রাখাইনে মিয়ানমারের সামরিক জান্তার বাঁচা-মরার লড়াই!
মিয়ানমারের সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে অভূতপূর্ব সাফল্য পেয়েছে জাতিগত বিদ্রোহীদের জোট– থ্রি ব্রাদারহুড এলায়েন্স। যদিও গত কয়েক মাসে দেশটির উত্তরপূর্বাঞ্চলে তারা যে গতিতে অগ্রসর হয়েছিল– তা অনেকটাই স্তিমিত হয়ে পড়েছে। এই অবস্থায়, মিয়ানমারের গৃহযুদ্ধের কেন্দ্রভূমিতে সরে গেছে পশ্চিম সমুদ্র উপকূলের রাখাইন প্রদেশে। যেখানে জান্তা সেনাদের বিরুদ্ধে লড়ছে আরাকান আর্মি।
২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে অভ্যুত্থানের মাধ্যমে নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী। এরপর গণতন্ত্রকামী বিক্ষোভকারীদের নির্মমভাবে দমন করা হয়। শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভে অতিরিক্ত বলপ্রয়োগের ঘটনায়– গণতন্ত্রকামীরা হাতে অস্ত্র তুলে নেয়। দীর্ঘদিন ধরে মিয়ানমারের জাতিগত যেসব সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠী মিয়ানমারের কেন্দ্রীয় শাসনের বিরুদ্ধে লড়াই করছে, তাদের কাছে গিয়ে প্রশিক্ষণ নিতে থাকে। ফলে ফেব্রুয়ারি মাস চলমান গৃহযুদ্ধের জন্য প্রতীকী অর্থেও তাৎপর্যের।
আগামী মে মাসে মিয়ানমারে শুরু হবে বর্ষাকাল। যা যুদ্ধের অনুকূল নয়। তার আগের কয়েক মাসে রাখাইনে লড়াই তীব্র হয়ে উঠতে পারে। যা এই প্রদেশের নিয়ন্ত্রণের চূড়ান্ত ফয়সালাও হয়তো করবে।
জাতিগত বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মি– থ্রি ব্রাদারহুড জোটের অংশ। গত বছরের নভেম্বর ও ডিসেম্বর মাসে ব্যাপক এক অভিযানের মাধ্যমে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর বহু ঘাঁটি দখল করেছে এই জোট। উত্তরপূর্বাঞ্চলের শান রাজ্যে জোট বাহিনীর এই সফলতার পুনরাবৃত্তি এখন রাখাইন রাজ্যে করতে চায় আরাকান আর্মি। যার মাধ্যমে রাখাইন থেকে জান্তা শাসনকে পুরোপুরি উৎখাতের উদ্দেশ্য তাদের।
সামরিক অভ্যুত্থানের মাস কয়েক আগে– ২০২০ সালের নভেম্বরে মিয়ানমার সরকারের সাথে একটি যুদ্ধবিরতির চুক্তি করেছিল আরাকান আর্মি। কিন্তু, ২০২৩ সালের নভেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে তারা আবারো লড়াইয়ে ফিরে আসে।
রাখাইনে রাজ্যের লড়াই বিভিন্ন দিক দিয়েই গুরুত্বপূর্ণ। আগামী সপ্তাহ বা মাসগুলোতে আরাকান আর্মি যদি তাঁদের বর্তমান সাফল্যের ধারা অব্যাহত রাখতে পারে, এবং এই প্রদেশের অধিকাংশ এলাকা পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে নিতে পারে– তাহলে দুর্বল হয়ে পড়বে জান্তা সরকারের অবস্থান।
বঙ্গোপসাগর তীরের রাখাইন রাজ্যের সাথে মিয়ানমারের বামার জাতিগোষ্ঠী অধ্যুষিত 'হার্টল্যান্ডের' নৈকট্য রয়েছে। ফলে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই রাজ্যের নিয়ন্ত্রণ হারানোর অর্থ– জান্তা সরকারের রাষ্ট্রীয় প্রশাসনিক পরিষদ– স্টেট অ্যাডমিনিস্ট্রেশন কাউন্সিল (এসএসি) এর পরাজয়। কৌশলগত দিক দিয়ে, রাখাইনে পরাজিত হলে পুরো গৃহযুদ্ধে তারা হেরে গেছে বলে প্রতীয়মান হবে।
