জীবন ও প্রেম কোনোটাই আদতে রূপকথা নয়
আমাদের জীবনে একটা সময় ছিল যখন প্রেম-ভালবাসা মানেই শরৎচন্দ্রের দেবদাস, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শেষের কবিতা, বুদ্ধদেব বসুর রাতভর বৃষ্টি, আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের আমি সে ও সখা, বঙ্কিমচন্দ্রের কপালকুন্ডলা এসব উপন্যাসের কথা মনে হতো। স্কুল-কলেজে পড়ার সময় এই ধরনের কাহিনি পড়ে চোখে পানি এসে যেতো। নায়ক-নায়িকার কষ্ট যেন নিজের কষ্ট মনে হতো। কবিতা পড়ার সময়ে এক পূর্ণেন্দু পত্রীর 'কথোপকথন' কিংবা সৈয়দ হকের 'পরাণের গহীন ভিতর', সুধীন্দ্রনাথ দত্তের 'শ্বাশতী' অথবা জীবনানন্দ দাশ আবৃত্তি করে প্রাণ জুড়িয়ে যেতো। সেই সত্তর/আশির দশকে মান্নাদে, লতা, সন্ধ্যা, হেমন্ত, শ্যামল মিত্রের গান মানেই ছিল প্রেম বিরহের গান। আমাদের মনের কথা বলার ভাষা।
এরপর এলো তারুণ্য, নিজেরাই উপলব্ধি করলাম কৈশোরের প্রেম-ভালবাসার গল্পগুলো তেমন করে মনে আর দাগ কাটছে না। এলো বিটিভিতে সুবর্ণা, আফজাল, হুমায়ুন ফরিদীর জমানার অসাধারণ সব প্রেমের নাটক যেমন, 'পারলে না রুমকি', 'রক্তের আঙ্গুরলতা', 'একদিন যখন'। উপন্যাস, কবিতা, গান সবকিছুর পছন্দ পাল্টে গেল। পাড়ার বা স্কুলকলেজের জীবনের পছন্দের মানুষও পরিবর্তন হলো। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের ভালবাসা ও পছন্দ মানুষটি অনেকের জীবনেই স্থায়ী হয়ে গেল। সেই সময়ে দাঁড়িয়ে পেছনের পছন্দ, অপছন্দের কথা, প্রেম-ভালবাসার কথা ভাবলে নিজেদের কাছেই অবাক মনে হতো। অথচ প্রেম-ভালবাসাটা মানুষের জীবনে এমনই, যখন, যাকে ভালো লাগে মনে হয় এটাই সব। তাকে ছাড়া আর সব অর্থহীন।
বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে এসে মৈত্রেয়ী দেবীর 'ন হণ্যতে' পড়ে যখন আমরা বুঁদ হয়ে ছিলাম, ঠিক সেসময়ই মির্চা এলিয়েদের 'লা নুই বেঙ্গলী' এসে কেমন যেন সব এলোমেলো করে দিল। কার ভালোবাসার প্রকাশ বেশি স্ট্রং এ নিয়ে বন্ধুদের মধ্যে তর্কবিতর্ক হতো। এলেন রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ, মোহন খান এবং আরো অনেকে। এছাড়া মেমসাহেব, চোখের বালি, পরিণীতা, তিথিডোর, কালবেলা, একটু উষ্ণতার জন্য এরকম অনেক উপন্যাস আমাদের মনোজগতে দোলা দিয়ে গিয়েছিল। সেই সময়ের সহজ সরল উপন্যাসগুলো পড়ে আমরা সম্পর্ক ও সম্পর্কের টানাপড়েন বুঝতে পেরেছি। জীবনও সহজ ছিল, জীবনকে ঘিরে লেখালেখিও তেমনই ছিল। আজকালকার ছেলেমেয়েরা এইসব বই পড়ে কিনা জানি না। হয়ত আরো বেশি জটিল বই পড়ে, বিদেশি লেখা পড়ে বা ইন্টারনেটের কল্যাণে নানাধরণের তথ্য-উপাত্ত পেয়ে যায়। তাছাড়া তাদের প্রেম ও সম্পর্ক এবং আমাদের সময়কালের প্রেম ও সম্পর্কও এক নয়।
