ক্ষমতা থেকে দূরে রাখা হলেও বন্দি ইমরান খানের জনপ্রিয়তা কমেনি
গত কয়েক বছর ধরে রাজনীতিতে খুব সুখকর অবস্থা যাচ্ছে না ক্রিকেটার থেকে রাজনীতিবিদ বনে যাওয়া ইমরান খানের। ২০২২ সালের এপ্রিলে অনাস্থা ভোটে তিনি হারিয়েছেন প্রধানমন্ত্রীর পদ। বর্তমানে রয়েছেন জেলবন্দী অবস্থায়।
ইমরান খানের বিরুদ্ধে দাঙ্গা থেকে শুরু করে সন্ত্রাসের অভিযোগে এখন পর্যন্ত ১৮০ টিরও বেশি অভিযোগ করা হয়েছে। এছাড়াও গত ৫ আগস্ট রাষ্ট্রীয় উপহার বিক্রির অভিযোগে দুর্নীতির দায়ে দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন দেশটির সাবেক এ প্রধানমন্ত্রী।
এদিকে গত ৮ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসছে, ইমরান খানের জনসমর্থন যেন ততই বাড়ছে। তবে তবুও ৭১ বছর বয়সী রাজনীতিবিদের প্রত্যাবর্তনের সম্ভাবনা যেন এখনও বেশ ক্ষীণ বলেই মনে হচ্ছে।
এক্ষেত্রে পেছন থেকে মূল কলকাঠি নাড়ছে সেনাবাহিনীর ক্ষমতাধর কর্মকর্তারা। নির্বাচনে ইমরান খান এবং তার দল তেহরিক-ই-ইনসাফ যাতে অংশ নিতে না পারে সেজন্য যেন সকল ক্ষেত্রই প্রস্তুত করা হচ্ছে।
এক্ষেত্রে গত কয়েক মাসে হাজার হাজার পিটিআই কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। দীর্ঘ জিজ্ঞাসাবাদের পর পার্টির কয়েক নেতা পদত্যাগ করেছেন। ইমরান খানের নাম মূলধারার মিডিয়া থেকে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। একইসাথে বিরোধীদের সুবিধার্থে নির্বাচনী এলাকার সীমানা পুনরায় নির্ধারণ করা হয়েছে। এমনকি ইমরান খানের মনোনয়নপত্রও বাতিল করা হয়েছে।
এ সম্পর্কে ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর মুসলিম স্টেটস অ্যান্ড সোসাইটির পরিচালক সামিনা ইয়াসমিন বলেন, "পাকিস্তানে নির্বাচন হতে যাচ্ছে সেটা সত্য। কিন্তু এখানে সত্যিকারের গণতান্ত্রিক নীতি অনুসরণ করা হচ্ছে তা নিয়ে আমার গভীর সন্দেহ আছে।"
এমনকি ইমরান খানের দলের কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া হচ্ছে তার আইকনিক প্রতীক ক্রিকেট ব্যাটও। গত সপ্তাহে নির্বাচন কমিশন ব্যালট পেপার থেকে পিটিআইয়ের ক্রিকেট ব্যাট প্রতীক নিষিদ্ধ করেছে। যা ৪০ ভাগ পর্যন্ত নিরক্ষর ভোটারের দেশটিতে দলটির জন্য বিরাট ক্ষতি।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, এটি কার্যকরভাবে পিটিআইকে একটি দল হিসাবে নির্বাচনে অংশ নিতে বাধা দিচ্ছে। অর্থাৎ দলটির প্রার্থীদের সম্ভবত স্বতন্ত্র হিসাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হবে। এক্ষেত্রে একই দলের নানা প্রার্থীরা রোলারকোস্টার থেকে ছাগল পর্যন্ত নানা প্রতীকে নির্বাচন করতে হবে।
পিটিআই-এর প্রধান মুখপাত্র এবং ইমরান খানের সাবেক বিশেষ সহকারী রওফ হাসান টাইম ম্যাগাজিনকে বলেন, "নির্বাচনী প্রতীক সুষ্ঠু নির্বাচনের একটি অবিচ্ছেদ্য উপাদান।"
