‘রুপি বিয়ার’ দুই ভাইয়ের কীর্তি, আমেরিকায় ভারতীয় বিয়ারের ফেরা!
ভ্যান ও সুমিত শর্মা ২০২০ সালের মার্চ মাসে উদ্বোধন করেন 'রুপি বিয়ার কোম্পানি'। তারা তাদের ব্রিউয়ারির (ভাটিখানা) নাম রাখেন তাদের বাবা মায়ের দেশ ভারতের মুদ্রার নামানুসারে। বোতলের মোড়ককে তারা ভারতীয় ডিজাইন দেন। তারা মূলত পোর্টল্যান্ডের ভারতীয় রেস্তোরাঁগুলোতে পরিবেশন করে তাদের এই বিয়ার। তবে আমেরিকান ক্রেতাদের কাছে এই বিয়ার নিয়ে রয়েছে অন্য ধরনের প্রত্যাশা।
সুমিত শর্মা বলেছেন, মানুষজন এসে তাদের আইপিএ বা ইন্ডিয়া পেইল অ্যাল খেতে চায়। আইপিএ যুক্তরাষ্ট্রের অন্যান্য বিয়ার তৈরির প্রক্রিয়াগুলোর মধ্যে অন্যতম জায়গা দখল করে আছে। শিকাগো ভিত্তিক বাজার বিশ্লেষক প্রতিষ্ঠান আইআরআই এর মতে, 'ক্র্যাফট' অংশে বিক্রির প্রায় ৪৬ শতাংশ দখল করে রেখেছে আইপিএ।
আইপিএ সাধারণত বেশ শক্তিশালী হলেও শর্মাদের এই 'রুপি' বিয়ারের স্বাদ বেশ হালকা। ভারতীয়রা সাধারণত আইপিএ থেকে লেগার বিয়ার খেতেই বেশি পছন্দ করে। ভারতীয়দের মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় দেশীয় বিয়ার হলো কিংফিশার। অন্যতম জনপ্রিয় ব্র্যান্ডগুলোর মধ্যে রয়েছে বাডউইজার অথবা হাইনেকেন।
তবে শর্মারা তাদের বিয়ারে ইচ্ছাকৃত ভাবেই 'যব' ব্যবহারের বদলে 'বাসমতি' চাল ব্যবহার করেছে। এ কারণেই অন্য বিয়ারগুলোর থেকে এটি তুলনামূলক বেশি মিষ্টি এবং হালকা লেগার জাতীয়। ভারতীয় খাবারের স্বাদের সাথে ভালোভাবে মানিয়ে যাবার জন্য বানানো হয়েছে রুপি বিয়ার।
অপরদিকে ইন্ডিয়া পেইল অ্যাল বা আইপিএ বিয়ার তার নামের সাথে একেবারেই মেলে না। বরং এটি ঔপনিবেশিক ব্রিটিশদের দক্ষিণ এশীয় রাজত্বের মূল জায়গাগুলোতে অবস্থিত সৈন্যদের জন্য রপ্তানি করা হতো। তবে শর্মা ভাইয়েরা নভেম্বরের দিপাবলীতে রুপির প্রথম ইন্ডিয়া পেইল অ্যাল বাজারে ছাড়ে। এর স্বাদ উপনিবেশগুলোতে পাঠানো ইংলিশ অ্যাল এর মতোই।
'রুপি' ব্র্যান্ডকে বাজারে পরিচিত করার জন্য এই বিয়ার বাজারে আনা হয়েছে। কিন্তু একই সাথে ভারত এবং ইংল্যান্ডের (যেখানে ভ্যানের জন্ম) সাথে সম্পর্ক থাকায় যুক্তরাষ্ট্রে ব্রিউয়ারি চালাতে হলে তাদের সংস্কৃতির এই অংশকে নিয়ে আসতেই হবে তা বুঝতে বেশি দেরি করেননি তারা। ভ্যান শর্মার মতে, তারা তাদের বিয়ায় ক্যানগুলোর মাধ্যমে তাদের সংস্কৃতির পাশাপাশি তাদের ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ইতিহাসও পৌঁছে দেয় সবার কাছে।
বর্তমানে যে বিয়ার প্রচলিত আছে তা মূলত ইউরোপের আবিষ্কার। সুমেরীয়রা ১০ হাজার বছর আগে মদ উদ্ভাবন করেছিল বলে মনে করা হয় এবং চীন থেকে দক্ষিণ-পশ্চিম মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পর্যন্ত প্রাচীন সভ্যতায় মদ বানানোর প্রমাণ রয়েছে।
কিন্তু সাধারণত যেসব লেগার, অ্যাল, পোর্টার এবং স্টাউট পান করা হয় তার অধিকাংশ তৈরি হয়েছে ইউরোপে। ভারতে এসব বিয়ার এসেছে উপনিবেশের মাধ্যমে।
১৭শ শতকের শুরুর দিকে ব্রিটিশরা তাদের দূর উপনিবেশগুলোতে বিয়ার পাঠানোর ক্ষেত্রে সমস্যার সম্মুখীন হয়। কয়েক মাসের সমুদ্রযাত্রা এবং এশিয়ার নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়ায় নষ্ট হয়ে যেত বিয়ার। তবে অ্যালকোহলের পরিমাণ বাড়ানোর মধ্য দিয়ে তা রোধ করা সম্ভব হয়। কিন্তু এই ব্যবস্থাও যথেষ্ট ছিল না বিয়ারের মান ধরে রাখার জন্য।
