ঢাকার ৩০০ ফিট সড়ক নিয়ে উন্মাদনা!
আমি কোনোদিন '৩০০ ফিট রাস্তা' বা পূর্বাচল এক্সপ্রেসওয়ে বা শেখ হাসিনা সরণিতে সন্ধ্যার আগে মানুষের ভিড় দেখিনি।
যখন সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসে, রাস্তার আলোগুলো জ্বলে ওঠে, ঠিক তখন প্রশস্ত রাস্তার পাশের ঝলমলে পরিবেশ জনতার পদধ্বণিতে মুখর হয়ে ওঠে।
চারপাশের দৃশ্য ও পরিবেশ উপভোগ করতে লোকজন ভিড় জমায়, কেউ কেউ আবার একটি সুন্দর সূর্যাস্ত দেখতে আসে এখানে।
দর্শনার্থীদের ওভার-দ্য-টপ লুপের প্রান্তে না বসার জন্য বারবার সতর্কতা দেওয়া আছে। এখান থেকে নিচে পড়ার অর্থ নিশ্চিত মৃত্যু অথবা গুরুতর জখম হওয়া। কারণ লুপের নিচে এক্সপ্রেসওয়ে দিয়ে দ্রুতগামী যানবাহন চলাচল করে।
এদিকে, কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে ফটোগ্রাফাররা যেভাবে পর্যটকদের পিছু লাগে, সেভাবেই তারা এখানকার দর্শণার্থীদেরও পিছু লেগে থাকে।
এসব কাণ্ড দেখে, এটা পাবলিক পার্ক; নাকি বহু লেনের ব্যস্ত হাইওয়ে তা বোঝা মুশকিল।
গত নভেম্বরে এই এক্সপ্রেসওয়ে উদ্বোধনের পর থেকে ওভার-দ্য-টপ গোলচত্বরগুলো ঢাকার জনপ্রিয় 'পর্যটন স্পট' হয়ে উঠেছে।
এখানে প্রতিনিয়ত পরিবার-পরিজন নিয়ে ঘুরতে আসা একটি 'স্বাভাবিক' বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। হরহামেশাই মানুষ সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মে এই রাস্তার ধারে ঘুরে বেড়ানোর ছবি ও ভিডিও পোস্ট করেছেন।
এখানে দাঁড়িয়ে টিকটকাররা ভাইরাল নাচের ভিডিও পোস্ট করে, ধনী পরিবারের যুবকেরা গভীর রাতে প্রায়ই মাতাল অবস্থায় এখানে গাড়ির শোডাউন চালায়।
গোলচত্বরের প্রান্ত থেকে পড়ে হতাহত হওয়ার পাশাপাশি, গাড়ি দুর্ঘটনা এখানকার একটি সাধারণ ঘটনা। তারপরও দর্শনার্থীদের আগ্রহ কমছে বলে মনে হয় না।
চারিদিকে উন্মাদনা
সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে, দিনের শেষ আলোর রেখা যখন ফিকে হয়ে যাচ্ছে, তখন নীলা মার্কেটের পাশের একটি জটলার চিৎকার-চেঁচামেচিতে হঠাৎ পুরো এলাকা জেগে উঠল।
দুই যুবককে ধাওয়া করতে দেখা যায় এক লোককে।
তিনি চিৎকার করে বলছেন, 'ওদের ধর'।
ব্যস তারপর দুজন, তিনজন করে বাড়তে বাড়তে জটলার বহু মানুষ ব্যস্ত রাস্তা দিয়ে ওই দুই যুবককে তাড়া করতে লাগল।
আসলে কী ঘটেছে, ধাবমান মানুষগুলো তা ঠিক না জানলেও, যুবক দুটিকে না ধরা পর্যন্ত তারা তাড়া করা থামায়নি।
ছেলে দুটোকে ধরে এনে প্রকাশ্যে তাদের মারধর করা হয়। ঘুসি, ও চড়-থাপ্পড়ে তারা ক্ষতবিক্ষত হয়ে যায়।
তবু বলতে হয় তারা ভাগ্যবান, কারণ দ্রুত পুলিশ ঘটনাস্থলে এসে তাদের উন্মত্ত জনতার হাত থেকে উদ্ধার করে। এরপর তাদের রাস্তার পাশের একটি থানায় নিয়ে যাওয়া হয়।
আহসানউল্লাহ নামে ফুটপাতের এক সিগারেট বিক্রেতা দর্শনার্থীদের কাছে চিৎকার করে বলছেন, 'ওরা (ওই যুবকেরা) আমার কাছ থেকে দুটা ডার্বি সিগারেট ছিনতাই করছে।' দুটি ডার্বি সিগারেটের দাম প্রায় ১০ টাকা!
