রাতে বেইলি রোড আটকে পড়া স্বজনদের আহাজারিতে ভারী হয়ে উঠেছিল
রাজধানীর বেইলি রোডের গ্রিন কজি কটেজ ভবনে আগুন লেগে ৪৬ জনের মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। গত বৃহস্পতিবার আগুন লাগলে রাত ১১ টার দিকে ঘটনাস্থলে পৌঁছান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের সংবাদকর্মী জহির রায়হান।
সেখানে তখন ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা বিশাল উচ্চতা সম্পন্ন সিঁড়ি (টিটিএল) দিয়ে ভবনের বিভিন্ন তলায় পাইপ দিয়ে পানি দিচ্ছে। আশেপাশের এলাকা তখন ছিল বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন। আটকে পড়া স্বজনের আহাজারিতে এলাকা ভারী হয়ে উঠেছে।
তখনই ভবনের নিচে কথা হয় রাখি বেগমের সঙ্গে। তিনি কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, "আমার ভাগিনা ছাদে আছে। ওর নাম বিকাশ। ওর সঙ্গে কথা হয়েছে। ও জানিয়েছে, ধোঁয়ার জন্য কষ্ট হচ্ছে ওর। বিকাশ পিজা ইনে চাকরি করে।"
এরপর সামনে এগিয়ে আগুন লাগা গ্রিন কজি কটেজ ভবনটির সামনে যাই। রাত ১১.৪০ মিনিটে সান্ত দাসকে বিশাল উচ্চতা সম্পন্ন সিঁড়ি (টিটিএল) দিয়ে নামিয়ে আনেন ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা।
নামানো হলে শান্ত দাসের স্বজনরা কান্না কণ্ঠে বলতে থাকেন, "ভাই ফিরে এসেছো।" এসময় শান্ত দাস জানান, তিনি তৃতীয় তলায় একটি রেস্টুরেন্টে চাকরি করেন। তার ধারণা, নিচতলায় সিলিন্ডার বিস্ফোরণে আগুন লেগেছে।
ঐ সময় ভবনের ছাদে তখন দেখা যায় মানুষ দাঁড়িয়ে রয়েছে। এরপর একে একে নামানো থাকে তাদের।
রাত একটার দিকে কয়েকজনকে নামানে হয়; তাদের মধ্যে ছিল মোহম্মদ হিমেল নামের একজন। নিচে নামার পর যেন তার শ্বাসকষ্ট হচ্ছিল। তার ফোনে বার বার ফোন দিচ্ছিল স্বজনরা। তবে তিনি কথা বলে জানাতে পারছিলেন না যে, কোথায় আছেন তিনি।
সাংবাদিক পরিচয়ে কথা বলতে চাইলে জহির রায়হানকে হিমেল বলেন, "ভাই আপনি সাংবাদিক, আমাকে একটু হাসপাতালে নিয়ে যান। আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে।"
এই বলে সংবাদকর্মীর কাঁধে হাত রাখেন। তখন পুরো রাস্তায় উৎসুক মানুষের ভিড় ছিল। বার বার পানি চাইছিল হিমেল। পাশে থাকা একজনের কাছে আধা লিটারের বোতলে অর্ধেক পানি ছিল। সেই পানি তিনি দিলেন।
এই সময় চারদিকে খুঁজেও রেড ক্রিসেন্টের কোনো সদস্যদের দেখা যায়নি। এমন সময় হিমেলের ফোনে ফোন দেয় তার এক আত্মীয়। তখন সংবাদকর্মী জহিরের সাথে কথা হয় সেই আত্মীয়ের। তখন তাকে ভিকারুননিসা নূন স্কুলের সামনে আসতে বলা হয়।
