মহামারির মোকাবিলায় সফল যে চার দেশের সরকারপ্রধান নারী
নির্মোহ দৃষ্টিকোণ থেকে নেতৃত্বের সংজ্ঞা নির্ধারণ করা কঠিন একটি ব্যাপার। কিন্তু এই কঠিন বিষয়টিই বেশ সহজ হয়ে যায় সংকটে কিংবা দুর্যোগে। সবার সামনেই পরিষ্কার হয়ে যায় কোন নেতা কতোটা দারুণভাবে সংকটের মোকাবিলা করেন, নেতৃত্বের দুর্দমনীয় শক্তি দিয়ে নিজের দেশ ও দেশের মানুষকে রক্ষা করেন।
বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়া মহামারি করোনাভাইরাসের কারণে ক্ষমতাধর কিংবা বিশ্ব অর্থনীতিকে নিয়ন্ত্রণে রাখা শীর্ষ দেশগুলো যেমন নাকাল হচ্ছে তেমনি বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে তৃতীয় বিশ্বের গরীব দেশগুলোও। ক্ষমতা কিংবা সমৃদ্ধ অর্থনীতি কোনোটিই করোনার মতো এই মহাদুর্যোগকে রুখে দিতে পারেনি। একটা জিনিসই করোনাকে রুখতে পেরেছে, সেটি হলো প্রাণঘাতী এই ভাইরাসকে মোকাবিলার কৌশল।
করোনাভাইরাসের সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে আনতে যে কয়টি দেশ এখন পর্যন্ত সফল কিংবা মোটামুটি সফল, একটু খেয়াল করলেই দেখা যায় এই দেশগুলোতে মহামারির মোকাবিলায় নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছেন নারীরা।
বিশ্ব রাজনীতির নিয়ন্ত্রকের দাবিদার বিশ্বের এক নম্বর ক্ষমতাধর রাষ্ট্র যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন, যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন, চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং, ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমান্যুয়েল ম্যাক্রোঁ, ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট জাইর বলসোনারো বা বাংলাদেশের প্রতিবেশী ক্ষমতাধর দেশ ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি যখন নিজ নিজ দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকিয়ে রাখতে অনেকক্ষেত্রেই ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন, সেখানে করোনা মোকাবিলা করে প্রাণঘাতী এই ভাইরাসের সংক্রমণ নিজেদের দেশে অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এসেছেন নিউজিল্যান্ডের ইতিহাসে প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী জেসিন্ডা আরডন, জার্মানির চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মেরকেল, তাইওয়ানের প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট সাই ইং ওয়েন বা ডেনমার্কের ইতিহাসের সবচেয়ে কনিষ্ঠ নারী প্রধানমন্ত্রী মিতে ফ্রেডিরিকসেন।
বিশ্বজুড়ে নারীস্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করা প্রতিষ্ঠান উইমেন লিফট হেলথ'র সাম্প্রতিক একটি ওয়েবিনার থেকে বলা হয়, "করোনা মোকাবিলায় যেসব দেশে নারী নেতৃত্ব রয়েছে তারাই সবচেয়ে বেশি সফল।"
ওই কনফারেন্সে বক্তারা বলেন, এই নারী নেতারা মহামারির মোকাবিলায় দেশের মানুষের স্বার্থে সহানুভূতি, সমবেদনা, প্রস্তুতি জ্ঞান, সমন্বয়ের সামর্থ্য এবং কৌশল নির্ধারণ করার আগে গভীর মনোযোগ দিয়ে তা শুনেছেন এবং বাস্তবায়ন করেছেন।
এ বিষয়ে হার্ভাড কেনেডি স্কুলের পাবলিক পলিসির লেকচারার জো মার্কস বলেন, "এটা দেখে মনে হচ্ছে, নিজেদের অনুসারী এবং দেশের মানুষকে অনুপ্রেরণা দেওয়ার সামর্থ্য নারীদের মধ্যেই বেশি।"
তিনি আরও বলেন, নেতৃত্বের ক্ষেত্রে নারীদের মধ্যে অংশগ্রহণমূলক ও গণতান্ত্রিক চর্চার আগ্রহ অনেক বেশি থাকে যার ফলে তাদের কাজগুলো বেশি কার্যকরী হয়।
নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী জেসিন্ডা আরডান