মিয়ানমারের কেন্দ্রীয় অঞ্চলকে হার্টল্যান্ড বলার কারণ, সেখানে বামার জাতিগোষ্ঠীগুলো সংখ্যাগরিষ্ঠ। সেখানে আরো কয়েক মাস হয়তো বিদ্রোহী তৎপরতা চলবে। কিন্তু, রাখাইন হারানোর অর্থ হতে পারে নেপিডোর শাসকদের পতন দ্রুততর হওয়া। এমনকী বামারদের মধ্যে জান্তার বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রাম বাড়তে পারে। এতে সেনা শাসকদের মধ্যে অভ্যন্তরীণ কোন্দল শুরু হতে পারে, এই ঘটনাও তাদের অনিবার্য পতনের দিকে নিয়ে যাবে।
তবে বর্ষা আসার আগে আরাকান বাহিনীর সাথে লড়াই করে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী একটি অচলাবস্থা তৈরি করতে পারলে– সে অবসরে গুরুত্বপূর্ণ সামরিক ও কূটনৈতিক সুবিধা পাবে জান্তা সরকার। ডুবন্ত জান্তা সরকারের জন্য যেটি হবে 'লাইফলাইন'। এতে ২০২৫ সাল পর্যন্ত তাঁদের টিকে থাকা নিশ্চিত হতে পারে।
মিয়ানমারের জান্তাকে বিমান, নৌবাহিনী ও গোলন্দাজ শক্তির সাহায্যে রাখাইনের প্রধান প্রধান শহুরে জনপদের নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে হবে। একইসঙ্গে বিদ্র্যোহীদের বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে তাঁদের ব্যাপক সংখ্যায় হতাহত করতে হবে। যেমনটা ২০১৯ ও ২০২০ সালে তারা রাখাইনে করেছিল।
দৃঢ়প্রত্যয়ী বিদ্রোহীরা
আরাকান আর্মির নেতৃত্বে রয়েছেন ৪৫ বছরের তন ম্রাত নাইং। সামরিক নেতৃত্বে তাঁকে সুদক্ষ মনে করেন পর্যবেক্ষকরা। তাঁর নেতৃত্বে আরাকান আর্মি বেশকিছু ক্ষেত্রে সুবিধাজনক অবস্থানে থেকেই সাম্প্রতিক লড়াই শুরু করেছে। উত্তরাঞ্চলে বিদ্রোহীদের সাফল্য থেকে অনুপ্রাণিত হয়েছে এর সদস্যরা।
উত্তরের প্রদেশগুলোয় আরাকান আর্মির রয়েছে প্রশিক্ষণ ঘাঁটি। যেখান থেকে ২০১৪ থেকে ২০১৬ সালে তাঁরা রাখাইনে অনুপ্রবেশ শুরু করে। এসময় তারা স্থানীয় জনতার ব্যাপক সমর্থন লাভ করে। এরপরে ২০২০ সালের নভেম্বর থেকে ২০২৩ সালের নভেম্বর পর্যন্ত কেন্দ্রীয় সরকারের সাথে তিন বছর যুদ্ধবিরতি কার্যকর থাকার ঘটনাতেও সুবিধা পেয়েছে তাঁরা।
যুদ্ধবিরতি কার্যকর থাকায় সময় আরাকান আর্মির রাজনৈতিক শাখা ইউনাইটেড লীগ অব আরাকান (ইউএলএ) গ্রামীণ এলাকাগুলোয় তাঁদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার সুযোগ পায়। এসব এলাকায় কেন্দ্রীয় সরকারের সমান্তরালে নিজস্ব প্রশাসনিক কাঠামোও গড়ে তোলে।
প্রশাসনিক এই ব্যবস্থাকে কাজে লাগিয়ে তাদের সশস্ত্র শাখা নতুন সদস্যদের ভর্তি ও প্রশিক্ষণ শুরু করে। সরকারি সেনাদের সাথে লড়াইয়ে যেসব সদস্য নিহত হন, তাঁদের ঘাটতি এভাবে পূরণ করে– বাহিনী পুনর্গঠন করা হয়।
এসব কারণে কাচিন ইনডিপেন্ডেন্স আর্মি (কেআইএ)-র পাশাপাশি আরাকান আর্মিকে মিয়ানমারের সবচেয়ে ভালোভাবে সংগঠিত ও কার্যকর বিদ্রোহী গোষ্ঠী বলে বিবেচনা করা হয়। কিন্তু, সামনের দিনগুলোয় রণাঙ্গনে তাঁদের কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখি হতে হবে। রসদ ও ভারী অস্ত্র স্থানান্তরের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে বিজয়ের জন্য। তাঁরা যদি রাখাইনে জান্তার অনুগত সেনাদের উদ্দেশ্য ব্যর্থ করতে পারে– তবেই বার্মা নামের সাবেক এই ব্রিটিশ কলোনিতে সেনা শাসকদের চূড়ান্ত দুর্দিনের সূচনা হবে।
পরিমার্জিত অনুবাদ: নূর মাজিদ
বিশেষ দ্রষ্টব্য: নিবন্ধের বিশ্লেষণটি লেখকের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও পর্যবেক্ষণের প্রতিফলন। অবধারিতভাবে তা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-এর অবস্থান বা সম্পাদকীয় নীতির প্রতিফলন নয়।