ঐ আত্মীয় জানান, কাছেই আছেন তিনি। সংবাদকর্মী তখন হিমেলকে আস্তে আস্তে হাঁটিয়ে স্কুলের সামনে তার আত্মীয়ের কাছে নিয়ে যায়।
আত্মীয়ের কাছে দিয়ে আসার পর হিমেল বললেন, "ধন্যবাদ ভাই। তবে এখানে রেড ক্রিসেন্টের সদস্যসহ অনেক স্বেচ্ছাসেবী থাকা উচিত ছিল। কোন পানি খাবার ব্যবস্থা নেই। এটা কেমন কথা। আমরা যারা জীবন নিয়ে ফিরছি তারাতো পানির অভাবে মারা যাবো।"
সংবাদকর্মী আবার ভবনের সামনে গিয়ে দেখেন, রিয়া নামের এক মেয়েকে রাত ১২ টা ৫০ মিনিটের দিকে উদ্ধার করে ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা। তাকে মনোয়ারা হাসপাতালে নেয় স্বজনরা। এ সময় ভবনের নিচে থাকা রিয়ার মা কান্না করে বলতে থাকেন যে, "আমার মেয়েকে পেয়েছি।"
একে একে ফায়ার সার্ভিসের উদ্ধার কর্মীরা ভেতর থেকে আটকে পড়া লোকদের উদ্ধার করতে থাকে। ফায়ার সার্ভিসের উদ্ধার কর্মী মোহম্মদ রাশেদকে রাত ১ টার দিকে ভবনের পেছন দিয়ে আরও ৫ জন কর্মীদের সঙ্গে বের হতে দেখা গেছে। এসময় তারা এয়ার জাম্পিং ব্যাগ নিয়ে বের হন। তিনি বলেন, ছাদে আর লোক নেই। আমাদের কাজ শেষ।
তখন ফায়ার সার্ভিসের দুর্ঘটনা সংক্রান্ত মিডিয়া সেল থেকে একটি বোর্ডে তথ্য লেখা ছিল, জীবিত উদ্ধার ৭৫ জন, অচেতন অবস্থায় উদ্ধার ৪২ জন, মৃত উদ্ধার ৩ জন।
উদ্ধার কর্মী ইমন বলেন, "জীবিত ৭৫ জন সুস্থ ছিল। তারা হেঁটে চলে গেছে। আর অচেতন ৪২ জনের কী অবস্থা সেটা এখন ডাক্তার বলতে পারবে।"
সেখানে সংবাদ প্রাপ্তির সময় ৯ টা ৫০ মিনিট। প্রথম ইউনিট পৌঁছানোর সময় ৯ টা ৫৬ মিনিট। পরবর্তীতে মোট ১৩ টি ইউনিট আগুন নেভানোর কাজ করে। রাত ১১ টা ৫০ মিনিটে দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণে আসে।
রাত ২ টার দিকে দেখা যায়, ভবনে আটকা পড়া ব্যক্তিদের উদ্ধারে যে টিটিএল সিঁড়ি ব্যবহার করছিল ফায়ার সার্ভিস সেটা বন্ধ করেছে। এখন পুরো ভবন ঘিরে রেখেছে পুলিশ সদস্যরা। তখন ভবনের নীচ তলায় ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা ছিল।
রাত ২.৪৩ মিনিটে দেখা যায়, আগুন লাগা ভবনটির ঘিরে রেখেছে পুলিশ। বাহির থেকে ভবনের ভেতরে ফায়ার সার্ভিসের কর্মী ছাড়া কাউকে যেতে দেওয়া হচ্ছে না। ভবনের নিচতলায় ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা আছেন। তখন ফায়ার সার্ভিসের হেড কোয়ার্টারের সিনিয়র অফিসার দেওয়ান রাজিব বলেন, "আমাদের কাজ প্রায় শেষ। ভবনের ভেতরে কোন আগুন বা ধোয়া নেই।"
