৈরি করেছেন। এই ধরণের বানর চিকিৎসায় গবেষণার জন্য ব্যবহৃত হয় কারণ এদের সাথে মানুষের জনগত মিল পাওয়া যায়।
তারা জানিয়েছেন, তারা ওষুধের পরীক্ষার গতি আরো বাড়াতে পারবে কারণ জেনেটিক্যালি অভিন্ন প্রাণীরা তুলনামূলক ফলাফল দেয় যা গবেষণায় আরও সঠিক ফলাফল প্রদান করে।
এর পূর্বে রেসাস বানরকে ক্লোনিং করার যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল তাতে আশানুরূপ ফলাফল পাওয়া যায়নি কারণ এরা সন্তান জন্মদান করতে পারেনি অথবা এদের সন্তান খুব দ্রুত মারা গিয়েছিল।
একটি পশু কল্যাণ সংস্থার ভাষ্যমতে, এই ধরনের গবেষণা গভীর চিন্তার বিষয়।
স্তন্যপায়ী প্রাণীদের মধ্যে যৌন প্রজননের ফলে যে সন্তানের জন্ম হয় তার মধ্যে বাবা ও মায়ের জিনের মিশ্রণ থাকে। ক্লোনিং কৌশল ব্যবহারের মাধ্যমে একটি একক প্রাণীর জিনগতভাবে অভিন্ন অনুলিপি তৈরি করা হয়।
সবচেয়ে বিখ্যাত ক্লোনড প্রাণী ডলি নামক ভেড়াটিকে ১৯৯৬ সালে তৈরি করা হয়। বিজ্ঞানীরা অন্য ভেড়া থেকে একটি কোষকে ভ্রূণে পরিণত করার জন্য পুনঃপ্রোগ্রাম করেন যা ব্লক কোষ তৈরি করে। এই ব্লক কোষ প্রাণীর যেকোনো অংশে বৃদ্ধি পেতে পারে। এই ভ্রূণগুলি পরবর্তীতে ডলির সারোগেট মায়ের কোষে প্রতিস্থাপন করা হয়েছিল।
নেচার কমিউনিকেশনস জার্নালে লেখার সময় গবেষকরা জানিয়েছেন, তাঁরা একই কাজ করেছেন একটি রেসাস বানরের সাথে। তাঁরা বলেছেন, প্রাণীটি ২ বছরের বেশী সময় ধরে সুস্থ আছে যা নির্দেশ করে গবেষণাটি সফল হয়েছে।
চাইনিজ একাডেমি অফ সায়েন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. ফ্যালং লু বিবিসিকে বলেছেন, "এই ধরনের সফলতায় সবাই আনন্দিত।"
যুক্তরাজ্যের রয়্যাল সোসাইটি অফ ক্রুয়েলটি টু এনিমেলসের (আরএসপিসিএ) একজন মুখপাত্র বলেন, সংস্থাটি মনে করে পশুর দুর্ভোগ রোগীদের সুবিধা পাওয়ার বিষয়টাকে ছাড়িয়ে গেছে।
রেসাস বানর এশিয়ার আফগানিস্তান, ভারত, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম এবং চীনের বন্য অঞ্চলে পাওয়া যায়। তাদের গবেষণায় ব্যবহার করা হয় সংক্রমণ এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বোঝার জন্য।
২০১৮ সালে প্রথম ম্যাকাক বানরকে ক্লোন করা হলেও রেসাস বানরকেই চিকিৎসা গবেষণায় ব্যবহার করা হয় কারণ এদের সাথে মানুষের জিনগত মিল আছে।
ভ্রূণ হওয়ার জন্য প্রাপ্তবয়স্ক কোষগুলিকে ক্লোন করার এই পদ্ধতির সমস্যা হল, বেশিরভাগ প্রচেষ্টায় পুনরায় প্রোগ্রামিংয়ে ভুল করা হয়। ফলে বেশিরভাগ সময়েই প্রাণী জন্মায় না অথবা জন্মালেও সুস্থ থাকে না। স্তন্যপায়ী প্রাণীর ক্ষেত্রে এই সফলতার হার ১ থেকে ৩ শতাংশ। রিসাস বানরের ক্ষেত্রে এটা আরো কঠিন ছিল কারণ গবেষণা দল দুই বছর আগে প্রথমবারের মত সফল হয়েছে।
