ইরান ও পাকিস্তান কেন পরস্পরের ভূখণ্ডে হামলা চালাচ্ছে, মধ্যপ্রাচ্যে প্রভাব কী হবে?
পাল্টাপাল্টি ক্ষেপণাস্ত্র হামলার জেরে প্রতিবেশী দেশ পাকিস্তান ও ইরানের সম্পর্কের তিক্ততা চরমে পৌঁছেছে। এ ঘটনা মধ্যপ্রাচ্য এবং এর বাইরের অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে আরও ঘি ঢেলেছে।
দুই দেশের মধ্যে প্রায় ৯০০ কিলোমিটার (৫৬০ মাইল) বিস্তৃত সীমান্ত রয়েছে। যার একদিকে পাকিস্তানের বেলুচিস্তান প্রদেশ, আর অন্যদিকে ইরানের সিস্তান ও বালুচিস্তান প্রদেশ।
সীমান্তবর্তী বেলুচ অঞ্চলে দুই দেশই দীর্ঘদিন ধরে জঙ্গিদের বিরুদ্ধে লড়ছে। তবে দুই দেশেই অভিন্ন বিচ্ছিন্নতাবাদী শত্রু থাকলেও, একে অপরের ভূমিতে জঙ্গিদের ওপর হামলা চালানোর ঘটনা বিরল।
গাজা যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে 'প্রতিরোধের অক্ষ' তথা মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের মিত্র ও প্রক্সিগুলো ইসরায়েলি বাহিনী ও তার মিত্রদের ওপর হামলা চালানোর পর সর্বশেষ এই পাল্টাপাল্টি হামলার ঘটনা ঘটেছে।
এ বিষয়ে আরও কিছু খুঁটিনাটি তথ্য।
শুরুতে কী হয়েছিল?
মঙ্গলবার পাকিস্তানের বেলুচিস্তান প্রদেশে ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় দুই শিশু নিহত এবং বেশ কয়েকজন আহত হওয়ার মধ্যে দিয়ে সাম্প্রতিক ঘটনাক্রমের সূচনা হয়।
ইরান দাবি করেছে, পাকিস্তানের 'ইরানি সন্ত্রাসী গোষ্ঠী জইশ আল-আদল'কে লক্ষ্য করে হামলা চালানো হয়েছে। দেশটির কোনো নাগরিককে হামলার লক্ষ্যবস্তু করা হয়নি।
তবে নিজেদের ভূখণ্ডে এই হামলায় পাকিস্তান ক্ষুব্ধ হয় এবং এটিকে 'আন্তর্জাতিক আইন এবং পাকিস্তান ও ইরানের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের চেতনার গুরুতর লঙ্ঘন' বলে অভিহিত করে।
ইরানের রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা তাসনিম জানিয়েছে, তারা সুন্নি জঙ্গি গোষ্ঠী জইশ আল-আদলের ঘাঁটি লক্ষ্য করে হামলা চালিয়েছে।
জঙ্গি গোষ্ঠীটি ইরান-পাকিস্তান সীমান্তের উভয় পাশেই তৎপর এবং এর আগে একাধিকবার ইরানি সীমান্তরক্ষীদের ওপর হামলার দায় স্বীকার করেছিল তারা। ইরানের সিস্তান ও বালুচিস্তান প্রদেশের স্বাধীনতা তাদের মূল লক্ষ্য।
পরমাণু শক্তিধর পাকিস্তান সুন্নি সংখ্যাগরিষ্ঠ, অন্যদিকে ইরান ও তার সমর্থিত 'প্রতিরোধের অক্ষ' মূলত শিয়া।
এর দু'দিন পর ইরানের সিস্তান ও বালুচিস্তানের বেশ কয়েকটি বিচ্ছিন্নতাবাদী গোপন আস্তানায় 'সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে অত্যন্ত সমন্বিত, ধারাবাহিক ও নির্ভুল একটি সামরিক অভিযান' চালানোর কথা বলে পাল্টা হামলা চালায় পাকিস্তান।
বৃহস্পতিবারের হামলার তথ্য নিশ্চিত করে পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, তাদের হামলায় বেশ কয়েকজন জঙ্গি নিহত হয়েছে।
ইরানি কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ইসলামাবাদের সিরিজ হামলায় কমপক্ষে সাতজন নিহত হয়েছে। যাদের মধ্যে তিনজন নারী ও চারজন শিশু।
পাকিস্তান বহু বছর ধরে ইরানকে বিচ্ছিন্নতাবাদী সন্ত্রাসী গোষ্ঠীকে 'আশ্রয় ও মদদ' দেওয়ার জন্য অভিযুক্ত করে আসছে।
তারা জানায়, বৃহস্পতিবারের হামলার মাধ্যমে তারা বিষয়টিকে নিজেদের হাতে তুলো নিতে বাধ্য হয়েছে।
এখন কেন?