করোনার পরিসংখ্যান নিয়ে কাজ করা ওয়েবসাইট ওয়ার্ল্ডোমিটারের তথ্য অনুযায়ী, অস্ট্রেলিয়া মহাদেশের দ্বীপরাষ্ট্র নিউজিল্যান্ডে এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন মাত্র ১,৫২৮ জন নাগরিক যার মধ্যে সুস্থ হয়ে গেছেন ১,৪৮৪ জন। এই ভাইরাসে দেশটিতে মৃত্যু হয়েছে ২২ জনের। সপ্তাহ তিনেক আগে নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী জেসিন্ডা আরডান তার দেশকে করোনামুক্ত ঘোষণা করলেও কয়েকদিন পর সেখানে আক্রান্ত নতুন রোগী শনাক্ত হয়। তবে করোনা মোকাবিলায় এখন পর্যন্ত বিশ্বের যে কয়টি দেশ সফল তাদের মধ্যে নিউজিল্যান্ডের স্থানে উপরের দিকে।
মূল ভূখণ্ডের আশপাশে প্রায় ৬০০ দ্বীপ দিয়ে ঘেরা দেশ নিউজিল্যান্ডের জাতীয় অর্থনীতির অনেকটাই ট্যুরিজম ব্যবসা যোগান দেয়। তবে দেশের মানুষের স্বাস্থ্যকে প্রাধান্য দিয়ে প্রধানমন্ত্রী জেসিন্ডা ১৯ মার্চ দেশের সীমানা বিদেশীদের জন্য বন্ধ করে দেন এবং ২৩ মার্চ দেশকে চার সপ্তাহের জন্য লকডাউন করেন। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য কেনা বা কাছাকাছি ব্যায়ামাগারে যাওয়া ব্যতীত অন্যান্য ক্ষেত্রে জনগণকে বাড়িতে থাকার নির্দেশ দেন তিনি। নিজ দেশে কোভিড-১৯ এর ব্যাপক পরীক্ষাও চালু করেন, যার ফলাফল বর্তমান এই সাফল্য।
জার্মানির চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মেরকেল
ওয়ার্ল্ডোমিটার বলছে ইউরোপের বিশাল দেশ জার্মানিতে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন ১ লাখ ৯৫ হাজার ৮৩২ জন যার ভেতর ইতোমধ্যেই সুস্থ হয়েছেন ১ লাখ ৭৯ হাজার ৮০০ জন। এই মহামারিতে ৯ হাজার ৫২ জনের প্রাণ গেছে তবে নতুন করে সংক্রমণের মাত্রা বর্তমানে একেবারেই কম। জার্মানির চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মেরকেল তার দক্ষ নেতৃত্বে নিজ দেশে সংক্রমণ অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে এনেছেন।
অথচ জার্মানীর মতোই অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ ইউরোপের অন্য চারদেশ যুক্তরাজ্য, স্পেন, ইতালি ও ফ্রান্সে মৃত্যুর সংখ্যা কয়েকগুণ বেশি। ওই চারটি দেশেরই সরকার প্রধানরা পুরুষ। করোনাভাইরাসে এ পর্যন্ত যুক্তরাজ্যে ৩ লাখ ১৩ হাজার মানুষ আক্রান্ত হয়েছেন যার মধ্যে মারা গেছেন ৪৩ হাজার ৯০৬ জন। স্পেনে আক্রান্ত হয়েছেন ২ লাখ ৯৬ হাজার ৩৫১ যার মধ্যে মারা গেছেন ২৮ হাজার ৩৫৫ জন। ইতালিতে আক্রান্তের সংখ্যা ২ লাখ ৪০ হাজার ৪৬০ জন যার মধ্যে মারা গেছেন ৩৪ হাজার ৭৮৮ জন। ফ্রান্সে জার্মানীর চেয়ে কম ১ লাখ ৬৪ হাজার মানুষ আক্রান্ত হলেও সেখানে মৃত্যুর সংখ্যা জার্মানীর তিনগুণেরও বেশি ২৯ হাজার ৮৮৩ জন।
অ্যাঙ্গেলা মেরকেলের সরকার প্রতি সপ্তাহে দেশে ৩৫ লাখ নমুনা পরীক্ষা করেছে; রোগীদের কার্যকরভাবে আলাদা করতে এবং চিকিৎসা করার জন্য দ্রুত ভাইরাস শনাক্ত করেছে। জার্মানিতে সবচেয়ে বেশি আইসিইউ এবং ইউরোপেরর মধ্যে সবচেয়ে বড় স্কেলে করোনাভাইরাস পরীক্ষা কার্যক্রম রয়েছে।
হাইডেলবার্গ ইউনিভার্সিটি হাসপাতালের ভাইরোলজি বিভাগের প্রধান হ্যান্স-জর্জ ক্রুসাল্লিচকে বলেছেন, "জার্মানিতে আমাদের সবচেয়ে বড় শক্তি জনগণের কাছে সরকার যে আস্থা অর্জন করছে, তার সঙ্গে সরকারের উচ্চ স্তরের যৌক্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ।"