পাকিস্তানি আইন প্রণেতারা সাংবিধানিকভাবে সংসদের নেতা এবং আর্থিক আইনসহ কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে দলের পক্ষে ভোট দিতে বাধ্য। কিন্তু পিটিআই-সমর্থিত প্রার্থীরা যদি আনুষ্ঠানিকভাবে স্বতন্ত্র হয়, তবে তারা এমন কোন বাধার মধ্যে থাকবেন না। যা পরবর্তীতে বিরোধীদের জন্য প্রলোভন দিয়ে ব্যক্তিদের টার্গেট করে একটি আলাদা পক্ষ তৈরি করার সুযোগ আরও বাড়িয়ে তোলে।
অন্যদিকে এমতাবস্থায় নির্বাচনের পর পিটিআই নারী ও সংখ্যালঘুদের জন্য সংসদীয় 'সংরক্ষিত আসন' এর সঠিক অনুপাত পেতে অযোগ্য বলে বিবেচিত হয়ে। এটি মূলত একটি নিবন্ধিত দলের সামগ্রিক ভোটের অনুপাত অনুসারে বরাদ্দ করা হয়।
এমনকি স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করাও পিটিআই নেতাকর্মীদের জন্য সহজ ছিল না। এক্ষেত্রে মনোনয়নপত্র দাখিল করতেও দলটির প্রার্থীদের বহু বাধা ও নিরাপত্তার সম্মুখীন হতে হয়েছে।
এমনকি দেশটির নিয়ম অনুসারে কাগজপত্র জমা দেওয়ার সাথে সাথে প্রতিটি প্রার্থীকে ব্যক্তিগতভাবে মনোনয়নের জন্য একজন প্রস্তাবক এবং সমর্থনকারীর প্রয়োজন হয়। অনেক ক্ষেত্রে একজন পিটিআই প্রার্থী তার কাগজপত্র উপস্থাপনের সাথে সাথে সেটি হাজির করতে পারেনি। কেননা আচমকা হয়তো ঐ ব্যক্তিকে 'অপহরণ' করা হয়েছে। ঠিক এভাবেই দলটির প্রার্থীদের শতকরা ৯০ শতাংশের মনোনয়নপত্র বাতিল করা হয়েছিল।। রওফ হাসান এটিকে ব্যাপক প্রাক-নির্বাচন কারচুপি বলে অভিহিত করেছেন।
এক্ষেত্রে ইমরান খান ও তার দলের মূল প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠেছেন নওয়াজ শরীফ। তিনি দেশটির তিনবারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী, যাকে ২০১৭ সালে দুর্নীতির দায়ে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়েছিল। একইসাথে তাকে ১০ বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়েছিল। তবে ২০১৮ সালে শরীফ চিকিৎসার জন্য জামিনে লন্ডনে যান এবং সেখানেই নির্বাসনে ছিলেন।
কিন্তু গত ২১ শে অক্টোবর অনেকটা শক্তি ও সমর্থন সঞ্চার করেই সুস্থ শরীফ পাকিস্তানে ফিরে আসেন। তখন তার দুর্নীতির দোষী সাব্যস্ততা দ্রুত বাতিল করা হয় এবং গত সপ্তাহে রাজনীতি থেকে তার আজীবন নিষেধাজ্ঞাও তুলে নেওয়া হয়।
গত সোমবার ৭৪ বছর বয়সী শরীফ টানা চতুর্থবারের মতো প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হতে প্রচারণা শুরু করেছেন। যা পিটিআই কর্মী-সমর্থকদের জন্য এক বেশ দুশ্চিন্তার কারণ।
এ বিষয়ে ইমরান খানের বোন আলিমা টাইম ম্যাগাজিনকে বলেন, "আগামী কয়েক সপ্তাহের মধ্যে যখন প্রার্থীরা সমাবেশ করতে বের হবেন তখন উত্তেজনা বাড়তে চলেছে। রাজপথে তখন ক্ষোভ থাকবে।"