নিজ নিজ সীমান্তে সক্রিয় জঙ্গি গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে পাকিস্তান ও ইরানের লড়াই নতুন নয়। বছরের পর বছর ধরে গোলযোগপূর্ণ এই সীমান্তে নিয়মিতই প্রাণঘাতী সংঘর্ষ ঘটছে।
তবে একে অপরকে না জানিয়ে জঙ্গিদের লক্ষ্য করে পাকিস্তান ও ইরানের মধ্যে সামরিক পদক্ষেপ গ্রহণের ঘটনা এই প্রথম।
তবে এবারের ঘটনার শিকড় রয়েছে গাজায় ইসরাইলের বোমাবর্ষণের পটভূমিতে। ইসরায়েল ও তার মিত্র এবং গাজা ও তার মিত্রদের বিরোধের রেশ ক্রমে ওই অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বৃহত্তর আঞ্চলিক সংঘাত ইরানকে তার সীমান্তের বাইরের লক্ষ্যবস্তুতে হামলা চালানোয় আরও সক্রিয় হতে সাহায্য করবে।
পাকিস্তানে হামলার আগের দিন ইরাক ও সিরিয়ায় ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায় ইরান।
এ বিষয়ে ইরান দাবি করে, তারা ইসরায়েলি বাহিনী এবং 'ইরানবিরোধী সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোর' একটি গুপ্তচর ঘাঁটি লক্ষ্য করে হামলা চালিয়েছে।
এদিকে, লেবানন সীমান্তে ইসরায়েল ও ইরান সমর্থিত শক্তিশালী গোষ্ঠী হিজবুল্লাহর মধ্যে প্রচণ্ড লড়াই চলছে; আর যুক্তরাষ্ট্র ইয়েমেনে ইরান সমর্থিত হুতি বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে লড়াই করছে, যারা গাজায় ইসরায়েলি হামলার প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য লোহিত সাগরে জাহাজে হামলা চালিয়েছে।
কার্নেগি এনডাওমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল পিসের সিনিয়র ফেলো করিম সাজ্জাদপুর বলেন, ' যদি ইরান ও তার সমর্থকদের দমন না করা হয়...তাহলে তারা অবাধে এসব কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার উৎসাহ পাবে।'
তিনি আরও বলেন, ইয়েমেন ও সিরিয়ার মতো সংঘাতপূর্ণ দেশের তুলনায় মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের প্রভাবশালী অবস্থানের ফলে তারা আঞ্চলিক অস্থিতিশীলতা এবং 'ক্ষমতার শূন্যস্থান পূরণ' থেকে লাভবান হবে।
তিনি বলেন, ইরান এখন ফিলিস্তিনিদের ক্ষমতায়ন এবং মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন প্রভাব প্রতিহত করাসহ বেশ কয়েকটি প্রধান লক্ষ্যে তৎপরতা চালাচ্ছে।
ন্যাটোর সাবেক সর্বোচ্চ কমান্ডার ও মার্কিন সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল ওয়েসলি ক্লার্ক বলেছেন, এ অঞ্চলে নেতা হিসেবে ইরানের ভূমিকা সুদৃঢ় করার চেষ্টার প্রতিফলন ঘটেছে এসব হামলায়।
তিনি সিএনএনকে বলেন, 'তারা আঞ্চলিক আধিপত্য চাইছে।'
তিনি আরও বলেন, 'যাতে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইল মধ্যপ্রাচ্যে যে দেশের সঙ্গে সম্পর্ক রাখবে তার ওপর এবং ইসরাইল হামাসের বিরুদ্ধে অভিযান চালালে, ইরান তার ওপর পাল্টা আঘাত হানতে পারে।'
সীমান্ত সংঘাতের ফলাফল কী হবে?
পাকিস্তান, আফগানিস্তান ও ইরানে বেলুচ জনগোষ্ঠী বাস করে। দীর্ঘদিন ধরে তারা স্বাধীনতা অর্জনের জন্য লড়ছে এবং ইসলামাবাদ ও তেহরান উভয়ের ওপর তারা বিরক্ত।
গত কয়েক দশক ধরে দুই দেশের সীমান্ত অঞ্চল জুড়ে বিদ্রোহ তার প্রমাণ।
সংঘাতপূর্ণ এ অঞ্চলটি প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ। তবে বেলুচ জঙ্গিদের অভিযোগ, তারা আশেপাশের কয়েকটি অঞ্চলের তুলনায় দরিদ্র, কারণ বিপুল প্রাকৃতিক সম্পদের খুব কমই তারা আহরণ করতে পারে।
আয়তনের দিক থেকে পাকিস্তানের সবচেয়ে বড় প্রদেশ বেলুচিস্তানে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বেশ কয়েকটি প্রাণঘাতী হামলা হয়েছে। যা স্বাধীনতার দাবিতে কয়েক দশক ধরে চলা বিচ্ছিন্নতাবাদীদের বিদ্রোহে ইন্ধন জুগিয়েছে।
অন্যদিকে, ইরান তার কুর্দি, আরব ও বেলুচ সংখ্যালঘু বিদ্রোহীদের সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে লড়ছে।
জইশ আল-আদল ইরানের অভ্যন্তরে সক্রিয় অনেক বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীর মধ্যে একটি।