ব্লুমবার্গের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, একজন কোয়ান্টাম কেমিস্ট হিসেবে সংক্রামক বিশেষজ্ঞদের পরামর্শে অসাধারণ সব কর্মকৌশল নিয়ে এই মহামারির বিরুদ্ধে অ্যাঞ্জেলা মেরকেল একজন 'বিজ্ঞানীর মতো' লড়াই করেছেন। জরিপে দেখা যায়, ৭১ শতাংশ অংশগ্রহণকারীর সায় নিয়ে পুনরায় জার্মানীর সবচেয়ে জনপ্রিয় রাজনীতিবিদের জায়গাটি দখল করেছেন ৬৫ বছর বয়সী এ নারী।
তাইওয়ানের প্রেসিডেন্ট সাই ইং ওয়েন
বুধবার সন্ধ্যা পর্যন্ত ওয়ার্ল্ডোমিটারের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, চীনের নিয়ন্ত্রণে থাকা আড়াই কোটি জনসংখ্যার দেশ তাইওয়ানে আক্রান্ত হয়েছে মাত্র ৪৪৭ জন। ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে ৭ জনের প্রাণ গেলেও সুস্থ হয়ে উঠেছেন ৪৩৮ জন। পুরো দেশে চিকিৎসাধীন আছেন মাত্র দুজন রোগী, নতুন করে সংক্রমণেরও কোনো খবর নেই।
দেশটির প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট সাই ইং ওয়েন সরকারের প্রাথমিক পদক্ষেপগুলোর কারণেই করোনভাইরাসকে এত সফলভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছে তারা। গত ২০ মে নিজ দেশকে সংক্রমণমুক্ত ঘোষণা করেন প্রেসিডেন্ট সাই।
মূল ভূখণ্ড চীন থেকে বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়া এই মহামারি অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ ছিলো তাইওয়ানের জনগণের জন্য, কিন্তু প্রেসিডেন্ট সাই এর সুদক্ষ কৌশলের কারণে তা হয়নি। গত বছরের ডিসেম্বরে যখন উহানের নাগরিকদের একটি রহস্যজনক নতুন ভাইরাসে সংক্রামিত হওয়ার কথা শুনেছিলেন, তৎক্ষণাৎ উহান থেকে আগত সব বিমানের যাত্রীদের পরীক্ষা করার নির্দেশ দেন তিনি। এরপর তিনি একটি মহামারি কমান্ড সেন্টার স্থাপন করেন, মুখের মাস্ক ও ব্যক্তিগত সুরক্ষামূলক সরঞ্জামাদি তৈরি করেন এবং মূল ভূখণ্ড চীন, হংকং এবং ম্যাকাওয়ে আসা-যাওয়ার সমস্ত ফ্লাইটকে সীমাবদ্ধ করেন। ফলাফল হিসেবে করোনা মোকাবিলায় সাই ইং ওয়েন এর দেশ সফল। বর্তমানে তারা ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং অন্যদের সহায়তার জন্য লক্ষ লক্ষ মাস্ক রপ্তানি করছে।
ডেনমার্কের প্রধানমন্ত্রী মিতে ফ্রেডিরিকসেন
ওয়ার্ল্ডোমিটারের তথ্য অনুযায়ী ইউরোপের দেশ ডেনমার্কের প্রায় ৫৮ লাখ জনসংখ্যার মধ্যে কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত হয়েছেন ১২ হাজার ৭৬৪ জন। মহামারিতে ৬০৫ জন মারা গেলেও সুস্থ্ হয়ে উঠেছেন ১১ হাজার ৬৪৯ জন। ৫১৪ জন চিকিৎসাধীন থাকলেও নতুন করে সংক্রমণের মাত্রা খুবই কম।
ইউরোপের দেশগুলোতে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পরও যখন অনেক প্রতিবেশী দেশই সিদ্ধান্ত নিতে পারছিল না তখন ১৩ মার্চ ডেনমার্কের প্রধানমন্ত্রী মিতে ফ্রেডিরিকসেন তার দেশের সীমানা বন্ধ করে দেন। এর কয়েকদিনের মাথায় তিনি দেশের ভেতরে সমস্ত কিন্ডারগার্টেন, স্কুল, বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে দেন এবং কোনো স্থানে ১০ জনের বেশি জমায়েত নিষিদ্ধ করেন।
ডেনমার্কের ইতিহাসের সবচেয়ে কনিষ্ঠ এই প্রধানমন্ত্রীর কঠোর এবং দারুণ পদক্ষেপের কারণেই ইউরোপের অন্যান্য দেশের মতো ডেনমার্কে মহামারি ছড়িয়ে পড়তে পারেনি। ডেনমার্কের হাসপাতালগুলোতেও করোনায় আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা দিনদিন কমছে এবং ধীরে ধীরে স্বাভাবিক জীবনে ফিরছে দেশটি।
দ্য গার্ডিয়ানের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ডেনমার্কের এই সফল রাষ্ট্রনেতার কাজের ভূয়সী প্রশংসাও করেছে দেশটির জনগণ। মে মাসের একটি জরিপে অংশ নেওয়া দেশটির ৭৯ শতাংশ নাগরিক মনে করেন, করোনাভাইরাসের মোকাবিলায় তাদের প্রধানমন্ত্রী দারুণভাবে কাজ করে যাচ্ছেন।