প্রেমকে নানাজনে নানাভাবে সংজ্ঞায়িত করেন। বয়স, সময়, শিক্ষা, পারিবারিক অবস্থা, ধর্ম, জাতপাত সবই প্রেম-ভালবাসার একেকটি উপাদান। কে যে কখন কাকে ভালোবাসবে এবং ছেড়ে চলে যাবে এর কোন স্থায়ী রূপ নেই। আগেও ছিল না। তবে ইদানীং ছেলেমেয়েদের কাছে প্রেম-ভালবাসা জীবনের চাইতে জরুরি নয়। চলতে চলতে যখন যাকে ভালোবাসতে ইচ্ছে হয়, ভালোবাসবে। কোনো কারণে স্বপ্নভঙ্গ হয়ে গেলে সম্পর্কের ছন্দপতনও ঘটে যাবে দ্রুত।
আশির দশকে যখন ভ্যালেন্টাইন দিবস বা ভালবাসা দিবস এভাবে বাজার মাত করেনি, সেসময় পহেলা ফাল্গুনই ছিল আমাদের কাছে ভালোবাসার দিন – আমরা গাইতাম "যৌবনেরই ঝড় উঠেছে আকাশ বাতাসে, নাচের তালে ঝংকারে তাই আমায় মাতালে।" কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে মেয়েরা হলুদ জামা, শাড়ি পরে, কপালে টিপ, চুলে ফুল, হাতে কাঁচের চুড়ি পরে এবং ছেলেরা পাঞ্জাবী পরে বসন্ত উৎসব করতো। এরপর এল ভ্যালেন্টাইনস ডে বা ভালোবাসা দিবস। ১৯৮০ সালের পর থেকে প্রতি বছর ১৪ ই ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশে পালিত হতে শুরু করলেও ১৯৯৩ সাল থেকে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। এ দিবসকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন রকম শুভেচ্ছাসূচক কার্ড, ফুল, চকোলেট, জামাকাপড় বিনিময় শুরু হয়। আর এখনতো বিভিন্ন দিবসকে ঘিরেই ভালবাসা ওঠানামা করে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অমিত রায় আর লাবণ্যের মতো এমন রোমান্টিক ও প্রগলভ জুটি, রোমিও-জুলিয়েট, কাম সেপ্টেম্বর, সানফ্লাওয়ার, রোমান হলিডে আর মুগ্ধ করে না আজকালকার ছেলেমেয়েদের। বরং আরো আধুনিক প্রেমের গল্পভিত্তিক হিন্দি ও ইংরেজি সিনেমার বিভিন্ন চরিত্র অনেক বেশি আকর্ষণ করে। আমাদের সময় সিনেমা হলে ও বিটিভিতে কিছু ইংরেজি, বাংলা মুভি দেখতে পারতাম। উত্তম-সুচিত্রা, সৌমিত্র-সুপ্রিয়া, রাজ্জাক-কবরী, ববিতা-জাফর ইকবালসহ আরো কিছু নায়ক নায়িকা ছিল আমাদের রোমান্টিক জুটি।
যে প্রেমকে আমরা মনে করতাম প্রকৃত প্রেম, আমাদের পরের প্রজন্মের কাছে তা হয়ে গেছে পুরানো, ম্যাড়ম্যাড়ে। সেইসময়ের প্রেম ছিল অনেকটাই সাদামাটা যেমন চিঠি, ফুল, পাশাপাশি বসে গল্প, কাছাকাছি কোথাও বেড়াতে যাওয়া, কোথাও বসে খাওয়া, ক্যাম্পাসে আড্ডা দেয়া, সামান্য উপহার বিনিময় এবং সন্ধ্যার মধ্যে ঘরে ফিরে আসা। নারী-পুরুষ চুম্বন ছাড়া আর তেমন কোনো সম্পর্কে জড়াতো না। প্রেম ও সম্পর্কের মধ্যে কেমন যেন একটা লুকানো ব্যাপার ছিল পারিবারিক ও সামাজিক কারণেই।