ওই যুবকদের ধরতে 'সফল' হওয়ায় মানুষ বেশ খুশি হয়েছে বলে মনে হচ্ছে। কারণ এই ছোট চুরির ফলে একটি মজাদার, স্ক্রিপ্টেড 'অ্যাডভেঞ্চারস্ক' অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে তারা। যার ফলে কারো কোনো গুরুতর ক্ষতিও হয়নি, আবার বেশ মজাও পাওয়া গেছে!
ছিনতাইকারীদের ওপর ক্ষোভ উগরে দিয়ে শহিদুল ইসলাম নামের এক ব্যক্তি উচ্চস্বরে হাসতে হাসতে বলেন, 'আমি ওরে খুব জোরে ঘুসি মারছি। ওরে মাইরা হাতের সুখ মিটাইছি।'
তিনি এক্সপ্রেসওয়ের নীলা মার্কেট-মইজুদ্দিন চত্বরে 'ঘটি গরম' নামের চানাচুর দিয়ে তৈরি এক ধরনের খাবার বিক্রি করেন।
শহিদুল বলেন, 'রাতভর এই জায়গায় বিভিন্ন সার্কাস চলে।'
পরিবার নিয়ে ঘুরতে আসার জায়গা?
রাজধানীর আগারগাঁও এলাকার বাসিন্দা আবদুস সামাদ ওই সন্ধ্যায় পরিবারের সঙ্গে রাস্তার পাশে সময় কাটাচ্ছিলেন।
সামাদ সাহেব বলেন, 'এটি একটি সুন্দর রাস্তা। আমার বাচ্চারা ফেসবুকে ছবি দেখেছে এবং তখন থেকেই তারা এখানে আসার জন্য জোর করছে। রাস্তা যে এত চওড়া, তা দেখে আমি সত্যিই মুগ্ধ।'
ঢাকা থেকে এত মানুষ এক্সপ্রেসওয়ের আশপাশে জড়ো হয়ে প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটায়, এটা বিরক্তিকর মনে করেন কিনা জানতে চাইলে তিনি পাল্টা বলেন, 'এতে সমস্যা কী? আমাদের কোথাও না কোথাও তো যেতে হবে। শিশুরা তো সারাদিন কেবল স্কুলে ও বাড়িতে বসে থাকতে পারে না।'
খোলা জায়গার অভাবের একটি প্রমাণ?