পাশের একটি ভবনের কেয়ারটেকার লাবু রানা কীভাবে আগুনের সূত্রপাত হয় তা জানান। তিনি বলেন, "রাত সাড়ে ৯টার দিকে আমি চিৎকার শুনে বেইলি রোডে যাই। আমরা নিচতলা থেকে ধোঁয়া উঠতে দেখেছি। পরে একটি বিস্ফোরণের শব্দ শোনা যায় এবং নিচতলা থেকে আগুন উপরে উঠে যায়। তখন লোকজনকে বিল্ডিং থেকে লাফ দিতে দেখা যায়।"
নিচতলা থেকে আগুনের সূত্রপাত: সিআইডি প্রধান
ভবনের নিচতলা থেকে আগুনের সূত্রপাত হয় বলে রাত সোয়া ৩ টায় ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে সাংবাদিকদের জানান অপরাধ তদন্ত বিভাগের প্রধান মোহাম্মদ আলী মিয়া।
তিনি বলেন, "ফায়ার সার্ভিসের কাছ থেকে সব তথ্য পেলেই আমরা আলামত সংগ্রহ শুরু করব। সংগৃহীত আলামত আমাদের ল্যাবে পাঠানো হবে। সেখানে পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর আগুন লাগার কারণ জানা যাবে।"
রাত ৪.৫৭ মিনিটে দেখা যায়, আগুন লাগা ভবনের সামনে লোহার ব্যারিকেড দিয়ে রেখেছে পুলিশ। ভবনের ভেতরে কেউ নেই। বাইরে পুলিশ পাহারায় ছিল।
ভোর ৫ টার দিকে কথা হয় প্রত্যক্ষদর্শী রহমতউল্লাহর সঙ্গে। তিনি বলেন, নীচ তলাতে প্রথম আগুন লাগে। এরপর সেখান থেকে সিলিন্ডার বিস্ফোরণে আগুন ছড়িয়ে পড়ে ৭ তলা পুরো ভবনে।
রহমতউল্লাহ জানান, তিনি ৪০ বছর ধরে এই এলাকায় থাকেন। ভবনের প্রতিটি রেস্টুরেন্টে সিলিন্ডার ব্যবহার হয়। নীচ তলায় রাখা থাকে সিলিন্ডার।
ভবনের ২০০ ফিট দুরে বড় পুকুর ছিল। আগুন নেভাতে কলোনির এই পুকুর থেকে পানি নেয়ায় দ্রুত ফায়ার সার্ভিস আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে পেরেছে বলে জানান স্থানীয় বাসিন্দা তৌকি খান। তিনি বলেন, ৬ টি পাইপ পুকুরে লাগিয়েছিল পানি উঠাতে।
ভোর ৬ টায় টার দিকে যখন আগুন লাগা ভবনের সামনে থেকে চলে আসি তখন সেখানে ছিল স্বজনরা। কারও ভবনের ভেতরে মাল আটকে ছিল সেটার জন্য দাঁড়িয়ে ছিল।
ছেলেকে খুঁজতে আসা নজরুল ইসলাম বলেন, "ঢাকা মেডিকেলসহ কাছের সব মেডিকেলে খোঁজ নিয়েছি। ছেলেকে কোথাও পাইনি। ওর মোবাইল নাম্বারটিও বন্ধ আছে। ছেলে আমার এই ভবনের রেস্টুরেন্টে খেতে এসেছিল। ভবনে প্রতিটি তলায় সিলিন্ডার ছিল। এমন ভবনের রেস্টুরেন্টের পারমিশন দেয় কে?"
ভবনটিতে একটি জুস বার এবং একটি চা-কফির দোকানসহ আটটি রেস্টুরেন্ট ছিল। এছাড়া কয়েকটি মোবাইল ফোন, বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম ও কাপড়ের দোকানও রয়েছে।
এই ঘটনায় কাচ্চি ভাই রেস্তোরাঁর একজন ম্যানেজার ও চুমুক নামক আরেকটি রেস্তোরাঁর দুই মালিককে আটক করেছে পুলিশ। সেদিন সন্ধ্যায় এক সংবাদ ব্রিফিংয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত কমিশনার ড. খ. মহিদ উদ্দিন বলেন, "ভবনের মালিকসহ যারা দায়ী তাদের আইনের আওতায় আনা হবে।"