একুশ শতকে এসে এর সবই পাল্টে গেছে। সময়ের সাথে সাথে ভালোবাসার প্রকাশ, কথা, ধরণ ও সম্পর্ক সব অন্যরকম হয়ে গেছে। রাবীন্দ্রিক ভালোবাসার বলয় থেকে ছেলেমেয়েরা বেরিয়ে এসেছে। একুশ শতকের প্রেম আবেগে ভরপুর, স্বাধীন, উদ্দাম। এরা ভাব বিনিময়ের পাশাপাশি খোলাখুলি যৌন সম্পর্ক নিয়ে কথা বলে, প্রকাশ্যে ভালবাসা প্রকাশ করে এবং গ্রহণও করে। সেই ভালোবাসার সাথে জড়িয়ে থাকে শারীরিক সম্পর্ক। বিয়ে হোক বা না হোক, শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন প্রেমের একটি বড় অনুষঙ্গ। এসব ইস্যু নিয়ে আজকালকার কিশোর কিশোরী, তরুণ-তরুণীরা খুব একটা বিচলিত নয়।
অথচ উনিশ শতকের শেষভাগে এসেও প্রেমিক প্রেমিকার কাছে এসব ইস্যু বড় ফ্যাক্টর ছিল। প্রেমের ক্ষেত্রে শারীরিক অনুভূতিকে দারুণভাবে আটকে রাখা হতো। প্রেম বোঝার জন্য শরীর তেমনভাবে প্রয়োজন হয়নি, বরং বিভিন্ন কারণে শরীরের উপস্থিতিকে সবাই এড়িয়েই চলতো। একটা লেখায় পড়েছিলাম রবীন্দ্রনাথ মনে করতেন, কাঙ্ক্ষিত মানুষ যখন কল্পনা থেকে বাস্তবের মধ্যে চলে আসে, কল্পনার অসীম থেকে সংসারের সীমার মধ্যে চলে আসে, তখন প্রেম আর থাকে না। কারণ 'অনন্ত আকাশের ফাঁক না পেলে বাঁশি বাজে না'। শেষের কবিতা উপন্যাসেও অমিত বলেছে, স্ত্রী হচ্ছে ঘটিতে তোলা জল, আর প্রেমিকা নদীর জল যেমন ইচ্ছা সাঁতার কাটা যায়। সেইসময়ের অনুভূতি ভাল, না আজকের সময়ের উদার প্রেম ভালো সেই আলোচনায় যেতে চাইছি না। শুধু প্রেম, সম্পর্কের ভাঙন ও পরিবর্তনটা বোঝার চেষ্টা করছি।
যতোটুকু অনুভব করি ভালবাসা করণের 'সুখের অনুভূতি', আর এর উপর ভিত্তি করে যে সম্পর্ক তৈরি হয় দুজন মানুষের মধ্যে, সেটা হয় মূলত দেওয়া-নেওয়া সম্পর্ক। জীবনে চলার পথে সঙ্গীর ভালবাসা, সম্পদ, সুযোগ-সুবিধা, সেবাযত্ন, পরিচয়, ইমোশনাল সাপোর্ট এবং কোয়ালিটি টাইম পাওয়ার দরকার হয়। এতে কোনো কারণে ব্যত্যয় ঘটলে সম্পর্ক দুর্বল হয়ে পড়ে। এযুগে ভালবাসা দিবস, পহেলা ফাল্গুনের আনন্দ-উচ্ছ্বাস এবং ভালোবাসার প্রকাশ যেমন স্ট্রং, পাশাপাশি তেমনি দ্রুত সম্পর্কও ভাঙছে। ভালবাসা ফিকে হয়ে যাচ্ছে, বিশ্বাস নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ভালবাসা তৈরি ও ভালবাসা ভাঙার মধ্যে সময়ের ব্যবধান সামান্য। অনেকসময় আশেপাশের মানুষ এবং নিজেরাও বুঝতে পারে না কেন সম্পর্কে টানাপড়েন তৈরি হচ্ছে, আর কেনই বা ভেঙে যাচ্ছে। এই কারণেই বিয়ে বিচ্ছেদের হার সারা দেশেই বেড়েছে। প্রেমের সম্পর্কও ভেঙে যাচ্ছে হুটহাট করেই।