মার্কিন সরকারের ন্যাশনাল কাউন্টার টেরোরিজম সেন্টারের মতে, এটি মূলত জানদাল্লাহ নামে একটি বৃহত্তর সুন্নি জঙ্গি গোষ্ঠীর অংশ ছিল, ২০১০ সালে ইরান তাদের নেতার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার পরে যা ভেঙে যায়।
পরিবর্তে জইশ আল-আদল আবির্ভূত হয় এবং মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর এটিকে একটি বিদেশি সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে তালিকাভুক্ত করেছে।
ন্যাশনাল কাউন্টার টেররিজম সেন্টারের মতে, গোষ্ঠীটি প্রায়ই ইরানি নিরাপত্তা কর্মী, সরকারি কর্মকর্তা এবং শিয়া বেসামরিক নাগরিকদের লক্ষ্যবস্তু করে।
২০১৫ সালে এই গোষ্ঠীটি একটি হামলার দায় স্বীকার করেছিল, যাতে ৮ ইরানি সীমান্তরক্ষী নিহত হয়েছিল। সেসময় জঙ্গিরা পাকিস্তান থেকে ইরানে গিয়ে হামলা করেছিল বলে জানা গেছে।
এরপর ২০১৯ সালে সিস্তান-বেলুচিস্তানে ইরানি সামরিক বাহিনীর সদস্যদের বহনকারী একটি বাসে আত্মঘাতী বোমা হামলার দায় স্বীকার করে দেশটি।
পাকিস্তানে ইরানের হামলার একদিন পর বুধবার সিস্তান ও বালুচিস্তানে ইরানের একটি সামরিক যানে হামলার দায় স্বীকার করে জইশ আল-আদল।
এরপর কী ঘটবে?
মঙ্গলবারের হামলার জেরে ইরানের রাষ্ট্রদূতকে বহিষ্কার করেছে এবং ইরান থেকে নিজেদের রাষ্ট্রদূতকে প্রত্যাহার করেছে ইসলামাবাদ।
এছাড়া, প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে সব ধরনের উচ্চ পর্যায়ের সফর স্থগিত করেছে পাকিস্তান।
অন্যদিকে, তেহরানে নিযুক্ত পাকিস্তানের চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্সকে তলব করেছে ইরান।
পাকিস্তানের হামলার পর বৃহস্পতিবার ইরান তার প্রতিবেশীর কাছে 'তাৎক্ষণিক ব্যাখ্যা' দাবি করেছে বলে জানিয়েছে ইরানের রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা তাসমিন।
প্রতিবেশী দেশগুলো এ বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।
ভারত বলেছে, 'সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে ভারতের জিরো টলারেন্স' অবস্থান অটুট রয়েছে' এবং এটি 'ইরান ও পাকিস্তানের মধ্যকার বিষয়'।
চীন দুই পক্ষকে সংযম প্রদর্শনের এবং উত্তেজনা কমানোর আহ্বান জানিয়েছে।
বুধবার মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র ম্যাট মিলার বলেন, পুরো মধ্যপ্রাচ্য যাতে সংঘাতে জড়িয়ে না পড়ে ওয়াশিংটন সেজন্য কাজ করছে।
পাকিস্তান, ইরাক ও সিরিয়ায় তেহরানের হামলার প্রতি ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, আমরা গত কয়েকদিনে ইরানকে তার তিন প্রতিবেশী দেশের সার্বভৌম সীমানা লঙ্ঘন করতে দেখেছি।
যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘদিনের মিত্র পাকিস্তানের ইরানের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেওয়ার সম্ভাবনা সম্পর্কে জানতে চাইলে মিলার বলেন, 'আমরা আশা করি এই বিষয়টির শান্তিপূর্ণ সমাধান হবে।'
তবে, ইরানের মাটিতে পাকিস্তানের পাল্টা হামলা প্রমাণ করে, ইসলামাবাদ শুধু কূটনৈতিক প্রতিক্রিয়ার চেয়ে আরও বেশি কিছু দিয়ে জবাব দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
ইরান বা পাকিস্তান কেউই প্রতিবেশী দেশের বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীগুলোর বিরুদ্ধে সর্বশক্তি দিয়ে বিরোধে জড়াবে কি না, তা এখনও স্পষ্ট না।
উভয় পক্ষই তাদের হামলা-পাল্টা হামলার পরে বিবৃতি জারি করেছিল। যাতে দুই পক্ষই জটিলতা আর বেশি না বাড়ানোর আকাঙ্ক্ষার ইঙ্গিত দিয়েছিল।
পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ইরানকে একটি 'ভ্রাতৃপ্রতিম দেশ' হিসেবে অভিহিত করেছে এবং এর 'যৌথ সমাধান খুঁজে বের করার' প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দিয়েছে।
অন্যদিকে, ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ সপ্তাহের গোড়ার দিকে পাকিস্তানকে একটি 'বন্ধুত্বপূর্ণ দেশ' বলে অভিহিত করেছিলেন।
তিনি বলেছিলেন, তারা শুধুমাত্র জঙ্গিদের লক্ষ্য করে হামলা চালিয়েছে।