এদিকে, এক্সপ্রেসওয়ে নিয়ে সাম্প্রতিক দর্শনার্থীদের আকর্ষণকে নগরবাসীর অবকাশ যাপন বা পরিবার-পরিজনের জন্য পর্যাপ্ত পার্ক ও খোলা জায়গা দিতে সরকারের ব্যর্থতার প্রমাণ হিসেবে দেখছেন নগর পরিকল্পনাবিদরা।
২ কোটি ২০ লাখ বাসিন্দার শহর ঢাকায় খেলার মাঠ, শিশুদের খেলাধুলার জন্য খোলা জায়গা বা পরিবারের একসঙ্গে সময় কাটানোর জায়গা একেবারেই নেই।
রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ড্যাপ) বিশ্লেষণে দেখা গেছে, রাজধানী সিটি করপোরেশনের ১২৯টি ওয়ার্ডের মধ্যে ৪১টিতে খেলার মাঠ নেই।
এছাড়াও, যেগুলোও আছে, সেসবের অনেকগুলোতে আবার সাধারণ জনগণ যেতে পারেনা।
রাজউক আরও জানায়, ৩৭টি ওয়ার্ডে না আছে খেলার মাঠ, না আছে পার্ক।
নগর পরিকল্পনাবিদদের পরামর্শ, প্রতি আধা বর্গকিলোমিটার অন্তর একটি করে খেলার মাঠ থাকা উচিত।
সেই হিসাব অনুযায়ী, ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের আওতাভুক্ত ৩০৫ দশমিক ৪৭ বর্গকিলোমিটার এলাকার মধ্যে ৬১০টি খেলার মাঠের প্রয়োজন। কিন্তু আছে মাত্র ২৫৬টি।
অন্যদিকে, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স (বিআইপি) পরামর্শ দিয়েছে, ঢাকার মতো একটি শহরের ২ কোটি ২০ লাখ বাসিন্দার জন্য দুই হাজার পার্ক ও ৪ হাজার মাঠ প্রয়োজন- যা নিঃসন্দেহে অনেক দূরের কথা।
নগর পরিকল্পনাবিদ ড. আদিল মোহাম্মদ খান বলেন,'৩০০ ফিট দীর্ঘ এক্সপ্রেসওয়ে নিয়ে যে উন্মাদনা তৈরি হয়েছে, তা সাধারণ জনগণের বিনোদনের সুযোগ-সুবিধার অভাবকেই প্রতিফলিত করে।'
তিনি বলেন, 'আমাদের শহরের বাসিন্দারা তাদের পরিবারের সদস্যদের নিয়ে যেতে পারে এমন জায়গা খুব সীমিত। আর বিনোদনের জন্য যে সব জায়গা তৈরি করা হয়েছে, তাতে এক ধরনের বৈষম্য রয়েছে।'
তিনি আরও বলেন, 'আমরা দেখি কিছু কিছু জায়গায় শুধু উচ্চ-মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষের প্রবেশাধিকার থাকলেও, দরিদ্র বা নিম্ন-মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ হয়ত তা পায়না।'
তিনি পরামর্শ দেন, 'কোনো শহরের বিনোদনমূলক স্থান থাকার অর্থ এই নয় যে এটি শহরের কেন্দ্রে বা শহর থেকে দূরে হতে হবে। এলাকাভিত্তিক পাবলিক স্পেস থাকতে হবে, যেখানে স্থানীয়রা বেড়াতে যেতে পারে। আমাদের সেরকম কোনো জায়গা নেই। সামগ্রিকভাবে আমাদের কয়েকটি মাত্র বড় খোলা জায়গা আছে, যার মধ্যে কয়েকটিতে ঢুকতে আবার টাকা দিতে হয়।'
ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের জন্য নতুন স্পট
রাত যত গভীর হচ্ছিল, রাস্তার ধারে ভিড় ততই বাড়ছিল। আইসক্রিম বিক্রেতা সোহাগের মুখে চওড়া হাসি দেখা যায়, কারণ তার বিক্রি ভালোই চলছিল।
তিনি বলেন, 'মাঝরাত পর্যন্ত এই জায়গাটি প্রাণচঞ্চল থাকে। শুক্র ও শনিবারের তুলনায় আজ এখানে যা দেখছেন, তা অনেক কম।'