এটা অনেকটাই প্রকাশ্য যে, পাকিস্তানের সামরিক শক্তি বর্তমানে শরীফকে পেছন থেকে সমর্থন দিচ্ছে। এটি তাকে ক্ষমতায় ফিরে আসার পথ সুগম করবে। কিন্তু খানের বেশ ভালো জনপ্রিয়তা থাকায় বিরোধী পক্ষের আরও শক্তিশালী কৌশলের প্রয়োজন হবে।
ক্ষমতায় থাকাকালীন পিটিআই-এর শাসন নিয়ে বহু সমালোচনা থাকলেও ডিসেম্বরের একটি গ্যালাপ জনমত জরিপ অনুযায়ী, কারাবন্দী খানকে সমর্থনের রেটিং ৫৭ ভাগে দাঁড়িয়েছে। যেখানে শরীফের পক্ষে সমর্থন ৫২ ভাগ। এক্ষেত্রে পিটিআই আত্মবিশ্বাসী যে, সুষ্ঠুভাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারলে তারা নির্বাচনে জিতবে।
এ সম্পর্কে ইমরান খান বলেন, "বিশেষ করে তৃণমূল পর্যায়ের মানুষেরা খুবই ইমরান খানপন্থী। এমনকি যদি তিনি যাকেই ভোট দিতে বলবেন, তিনিই নির্বাচিত হবেন।"
এক্ষেত্রে একটি বড় প্রশ্ন হল, কেন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এই ধরনের অনিয়মের মুখে এতটা নিশ্চুপ রয়েছে। বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যেখানে জো বাইডেন প্রশাসন গণতন্ত্রের প্রচারকে একটি প্রধান বৈদেশিক নীতির অগ্রাধিকার বলে দাবি করেছে।
এদিকে পারমাণবিক অস্ত্রে সজ্জিত পাকিস্তান ১৪০ বিলিয়ন ডলারের বাহ্যিক ঋণে জর্জরিত। এক্ষেত্রে বাস্তবতা হচ্ছে, রাশিয়া ও চীনের সাথে সম্পর্ককে অগ্রাধিকার দেওয়ার পর পশ্চিমে ইমরান খানের খুব কম বন্ধুই রয়েছে।
ওয়াশিংটন ডিসি-র উইলসন সেন্টারের দক্ষিণ এশিয়া ইনস্টিটিউটের পরিচালক মাইকেল কুগেলম্যান বলেছেন, "ওয়াশিংটনের দৃষ্টিকোণ থেকে যে কেউই খানের চেয়ে ভালো হতে পারে।"
বিপরীতে শরীফকে ব্যবসা-বান্ধব এবং আমেরিকাপন্থী হিসাবে দেখা হয়। আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহের পর ওয়াশিংটনের বৈদেশিক নীতির গুরুত্ব এখন চীন, ইউক্রেন এবং এখন গাজায় স্থানান্তরিত হয়েছে। তাই এখন দেশটির ইসলামাবাদে একজন বিশ্বস্ত মিত্রের প্রয়োজন।
এ বিষয়ে কুগেলম্যান বলেছেন, "নওয়াজ এবং সামরিক বাহিনীর মধ্যে অনেক খারাপ রক্ত রয়ে গেছে। এমনকি যদি তিনি পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী হন তবে বেসামরিক-সামরিক সম্পর্ক আরও খারাপের দিকে নিয়ে যেতে পারে।"
সর্বোপরি, পাকিস্তানের কোনো প্রধানমন্ত্রী কখনোই পূর্ণ মেয়াদ পূর্ণ করেননি। শরীফ যদি ফিরে আসেন, তবে খুব কম লোকই বাজি ধরবেন যে, চতুর্থবার তিনি প্রথম হবেন।
আলিমা খান বলেন, "তিনি জেলে চুপচাপ থাকলেও বেশ খুশি আছেন। সেখানে অনেকগুলি বই পড়েছেন। এই টালমাটাল সময়েও আধ্যাত্মিক, মানসিক এবং শারীরিকভাবে তিনি বেশ সন্তুষ্ট।"
সর্বশেষ হাসান বলেন, "আমরা নির্বাচনে থাকব। আমরা পিছিয়ে যাচ্ছি না, আমরা সরে যাচ্ছি না। আমরা সারা দেশে একটি আসনও হারাতে যাচ্ছি না।"