কেন জুটি ভাঙছে এর কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে বিশ্বাসভঙ্গ, বেশি মোবাইল ফোন ব্যবহার, পরকীয়া, সন্দেহ, মানসিক অবসাদ, যৌতুক, পারিবারিক দ্বন্দ্ব, যোগাযোগ কমে যাওয়া, মনোযোগ কমে যাওয়া, পরস্পরকে সময় না দেয়া এবং জোর খাটানো। অধিকাংশ মানুষ মনে করে 'ভালবাসা' আর 'সম্পর্ক' শব্দ দুটি এক এবং চিরস্থায়ী কিন্তু এই ধারণা ভুল। ভালবাসা এমন করণের আবেগ ও অনুভূতি, যা প্রতিটি মানুষ আলাদাভাবে অনুভব করে।
কিন্তু কেউ কেউ ধরে নেয় আমি একজনকে যেভাবে ভালোবাসবো, সেও আমাকে সেভাবেই ভালোবাসবে। তখনই তৈরি হয় বিরোধ এবং বিরোধ থেকে আত্মহত্যা, হত্যা এইসব। লেখায় পড়েছি, যাকে তুমি ভালোবাসো, সে চলে যেতে চাইলে তাকে মুক্ত করে দেও। ভালোবাসার ক্ষেত্রে জোরজবরদস্তি, প্রলোভন চলে না। আজকাল সম্পর্কগুলো দ্রুত ভেঙে যাওয়ার মূল কারণ মনে হয় কমিটমেন্ট থেকে সরে আসা। তাছাড়া কম্প্রমাইজ করার মানসিকতাও কমে আসছে।
মনে প্রশ্ন জেগে আসলেই কি ভালবাসা চিরন্তন? তাহলে দুটো মানুষ সবকিছু উপেক্ষা করে বিয়ে করার পরও কেন বিয়ে ভেঙে যায়? পাগল হয়ে প্রেম করার পর কেন জুটি ভেঙে যায়? আবার দীর্ঘদিন পাশাপাশি সংসার করার পরেও কেন বাঁধন আলগা হয়ে যায়? এর উত্তর হচ্ছে ভালবাসা নিজ থেকে চিরন্তন হয় না, একে বাঁচিয়ে রাখতে হয়। আমরা অনেকেই ভালোবাসার তোড়ে সঙ্গীকে নিজের করে রাখতে চাই, তার চিন্তাভাবনাকে গ্রাস করে ফেলতে চাই, যাকে ভালোবাসি তার বিষয়ে অবসেসড হয়ে পড়ি, জোর খাটাই, স্বাধীন পাখাকে ছেঁটে দেই। ভুলে যাই যতোই ভালবাসা থাকুক, দুটি মানুষ আলাদা। দুজনের কাজের, ভাবনার চিত্র আলাদা, পছন্দ-অপছন্দ আলাদা। সঙ্গীর বিশ্বাসভঙ্গ, শারীরিক সম্পর্ক না থাকা, আগ্রহ নষ্ট হয়ে যাওয়া, গ্যাসলাইটিং করা, কৃতজ্ঞতাবোধ না থাকা এবং ইগো ও আত্মমর্যাদার কারণে বহুদিন একসাথে থাকার পরেও সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যেতে পারে।
জীবনের বিভিন্ন ঘটনা আমাদের শিখিয়েছে প্রেমে পড়া সহজ, কিন্তু একে টিকিয়ে রাখা কঠিন। ভুলে গেলে চলবে না যে ভালবাসাতো বটেই, যৌনতারও একটা ক্লান্তি আছে। একজন লিখেছেন, এই ক্লান্তি টের পেয়েছিলেন বলেই হয়ত রবীন্দ্রনাথের ভালবাসা কখনও ভালোবাসার পাত্রকে গিলে খেতে চায়নি। তাঁর ভালোবাসার এটাই সবচেয়ে বড় ধর্ম। ভালবাসা ও যৌনতার এই সীমাবদ্ধতা রবীন্দ্রনাথের নায়ক-নায়িকরা টের পেয়েছিলেন এবং তা টের পাওয়ানোর জন্য কাউকে জোর খাটাতে হয়নি। আরেকটি বিষয়ও মনে রাখা জরুরি যে লোক দেখানোর জন্য রূপকথার নায়ক নায়িকার মতো প্রেম সাজাতে চাইলেই কিন্তু প্রেম টিকে যাওয়ার কথা না। কারণ জীবন কোন রূপকথা নয়। এই যুগে রূপকথার জীবন এবং প্রেম আমাদের বেশি টানছে, ভয়টা সেখানেই।