সাদ্দাম নামের এক আলোকচিত্রী জানান, পূর্বাচল সড়ক উদ্বোধনের পর থেকেই তিনি এখানে কাজ করছেন।
তিনি বলেন, 'শুরুতে টাকা ভালো ছিল। আগে দিনে পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত আয় করতাম, কিন্তু এখন প্রতিযোগিতা বেশি, কারণ এখানে প্রায় ২০ জন ফটোগ্রাফার কাজ করেন।'
তার বাড়ি কুমিল্লা। বর্তমানে থাকেন সাভারের বেরুলিয়ায়। মধ্যরাত পর্যন্ত তার ব্যবসা চলে, তারপর তিনি সিএনজি অটোতে চড়ে বাড়ি ফেরেন।
তিনি বলেন, 'আমরা প্রতিটি ছবির জন্য ১০ টাকা করে নিই। কিছু ক্লায়েন্ট গ্রুপ হিসেবে আসে এবং একসঙ্গে ২০০টিরও বেশি ছবি তোলে।'
মর্মান্তিক ঘটনা, ভাইরাল মুহূর্ত
এই রাস্তায় ঘটে যাওয়া মর্মান্তিক ও অদ্ভুত অনেক ঘটনার ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়ায় দেখতে পাওয়া যায়।
কিছুদিন আগে লুপ-আপের কিনারা থেকে এক তরুণীর নিচের এক্সপ্রেসওয়েতে পড়ে যাওয়ার একটি ভিডিও ভাইরাল হয়েছিল। অনেকে ভেবেছিলেন, তিনি হয়ত মারা গেছেন।
দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড- ওই নারীর সঙ্গে কথা বলে ওই ঘটনার কথা অনলাইনে শেয়ার করে জানায়, ভুক্তভোগী বেঁচে গেছেন এবং পরে তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়।
ওই নারী বলেন, 'মদ্যপ প্রেমিকের সঙ্গে তিনি সেখানে গিয়েছিলেন। পা পিছলে তিনি সেখান থেকে পড়ে যান।'
ভুক্তভোগী প্রাণে বেঁচে গেলেও তার সামনের চোয়াল ভেঙে গেছে বলে জানিয়েছেন প্রত্যক্ষদর্শীরা।
সম্প্রতি ভাইরাল হওয়া আরেকটি অদ্ভুত ফুটেজে দেখা যায়, টয়োটা নোয়া মিনিভ্যানের বনেটে দাঁড়িয়ে আছেন এক যুবক। দরজা খোলা অবস্থায় গাড়িটি প্রচণ্ড গতিতে চক্কর দিচ্ছে।
একই ফুটেজে দেখা যায়, একটি গাড়ি প্রচণ্ড গতিতে চক্কর দিচ্ছে, হঠাৎ গাড়িটি রাস্তার পাশের আইল্যান্ডে লেগে বিধ্বস্ত হয়।
ড. আদিল মুহাম্মদ খান সবার মধ্যে ছড়িয়ে পড়া 'ভাইরাল হওয়ার'এই তাগিদের উপর জোর দিয়ে বলেন, এই জাতীয় অদ্ভুত আচরণ সামগ্রিক সামাজিক শিষ্টাচার এবং মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতির সঙ্গে সম্পর্কিত।
তিনি বলেন, 'বিশেষ করে শহুরে মানুষের মধ্যে সামাজিক অস্থিরতা একটি সমস্যা। লোকচক্ষুর সামনে প্রাসঙ্গিক থাকার একটা প্রবণতা আছে, এভাবে তারা সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হচ্ছে।'
রাস্তার পাশে থানার কর্তব্যরত পুলিশ কর্মকর্তা সাব্বির আহমেদ জানান, দর্শনার্থীদের নিজেদের নিরাপত্তার জন্য দায়িত্বজ্ঞানহীন আচরণ না করার জন্য সচেতনতা সৃষ্টিতে কাজ করছেন তারা।
তিনি বলেন, গুলশানের মতো এলাকা থেকে মানুষ প্রায়ই রাত ১০টার পর এখানে আসেন। তারা ছবি তোলে এবং এসব করে। মাঝে মাঝে দুর্ঘটনাও ঘটে। তবে শুরুর দিকে হতাহতের ঘটনা বেশি হতো। এখন আমরা আইল্যান্ডের পাশে না দাঁড়ানোর বিষয়ে সচেতনতা গড়ে তুলছি।'
ভাবানুবাদ: তাবাসসুম সুইটি