সৌন্দর্যবর্ধনের নামে বৃক্ষনিধন
সিলেট নগরের সুবিদবাজার এলাকার ঐতিহ্যবাহী দস্তিদার দিঘির সৌন্দর্যবর্ধনের কাজ চলছে। দিঘির চাপাড়ে নির্মাণ করা হচ্ছে গার্ডওয়াল ও ওয়াকওয়ে। এই সৌন্দর্যবর্ধণের জন্য কেটে ফেলা হয়েছে দিঘিপাড়ের বয়সি বৃক্ষগুলো। এই গাছগুলো কাটার জন্য বন বিভাগের অনুমতিও নেয়নি সিলেট সিটি করপোরেশন।
সিলেট সিটি করপোরেশন (সিসিক) সূত্রে জানা যায়, সাবেক মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী দায়িত্বে থাকাকালে দস্তিদার দিঘির সৌন্দর্যবর্ধনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। দিঘি পাড়ের গাছ কাটার সিদ্ধান্তও হয় সে মময়ই। তখন গাছগুলো নিলামে বিক্রি করা হয়।
এই এলাকার কাউন্সিলর ও স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সৌন্দর্যবর্ধনের কাজ শুরু হওয়ার আগে সিটি কর্তৃপক্ষ এলাকাবাসীকে নিয়ে বৈঠক করে। এ সময় সৌন্দর্যবর্ধন কাজের সুবিধার্থে গাছ কাটার প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করে সিটি কর্তৃপক্ষ জানায়, গাছগুলো সিটি করপোরেশনের মাধ্যমে কাটাতে হলে অনেক দেরি হবে। তখন স্থানীয় পঞ্চায়েত কমিটিকে গাছগুলো কেটে ফেলার দায়িত্ব দেওয়া হয়। এরপর সিটি করপোরেশেরনের কর্মকর্তারা কাটার জন্য ১০টি গাছ চিহ্নিত করে দেন। সম্প্রতি পঞ্চায়েত কমিটি এই গাছগুলো কাটা শুরু করে।
তবে বন বিভাগের সিলেট কার্যালয়ের সহকারী বন সংরক্ষক মোহাম্মদ নাজমুল আলম বলেন, সিটি করপোরেশন থেকে বিভিন্ন প্রকল্পের জন্য বেশ কিছু গাছ কাটার অনুমতি নেওয়া হয়েছে। কিন্তু দস্তিদার দিঘির পাড়ের গাছ কাটার অনুমতি সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষ নেয়নি।
তিনি বলেন, 'তারা নিজেদের দায়িত্ব পালন না করে এভাবে এলাকাবাসীকে দিয়ে গাছ কাটাতে পারেন না।'
সৌন্দর্যবর্ধনের নামে এভাবে নির্বিচারে গাছ কাটায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন পরিবেশকর্মীরা। পরিবেশকর্মী শাহ সিকান্দর আহমেদ শাকির বলেন, 'দিঘি বা পুকুরের পাড় থাকবে মাটির। এখানে মাটি সরিয়ে ইটপাথরের ওয়াকওয়ে বানানো কখনোই যুক্তিসংগত কাজ নয়। সৌন্দর্যবর্ধন করতে চাইলে দিঘির পাড় মাটির রেখেই করা যায়। এতে খরচও কম হবে, গাছও কাটতে হবে না। কিন্তু এর জন্য প্রয়োজন দায়িত্বশীলদের পরিবেশবান্ধব পরিকল্পনা। তা না করে সিসিক কর্মকর্তারা সৌন্দর্যবর্ধনের নামে গাছ কেটে নগরকে আরও সৌন্দর্যহীন করছেন।'
সরকারি কোনো প্রতিষ্ঠান বেসরকারি কোনো কর্তৃপক্ষকে গাছ কাটার দায়িত্ব দিতে পারে না উল্লেখ করে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) সিলেট বিভাগীয় সমন্বয়ক শাহ শাহেদা আক্তার বলেন, 'সিটি করপোরেশন বেসরকারিভাবে স্থানীয়দের গাছ কাটার দায়িত্ব দিতে পারে না। নেহায়েত গাছ কাটতে হলে বন বিভাগের অনুমতি নিয়ে কর্তৃপক্ষ যদি জরুরি মনে করে, তাহলে গাছ কাটবে।'
তিনি বলেন, একটি দিঘি থাকলেই যে ওয়াকওয়ে করা লাগবে এমনও কোনো নিয়ম নেই বা এটার কোনো প্রয়োজনীয়তাও নেই। দিঘি একটি প্রাকৃতিক সম্পদ এবং প্রাকৃতিকভাবেই তার চারপাশের পরিবেশ মানুষের হাঁটাচলার জন্য রাখা উচিত।
তিনি আরও বলেন, 'দিঘির পাড়ে ওয়াকওয়ে করাই হয় বাণিজ্যিক স্বার্থে। আমি মনে করি সৌন্দর্যবর্ধনের নামে এভাবে প্রকৃতিকে নষ্ট করা সিটি করপোরেশনের ভুল সিদ্ধান্ত।'
এ ব্যাপারে সিলেট সিটি করপোরেশনের ৭নং ওয়ার্ডের কাউন্সিল সায়ীদ মো. আব্দুল্লাহ বলেন, 'আমি এই এলাকায় নতুন দায়িত্ব নিয়েছি। সাবেক মেয়র ও সাবেক কাউন্সিলরের সময় এই প্রজেক্ট হাতে নেওয়া হয়।'
গাছ কাটার বিষয়ে তিনি বলেন, 'এখানে পঞ্চায়েত আছে। যেহেতু গাছগুলো এলাকার, তাই সিটি করপোরেশন ৮ থেকে ১০টি গাছের তালিকা দিয়েছে পঞ্চায়েত কমিটিকে কাটার জন্য। তারা এই গাছ কাটার দায়িত্ব নিয়ে গাছ কাটাচ্ছেন। তবে আমরা গাছ কাটার এই দায় এড়াতে পারি না। হয়তো আরও দুই ফুট এদিক-সেদিক হলে অনেক গাছ কাটা পড়ত না।'
এ বিষয়ে সিসিক মেয়র আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী বলেন, 'আমি দায়িত্ব নেওয়ার পর কোনো গাছ কাটার জন্য টেন্ডার হয়নি। আমরা আপাতত সব গাছ কাটা বন্ধ রেখেছি। আমারা খবর পেয়েছি দস্তিদার দিঘির গাছ কাটা হচ্ছে। তাই এই গাছ কাটাও এখন বন্ধ রেখেছি। তবে কিছু ক্ষেত্রে, যেমন একটা গার্ডওয়াল লাগবে এর মাঝখানে গাছ পড়েছে, সেটা তো কাটতেই হবে। তবে এক্ষেত্রে আমার পরিষদ সঠিক নিয়ম মেনেই কাজ করবে।'