খাদ্য ও পানীয় বিষয়ক লেখক রুভানি ডি সিলভা বলেন, "সময়ের সাথে সাথে ভারতে আসা বিয়ার বিবর্তিত হতে থাকে। বিয়ারের প্রস্তুত প্রণালি আরো হালকা এবং উষ্ণ পরিবেশের জন্য উপযুক্ত করা হয়।"
এরপরও বোম্বে বা কলকাতায় পাওয়া অ্যাল সাধারণত একই ধরনের হতো। ব্রিটিশ বিয়ারের ইতিহাসবেত্তা এবং মারটিন করনেল এর মতে, এই বিয়ার "ভারতের জন্য পেইল অ্যাল" অথবা "পূর্ব এবং পশ্চিম ভারতের জন্য পেইল অ্যাল" নামেই প্রচলিত ছিল। ১৮৩৫ সালের দিকে ইষ্ট লন্ডনের 'বো ব্রিউয়ারি' এই বিয়ারকে "ইষ্ট ইন্ডিয়া পেইল অ্যাল" নামে নথিভুক্ত করে। এই বিয়ার ব্রিটেনে জনপ্রিয় হয়ে উঠলেও ভারতের সাধারণ মানুষের কাছে তেমন জনপ্রিয়তা পায়নি।
শর্মা ভাইয়েরা তাদের 'রুপি' আইপিএ বানানোর কাজ দেন পাগসলি ব্রিউয়িং প্রজেক্টস ইন্টারন্যশনালের অ্যালান পাগসলিকে। অ্যালান পাগসলির ১৯৮০ সালের দিকে দক্ষিণ ইংল্যান্ডের হ্যাম্পশায়ারের কাউন্টির বিখ্যাত রিংউড ব্রিউয়ারিতে কাজ করার নিজস্ব অভিজ্ঞতা আছে। তিনি তার অভিজ্ঞতা রুপি বিয়ার বানানোর ক্ষেত্র কাজে লাগান।
তার ভাষ্যমতে, তিনি তার ইংরেজ ঐতিহ্য এবং শর্মা ভাইদের ভারতীয় ঐতিহ্যের কারণে ঐতিহ্যবাহী ইংলিশ আইপিএ বানাতে চেষ্টা করেন। বিয়ার বানানোর এই পদ্ধতিটি যুক্তরাষ্ট্রে অন্যান্য পুরোনো পদ্ধতির মতোই হারিয়ে গিয়েছে।
৫.৬ শতাংশ অ্যালকোহলযুক্ত এই ইংলিশ ইন্ডিয়ান বিয়ার তেতো কিংবা খুব একটা শক্তিশালী নয়। মিষ্টি স্বাদের হালকা এই বিয়ারের মূল আকর্ষণ হলো এর বিশেষ সুগন্ধ। ভিন্দালো, চানা মাসালার মতো খাবারের সাথে পান করার জন্যই বানানো হয়েছে রুপি বিয়ার।
টোটাল ওয়াইন এবং অন্যান্য দোকান ছাড়াও রুপি বিয়ার পাওয়া যায় মূলত ১৪ ইষ্ট কোস্ট স্টেটস এর ভারতীয় রেস্তোরাঁগুলোতে। শর্মা ভাইয়েরা মনে করে, রুপি বিয়ার ইন্ডিয়া পেইল অ্যালে ভারতকে আবারো সামনে নিয়ে আসছে।
ডি সিলভার মতে, আইপিএকে ব্রিটিশ বা আমেরিকান ভাবার বিষয়টি এর সাথে উপমহাদেশের সম্পর্কের জায়গাটাকে হালকা করে দেয়। ভারতীয় উপমহাদেশে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের উপনিবেশ স্থাপন, এখানকার সম্পদ লুটপাটসহ আগ্রাসন এবং হত্যাজজ্ঞ চালানোর ইতিহাস বলে ইন্ডিয়া পেইল অ্যাল বা আইপিএ।
রুপি বিয়ার পাশ্চাত্যের বিয়ার স্থাপনার মুখোমুখি দাঁড়ায়। ব্রিউয়ারস অ্যাসোসিয়েশনের মতে, ক্রাফট ব্রিউয়ারির মাত্র ২ শতাংশের মালিক এশিয়ার নাগরিক।
আনকর্কড ওয়াইন এবং স্পিরিটসের মালিক অঙ্কিত দেসাই ওয়াশিংটন ডিসিতে তার প্রায় ৬টি দোকানে রুপি বিয়ার রাখেন। দক্ষিণ এশীয় ক্রেতা থাকায় রুপি বিয়ারের মতো ভারতীয় সংস্কৃতির সাথে সম্পর্ক আছে এমন ধরনের ব্র্যান্ডগুলোই তারা রাখতে পছন্দ করেন।
এসব কারণেই দিন দিন জনপ্রিয়তা বাড়ছে রুপি বিয়ারের। একমাসের মাথায় বিক্রি হয়ে গেছে তাদের আইপিএ-র সকল অর্ডার। এই জনপ্রিয়তার কারণেই তাদের আসল লেগারের সাথে দীপাবলির জন্য বিশেষ আইপিএ আনার কথা ভাবছে শর্মা ভাইয়েরা।
রুপি বিয়ার শুধু আমেরিকার বিয়ারের সাথে ভারতীয় সংস্কৃতিকেই মেলাচ্ছে না, রুপি বিয়ারের মাধ্যমে দক্ষিণ এশীয়রা তাদের ব্যবহৃত পন্যের মাঝে খুঁজে পাচ্ছে নিজেদের।