তারা আবিষ্কার করেন যে, রেসাস বানর ক্লোনিং করার প্রচেষ্টা শুরুতে ব্যর্থ হয় কারণ প্লাসেন্টাসকে ক্লোনিং প্রক্রিয়া দ্বারা সঠিকভাবে পুনঃপ্রোগ্রাম করা হয়নি। প্লাসেন্টাস ক্রমবর্ধমান ভ্রূণকে অক্সিজেন এবং পুষ্টি সরবরাহ করে। তাই ঠিকঠাক প্লাসেন্টাস প্রোগ্রামিং করতে না পারায় পূর্বের ভ্রুণগুলো স্বাভাবিকভাবে বিকশিত হয়নি।
গবেষকরা ১১৩টি টি ভ্রূণ ব্যবহার করেছিলেন যার মধ্যে ১১টি প্রতিস্থাপন করা হয়েছিল। এর মধ্যে দুটি ভ্রূণ গর্ভধারণ করাতে সক্ষম হয় এবং একটি সন্তান জন্ম দিতে সক্ষম হয়।
গবেষকরা 'ট্রফোব্লাস্ট রিপ্লেসমেন্ট' পদ্ধতি ব্যবহার করে বানরটি তৈরি করার জন্য এর নাম দিয়েছেন "রেট্রো"।
আরএসপিসিএ জানিয়েছে, তাদের গবেষণা সম্পর্কে ভুল ধারণা হয়েছিল। সংস্থাটির একজন মুখপাত্র বলেন, "এই গবেষণার ফলাফল এখনই কোন কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে না। আমরা আশা করি রোগীরা এই গবেষণা থেকে সুফল পাবে। কিন্তু বাস্তবে এর প্রয়োগ ঘটাতে এখনো কয়েক বছর লেগে যাবে। সম্ভবত আরও প্রাণীকে ব্যবহার করা হবে এই ধরনের প্রযুক্তির উন্নতি করার জন্য।"
তিনি আরও বলেন, "এই গবেষণার জন্য অনেক প্রাণী ব্যবহার করা হচ্ছে যারা বিভিন্ন ধরনের পরীক্ষা থেকে কষ্ট ও যন্ত্রণা পায়। আরএসপিসিএ এই সব ব্যাপারে চিন্তিত কারণ গবেষণায় অনেক প্রাণী ব্যবহার করা হলেও সফলার হার খুবই কম। প্রাইমেটরা খুব বুদ্ধিমান এবং সংবেদনশীল প্রাণী। এরা শুধু গবেষণার সরঞ্জাম নয়।"
লন্ডনের ফ্রান্সিস ক্রিক ইন্সটিটিউটের অধ্যাপক রবিল লভেল-ব্যাজ গবেষণার জন্য প্রাণীদের ব্যবহারকে সমর্থন করলেও অত্যধিক পরিমাণ প্রাণী ব্যবহার করার বিষয়টি তাকেও চিন্তিত করেছে।
তিনি বলেন, "জিনগত অভিন্ন প্রাণীদের ব্যবহার করে গবেষণায় হয়ত সঠিক ফলাফল পাওয়া সম্ভব। কিন্তু এত প্রাণী ব্যবহার করেও কাঙ্ক্ষিত সাফল্য পাওয়া যাচ্ছে না। তাদের অসংখ্যবার চেষ্টা করতে হয়েছে। তাদের অনেক ভ্রূণ ব্যবহার করতে হয়েছে এবং এখন পর্যন্ত একটি জীবিত প্রাণী পেতে তাদের অনেক সারোগেট মায়ের কোষে ভ্রূণ প্রতিস্থাপন করতে হয়েছে।"
বিজ্ঞানীরা যে শুধু একটি প্রাণী তৈরি করতে পেরেছে সেটা নিয়েও অধ্যাপক রবিল লভেল-ব্যাজ চিন্তিত। তিনি বলেন, "শুধু একটি প্রাণীর জন্ম থেকেই আপনি এই গবেষণাকে সফল বলতে পারেন না। এই রকম ধারণা করাই বোকামি। আপনাকে অন্তত দুই বা তার অধিক সাফল্য অর্জন করতেই হবে।"
এর জবাবে ড. ফ্যালং লু বিবিসিকে বলেছেন, গবেষণা দলটি ভ্রূণের ব্যবহার কমিয়ে দিয়ে আরও ক্লোনড বানর তৈরি করতে চায়। তিনি আরও জানান, গবেষণার জন্য সব ধরনের নৈতিক অনুমোদন নেওয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, "আমাদের গবেষণার জন্য কোন প্রাণী ব্যবহার করা হলে আমরা সাংহাই ইনস্টিটিউট অফ বায়োলজিক্যাল সায়েন্স, চাইনিজ একাডেমি অফ সায়েন্সেস (সিএএস) এবং নিউরোসায়েন্স ইনস্টিটিউটের প্রাণী ব্যবহার ও যত্ন সংক্রান্ত নীতিমালা মেনে চলি।"